জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান তার সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে বাংলাদেশে অমুসলিমদের কাছ থেকে জিজিয়া কর নেওয়াকে সমর্থন করেছেন (এটিএন নিউজ, ২৫ জুলাই, ২০২৫)। জামায়াত আমির ওই ব্যবস্থাই ফিরিয়ে আনতে চান, যা সাতশ বছর আগে মুসলিম জাহানের খলিফা (১৮৩৯-১৮৬৯) ‘তানজিমাত’ আইনে উচ্ছেদ করেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন— তানজিমাত কী? তানজিমাত যুগে অটোমান তুরস্কে গৃহীত সংস্কারাবলি কী ছিল। সূত্র: ‘ইসলামিক হিস্ট্রি ভার্চুয়াল অ্যাকাডেমি’।

দেশের বৃহত্তম ইসলামী সংগঠনের শীর্ষ নেতার এই বক্তব্যের প্রভাব বাংলাদেশ, বিশ্বব্যাপী এবং ভারতীয় মুসলিমদের ওপর কী হতে পারে, তা নিয়ে একাডেমিক আলোচনা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে ভারতের মুসলিমবিরোধী উগ্র মিডিয়া এ নিয়ে সমালোচনা শুরু করেছে, যেখানে মুসলিমরা আগে থেকেই ভীতসন্ত্রস্ত। এর দায় কে নেবে?

আমাদের বুঝতে হবে, বাংলাদেশের বাইরেও বিশাল একটা বিশ্ব রয়েছে এবং বিশ্বের সেই সব অংশে মুসলিমরা বাস করে। যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ১.১ শতাংশ, কানাডায় ৫ শতাংশ, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডে প্রায় একই। মনে রাখতে হবে, জিজিয়া কোনো সাধারণ কর নয়; এটি রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারণ করে। জিজিয়ার সঙ্গে দাসপ্রথা, দাসী-সংসর্গ ইত্যাদি জড়িত (সূরা নিসা ২৪, মুহাম্মদ ৪, মুমিনুন ৬, এবং অসংখ্য হাদিস)। জিজিয়া-রাষ্ট্রে অমুসলিমরা রাষ্ট্রপ্রধান, সেনাপ্রধান, প্রধান বিচারপতি, এমনকি সাধারণ বিচারপতি বা সৈন্যও হতে পারতেন না।

কোরআনে জিজিয়ার উল্লেখ রয়েছে একটি মাত্র আয়াতে। সূরা তওবা, আয়াত ২৯: “তোমরা যুদ্ধ কর আহলে কিতাবের ওই লোকদের সাথে, যারা আল্লাহ ও রোজ হাশরে ঈমান রাখে না, আল্লাহ ও তাঁর রসুল যা হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম করে না এবং গ্রহণ করে না সত্য ধর্ম, যতক্ষণ না করজোড়ে তারা জিজিয়া প্রদান করে”— অনুবাদ, মাওলানা মুহিউদ্দিন খান। আয়াতে ‘আহলে কিতাব’ বলা হলেও, এটি সব অমুসলিমের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে।

১) জিজিয়ার প্রশ্ন ওঠে যুদ্ধে মুসলিমদের হাতে অমুসলিমদের পরাজয়ের পর। বাংলাদেশে মুসলিম-অমুসলিমের মধ্যে কোনো যুদ্ধ হয়নি, তাই জিজিয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

২) জামায়াত আমির সুন্নি; শিয়ারা তার রাষ্ট্রে কেন যাকাত দেবে এবং তিনি তা কীভাবে আদায় করবেন? শিয়াদের যাকাতের নাম ‘খুমস’, যা ২০ শতাংশ (ইসলামিক ল’জ, পৃষ্ঠা ৩২০, শিয়া শারিয়া: ইমাম আয়াতুল্লাহ সিস্তানি)। অনেক আলেম শিয়াদের মুসলিম মানেন না, কেউ কেউ কাফিরও বলেন। কাফিরের কাছ থেকে কি যাকাত নেওয়া যায়? তবে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২০০৫-২০০৬ সালে জর্দানের আম্মানে ৮৪টি মুসলিম দেশের ৫৫২ সদস্যের সম্মেলন ‘দ্য আম্মান মেসেজ’ শিয়াদের মুসলিম হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশ্বে শিয়া-সুন্নি বিয়ে অসংখ্য, এ নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।

৩) জামায়াত আমির বলেছেন রাষ্ট্রে সব ট্যাক্সের মূল ভিত্তি হবে যাকাত এবং রাষ্ট্র সব ধর্মের নাগরিককে প্রতিপালন করতে বাধ্য। কিন্তু তিনি তা পারবেন না কারণ শারিয়া আইনে যাকাতের টাকা অমুসলিমদের জন্য অবৈধ! উনি এই শারিয়া আইন সংস্কার করবেন কি না ওই প্রশ্ন উঠবে।

মূল প্রশ্ন: কোরআন ও রাসূলের সব হুকুম কি চিরকালীন? সূরা হুজরাত (আয়াত ২) ও আহযাব (আয়াত ৫৩)-এর হুকুম—নবীর সামনে উচ্চস্বরে কথা না বলা, অনুমতি ছাড়া নবীর গৃহে প্রবেশ না করা, খাওয়ার পর চলে যাওয়া, কথায় মশগুল না হওয়া, নবীপত্নীদের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাওয়া এবং নবীর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীদের বিয়ে নিষিদ্ধ। এটা এখন কেউ মানতে পারবে না, কারণ এই হুকুমগুলো চিরকালীন নয়। তাই আয়াতের পটভূমি না বুঝলে অনেক ক্ষেত্রে বিপদে পড়তে হবে, যেমন, সূরা বাকারা (আয়াত ২২৩)। অথচ সুনান আবু দাউদ (হাদিস ২১৫৯) ও দশম শতাব্দীর ইমাম ওয়াহিদির ‘আসবাব-উল নুজুল’ বইয়ে (পৃষ্ঠা ২২) ওই আয়াতটা কি চমৎকারভাবে মক্কা ও মদিনার সাংঘর্ষিক যৌন সংস্কৃতির সমাধান দিয়েছিল। কোনো আয়াত যে পরিস্থিতির জন্য নাযিল হয়েছিল, তা প্রয়োগের সময় ওই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কিনা ভাবতে হবে। এজন্য বিশ্ব মুসলিমরা ইসলামী বিধানে পরিবর্তন এনেছেন। উদাহরণ:

ক) নবীজি (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়

আমরা জানি মুতা বিয়ে বৈধ ছিল, খাইবার যুদ্ধের পর নবীজি (সা.) তা অবৈধ ঘোষণা করেন। প্রাক ইসলামিক যুগে একসাথে দুই বোনকে বিয়ের প্রথা অনেক কাল ধরে বৈধ ছিল, কিন্তু সূরা নিসা (আয়াত ২৩) তা নিষিদ্ধ করে।

“পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে নবী (সা.)-এর সময়েই কোরান ও সুন্নাহ-তে কিছু সম্পূর্ণ ও কিছু আংশিক পরিবর্তন করা হয়”— ‘প্রিন্সিপলস অব ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স’, ড. হাশিম কামালি (পৃষ্ঠা ২০৩)।

“বিভিন্ন নবী-রাসূলের বেহেশতী কেতাবে ইবাদতের পদ্ধতি, হালাল-হারামের বিধান ও সামাজিক আইনগুলির বিস্তারিত কাঠামো বিভিন্ন–কারণ আল্লাহ বিভিন্ন জাতির জন্য বিভিন্ন যুগে ও বিভিন্ন অবস্থা অনুযায়ী বিধিবিধান নির্ধারণ করেন”— সুরা মায়েদা (আয়াত ৪৮)-এর ব্যাখ্যা, তাফহিমুল কুরান, মাওলানা মওদুদী। কিন্তু এই পরিবর্তনগুলোরও একটা প্যাটার্ন আছে, যা আমরা পরে দেখব।

১. মৃত্যুকালে নবীজি (সা.) পরবর্তী নেতৃত্ব ঘোষণা করে যাননি, ওটা নবীর সুন্নত। কিন্তু মৃত্যুকালে আবুবকর (রা.) এই পদ্ধতি অনুসরণ না করে ওমর (রা.) কে খলিফা বানিয়ে যান, মৃত্যুকালে ওমর (রা) আগের দুই পদ্ধতির কোনোটাই না মেনে ছয়জনের কমিটি বানিয়েছিলেন তাঁদের ভেতর থেকে খলিফা ঠিক করতে। দুই ক্ষেত্রেই সামাজিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রোধ হয়েছে, সমাজকল্যাণ হয়েছে।

২. নবী (সা.) মুয়ালাফা গোত্রকে যাকাত দিতেন, হযরত ওমর (রা.) তা বন্ধ করেন (কামালী, পৃষ্ঠা ২০৩)।

৩. দুর্ভিক্ষের সময় হযরত ওমর (রা.) চোরের হাত কাটা বন্ধ করেন, যদিও সূরা মায়েদা (আয়াত ৩৮) এর কোনো শর্ত নেই (কামালী, পৃষ্ঠা ৩২৫)।

৪. মুসলিম পুরুষ ইহুদি-খ্রিস্টান নারীকে বিয়ে করতে পারে, কিন্তু ওমর (রা:) বিশেষ ক্ষেত্রে সেটা নিষিদ্ধ করেছেন (কামালী, পৃষ্ঠা ৩২৫)।

৫. মদ্যপান ইসলামে হারাম, তবে কোরআনে এর শাস্তির কথা নেই। রাসূল (সা.) এবং আবু বকর (র.) শাস্তি দিয়েছেন ৪০ বেত্রাঘাত, কিন্তু ওমর (র.) সেটা ৮০ করেন (আবু দাউদ, হাদিস ৪৪৬৬)।

৬. নবীজির (স.) সময়কালের তামাত্তু হজ্জের পদ্ধতি বদল করেছেন হযরত ওসমান (র.) (বুখারি ২য় খণ্ড, হাদিস ৬৩৪)।

৭. হযরত ওমর (রা.) কিছু ব্যক্তি, গোত্র ও যাজকদের কাছ থেকে জিজিয়া আদায় বন্ধ করেন (মুহিউদ্দিন খানের বাংলা কুরআন, পৃষ্ঠা ৫৬৭)।

“খোলাফায়ে রাশেদীন যখন দেখেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) যে উদ্দেশ্যে একটি কাজ করেছেন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই কাজ মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূল হবে না তখন তাঁরা বিপরীত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন...ইমাম ইবনে কুদামা বলেছেন, উভয়ে সেটাই করেছেন যা তাঁদের সময়ে উপযুক্ত মনে হয়েছে।”

“রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কোনো কোনো কাজ সুন্নাহর অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীদের জন্য তা বাধ্যতামূলক নয়।” সূত্র: আধুনিক যুগ: ইসলাম কৌশল ও কর্মসূচি, ড. ইউসুফ কারযাভী, পৃষ্ঠা ৭৫। বইটা জামাত এবং শিবিরের ওয়েবসাইটেও পাওয়া যায়।

এই পরিবর্তনগুলো সবই দুনিয়াবি অর্থাৎ সমাজ ও শাসন ব্যবস্থার সাথে জড়িত, ইসলামের ঈমান, আকিদা, ইবাদত, আখলাক ইত্যাদি আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো চিরকাল একই আছে এবং থাকবে।

খ) খোলাফায়ে রাশেদীনের পর খিলাফতে ও বর্তমানে

১. হানাফি আইনে খুনের প্রমাণে কমপক্ষে দুজন মুসলিম পুরুষের চাক্ষুস সাক্ষ্য লাগে। প্রায় তিনশ বছর পর স্পেনের ইমাম ইবনে হাযম ওই আইনে প্রতি পুরুষের বদলে দুজন মুসলিম নারীর সাক্ষ্য যোগ করেন (বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৮৮)।

২. আগে অমুসলিমদেরকে বিচারের জন্য শারিয়া কোর্টে আসতে হতো। ১৪শ শতাব্দীতে উসমানিয়া খলিফার ‘মিল্লেত সিস্টেম’ (MILLET SYSTEM) এর মাধ্যমে তাদেরকে নিজেদের আদালতে নিজস্ব আইন অনুযায়ী বিচার করার অনুমতি দেন। এটা একটা বড় পরিবর্তন।

৩. ১৮৩৯-১৮৬৯ সালে উসমানিয়া খলিফারা মুরতাদের মৃত্যুদণ্ড, দাসপ্রথা, জিজিয়া কর বাতিল ও অমুসলিমদের সেনাবাহিনীতে চাকরির অধিকার প্রদান করেন।

৪. সুরা নিসার আয়াত ১১ অনুযায়ী, মেয়েরা ছেলেদের অর্ধেক উত্তরাধিকার পায়। কিন্তু এখন ৯৬ শতাংশ মুসলিমের দেশ তাজিকিস্তান ও ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশ তুরস্কে পুত্র-কন্যার উত্তরাধিকার সমান!

৫. তিউনিসিয়ায় বহুবিবাহ নিষিদ্ধ, মরক্কোতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, পাকিস্তানে প্রথম স্ত্রীর সম্মতি বাধ্যতামূলক।

৬. মিশরের আইনে স্ত্রীরা মোহর ফেরত দিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে যা শারিয়ার ‘খুলা’ আইনের পরিপন্থী।

৭. নতুন সৌদি আইনে নারীরা মাহরাম ছাড়া হজ/ওমরাহ করতে পারেন।

৮. মিশরের দারুল ইফতা ফতোয়া অনুযায়ী, নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে নারীরা মাহরাম ছাড়া ভ্রমণ করতে পারেন।

৯. মুখ ঢাকা নিকাব ৯৬ শতাংশ মুসলিমের দেশ তাজিকিস্তানসহ কিছু মুসলিম দেশে আইনত নিষিদ্ধ।

১০. এখন বেশিরভাগ মুসলিম দেশে চোরের হাত কাটা হয় না যদিও ওটা কোরানের হুকুম (মায়েদা ৩৮)।

শেষ করছি জামায়াতের আমিরকে তাদের সর্বোচ্চ নেতার বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে— “একসময় মুসলিমদের কলম ও তলোয়ার দুনিয়ায় শাসন করত। কিন্তু তাদের পতন হলো, কারণ তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে শারিয়াকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি।”— ‘দ্য সিক নেশনস অব দ্য মডার্ন এজ’, মাওলানা মওদুদী, পৃষ্ঠা ৮ ও ১২)। অর্থাৎ, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শারিয়াকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। বিশ্ব মুসলিমদের দুনিয়াবি সাফল্য এই সূত্রের ওপর নির্ভর করে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews