গত ১৬ মার্চ লোকসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রথম কোনও সংবাদমাধ্যমে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, সেটি ছিল তামিলনাডুর থান্তি টিভিকে। শুধু তাই নয়, ওই চ্যানেলের অ্যাঙ্করদেরও চমকে দিয়ে তিনি সাক্ষাৎকারের জন্য হাজির হয়েছিলেন সাবেকি তামিল লুঙ্গি ‘ভেশতি’ পরে, আর সাক্ষাৎকারের শুরুতে বেশ কিছুটা কথা বলেছিলেন ভাঙাভাঙা তামিল ভাষাতেও।

এ বছরের শুরু থেকে তিনি অন্তত বারদশেক তামিলনাডু সফর করেছেন, ভোটের প্রচারে ওই রাজ্যে একের পর এক জনসভা ও রোড শো-ও করে গেছেন ক্লান্তিহীনভাবে। একই রকম ভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদী সম্প্রতি বারে বারে ফিরে গেছেন দক্ষিণ ভারতের আর একটি রাজ্য কেরালাতেও। গত জানুয়ারিতে অযোধ্যায় নবনির্মিত রামমন্দিরে বিগ্রহের ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ অনুষ্ঠানের আগেও মোদী দক্ষিণ ভারতের একের পর এক মন্দির দর্শন করেছেন এবং পুজো দিয়েছেন। কর্নাটক, তামিলনাডু, তেলেঙ্গানা বা তামিলনাডুর অনেকগুলো মন্দিরই প্রধানমন্ত্রীর সেই তীর্থ পরিক্রমায় ঠাঁই পেয়েছিল। ফলে ভোটের মরশুমে দাক্ষিণাত্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যে প্রবল রাজনৈতিক গুরুত্ব পাচ্ছে তা দেখাই যাচ্ছে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, তামিলনাডু বা কেরালার মতো রাজ্যে এই মুহূর্তে বিজেপির কোনও এমপি বা সংসদ সদস্যই নেই। একই অবস্থা অন্ধ্রেও। বস্তুত দক্ষিণ ভারতের মোট পাঁচটি রাজ্য (অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, কর্নাটক, তামিলনাডু ও কেরালা) ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (পন্ডিচেরি) মিলে যে মোট ১৩০টি সংসদীয় আসন– বিদায়ী লোকসভায় বিজেপির দখলে ছিল তার মাত্র ২৯টি। এই ২৯টির মধ্যে ২৫টিই আবার কর্নাটক থেকে, আর বাকি চারটি তেলেঙ্গানায়। কর্নাটকই দাক্ষিণাত্যের একমাত্র রাজ্য যেখানে বিজেপি এককভাবে কখনও সরকার গড়েছে, যদিও গত বছরের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস সেখানে জিতে আবার ক্ষমতায় ফিরেছে।

তবে এবারের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজে বিজেপি জোটের জন্য ‘আব কি বার চারশো পার’ বা চারশোরও বেশি আসনের যে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছেন – তার ধারেকোছে যেতে হলেও বিজেপিকে দক্ষিণ ভারতে অনেক বেশি আসন পেতে হবে। কারণ উত্তর, পশ্চিম বা পূর্ব ভারতে যে সব রাজ্য বিজেপির দুর্গ বলে পরিচিত – সেখানে ইতোমধ্যেই প্রায় সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন তাদের ঝুলিতে, সেটা আর বাড়ানো কার্যত অসম্ভব। ফলে বিজেপির আসন বাড়ানোর একমাত্র সুযোগ কেবল দক্ষিণেই। অথচ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, দাক্ষিণাত্য চিরকালই বিজেপির রাজনৈতিক ভাবধারা ও দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। শতকরা ভোটের হার বা আসনসংখ্যা– দু’দিক থেকেই এই রাজ্যগুলোতে বিজেপির প্রভাব বরাবরই ছিল নগণ্য।

মধ্য ভারতে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত যে বিন্ধ্য পর্বতমালা দাক্ষিণাত্যকে বাকি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, সেটাকে শুধু একটা ভৌগোলিক বিভাজন বলে মনে করলে ভুল হবে। বিন্ধ্যের দক্ষিণে ভারতের যে অংশটুকু, একপাশে বঙ্গোপসাগর আর অন্য পাশে আরব সাগরে ঘেরা সেই দাক্ষিণাত্যই হলো এ দেশে দ্রাবিড় সংস্কৃতির পীঠস্থান। আর স্থলবেষ্টিত উত্তর ভারত বা ‘আর্যাবর্ত’কে মনে করা হয় আর্য সভ্যতার কেন্দ্রস্থল। এখানে উল্লেখ্য, মহারাষ্ট্র যদিও বিন্ধ্যের দক্ষিণে অবস্থিত – ভারতের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে ওই রাজ্যটিকে পশ্চিম ভারতের অংশ হিসেবেই গণ্য করা হয়। ফলে দক্ষিণ ভারতের মধ্যে আমরা মহারাষ্ট্রকে ধরছি না।

এই দাক্ষিণাত্যের তামিলনাডুতেই আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে ই ভি রামস্বামী বা ‘পেরিয়ারে’র নেতৃত্বে ‘দ্রাবিড়িয়ান আন্দোলনে’র জন্ম, যা আর্যাবর্তের হিন্দু সমাজের জাতপাত বা বর্ণাশ্রম প্রথাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছিল। ব্লুমবার্গের কলামনিস্ট ও বিশ্লেষক অ্যান্ডি মুখার্জি মনে করেন, দক্ষিণ ভারতে সামাজিক সংস্কারের এই যে একটা দীর্ঘ পরম্পরা আছে সেটাই তাদের উত্তর ভারতের রাজনীতি থেকে চিরকাল আলাদা করে রেখেছে।

‘তামিলনাডু যেমন হিন্দুদের জাতপাতের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন লড়াই করেছে। পাশের রাজ্য কেরালাতেও শিক্ষার হার প্রায় একশোভাগ, আর ওটাই কিন্তু ভারতে প্রথম রাজ্য যেখানে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এসেছিল,’ জানাচ্ছেন তিনি। ‘ফলে বিজেপির ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কখনওই এখানে পায়ের তলায় জমি খুঁজে পায়নি। পাশাপাশি উত্তর ভারতকে দেখুন, তারা বোধহয় বিশ্বাস করতেই ভুলে গেছে সেখানে সত্যিকারের উন্নয়ন কখনও সম্ভব। ফলে উত্তর ভারতে রামমন্দির দিয়ে মানুষের আবেগকে উসকে দেয়া যেতে পারে, কিন্তু দক্ষিণে সেটা সম্ভব নয়,’ বলছিলেন অ্যান্ডি মুখার্জি।

ভারতের দক্ষিণ আর উত্তরভাগের মধ্যে এই যে বিপুল সাংস্কৃতিক ব্যবধান, প্রধানত উত্তর ভারতের ও হিন্দিভাষীদের দল হিসেবে পরিচিত বিজেপি দক্ষিণে এসে সেই ‘বৈচিত্র্য’র প্রতি সুবিচার করতে পারেনি বলেও বিশ্লেষকরা অনেকেই মনে করেন। ফলে দাক্ষিণাত্য বিজেপিকে আরও একবার নিরাশ করবে, না কি আগামী দিনে তাদের জন্য সেখানে একটা সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেবে – সেটা জানার জন্য আরও প্রায় মাসদেড়েক অপেক্ষা করা ছাড়া তাই গতি নেই! সূত্র: বিবিসি।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews