বাংলা সিনেমার ইতিহাসে ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ একটি উজ্জ্বল নাম। ‘শোষণের মঞ্চে জীবনের জয়গান’- এই ছিল সিনেমার মূল প্রতিপাদ্য। ফলে, সময়ের অবগাহনেও এ সিনেমার আবেদন ফুরিয়ে যায়নি আজও।

সাহিত্যিক আবু ইসহাকের উপন্যাস ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ অবলম্বনে সিনেমাটি যৌথভাবে নির্মাণ করেন শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকের। ১৯৭৭ সালে সিনেমাটির শুটিং শুরু হয়। তিন বছর নির্মাণযজ্ঞ শেষে ১৯৭৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর এটি মুক্তি পায়। পরে বাংলাদেশি সিনেমার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে চিহ্নিত হয়।

‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’-সুকান্ত ভট্টাচার্যের চরণ দু’খানির এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’। একটি চিত্রনাট্য তখনই শ্রেষ্ঠ হয় যখন তা সমাজের অসুখগুলোকে স্বার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে সিনেমার পর্দায়। এটি সেরকমই এক সিনেমা, যা তৎকালীন সময়ের অর্থনৈতিক ভঙ্গুর অবস্থা এবং অভাব-অনটনে ভুগতে থাকা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা পর্দায় তুলে ধরে।

ক্ষুধার যন্ত্রণা কোনো আইন মানে না, চেনে না কোনো ধর্মজাতের হিসাবনিকাশ, মানুষকে টেনে নিয়ে আসে বাস্তবতার এক কঠিন কর্মযজ্ঞের দরজায়। কুসংস্কার, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ও ক্ষমতাশীল ধনি শ্রেণির শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট এক নারীর জীবন সংগ্রামের অনবদ্য দলিল ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’।

‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ বাংলাদেশের প্রথম সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত সিনেমা। আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সিনেমাটি শিল্প হিসাবে নন্দিত এবং সাফল্য অর্জন করতে পারলেও ব্যবসায়িকভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে। সমকালীন বাণিজ্যিক সিনেমার বিপরীতে এ সিনেমা ‘আর্ট ফিল্ম’ হিসাবে চিহ্নিত হয়। প্রথম অনুদানপ্রাপ্ত সিনেমার পথ ধরে পরবর্তী সময়ে প্রায় সব অনুদানপ্রাপ্ত সিনেমাই ব্যবসায়িক ব্যর্থতার উদাহরণ স্থাপন করেছে এবং হয়তো এ ধারাবাহিকতাই অনুদানের সিনেমার প্রতি দর্শকশ্রেণির ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আরও দৃঢ় হতে সাহায্য করেছে। অনুদানের সিনেমার পরিণতি যাই হোক না কেন, এ ধরনের সিনেমার মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার যে প্রবণতা তার জন্য বোধহয় ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ একটি উদাহরণ হতে পারে।

দেশে বিদেশে একাধিক উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বই শুধু করেনি এটি, পুরস্কারও জয় করে এনেছে। সিনেমাটি আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। শেখ নিয়ামত আলী শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার অর্জন করেন। অনবদ্য অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান ডলি আনোয়ার।

১৯৮০ সালে সিনেমাটি জার্মানির ম্যানহেইম চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়ে তিনটি পুরস্কার লাভ করে। পর্তুগালের ফিগুএরা দা ফোজ চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ডন কিজোট’ বিভাগে পুরস্কার জিতেছিল এ সিনেমা। মোট ছয়টি বিভাগে বাচসাস পুরস্কারও লাভ করেছিল এটি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন দুর্ভিক্ষ ও অবিভক্ত ভারতের বাংলায় অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর নির্মম শোষণের গল্প নির্মাতা এ সিনেমায় তুলে ধরেছেন। ১৩২ মিনিটের ব্যাপ্তির এ সিনেমাটি দেখতে বসলে এক মুহূর্তের জন্যও দর্শকদের মনোযোগ হারাতে হয় না। সিনেমার প্রধান চরিত্র জয়গুন। যে কিনা আমাদের চারপাশে অহর্নিশ সংগ্রাম করে যাওয়া পরিচিত এক নারী। স্বামী পরিত্যক্তা বাস্তুহারা জয়গুন যতটা খিটখিটে মেজাজে সংসার আগলে রাখে, ততটাই আগলে রাখে পড়শীর দস্যি চোখ থেকে নিজের সম্ভ্রম। গ্রামের ধর্মান্ধ মানুষের ভ্রুকুটি এড়িয়ে অটুট দৃঢ়তায় যে নারী এ অঞ্চলের চাল ও অঞ্চলে ফেরি করে বেড়ায়, তা দেখে তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথানত হয়ে আসে। মমতায় চোখ ভিজে ওঠে।

সময়ের পরিক্রমায় জয়গুনের একমাত্র মেয়ে মায়মুনের জীবনের পথের বাঁকও তার জীবনের মতো ধূলিময় হয়ে দেখা দেয়। সেখানে থাকে না কোনো মমতার পরশ, ফোটে না কোনো নরম মাটির ফুল। সুদিনের স্বপ্ন দেখাটা যেন সাংঘাতিক অপরাধ! মায়মুনের বিয়ের দিনে জয়গুনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তওবা পড়ে অঝোরে কান্না করার দৃশ্যটা বস্তুত দর্শকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা এখনো নিছক হাতের পুতুল। পুরুষের যেমন ইচ্ছা, সেভাবেই তাদের ব্যবহার করে।

জয়গুন চরিত্রে অভিনয় করেন ডলি আনোয়ার। যদিও এ চরিত্রের জন্য প্রথমেই প্রস্তাব করা হয়েছিল প্রখ্যাত অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারকে। তবে তিনি পারিবারিক সমস্যার কারণে সে সময় বিনয়ের সঙ্গে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। পরে জয়গুনের চরিত্রে ডলি আনোয়ারকে নেওয়া হয়েছিল।

সিনেমাতে এ চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করে প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও অর্জন করেন ডলি আনোয়ার। এ সিনেমার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন করিম বকশ চরিত্রে কেরামত মাওলা, গদু প্রধানের চরিত্রে জহিরুল হক, ভাইয়ের স্ত্রী শফির মা চরিত্রে ছিলেন রওশন জামিল, ফকির চরিত্রে এটিএম শামসুজ্জামান।

এ ছাড়া আরো অভিনয় করেন আরিফুল হক, ইলোরা গহর, হাসান ইমাম, ফখরুল হাসান বৈরাগী, নাজমুল হুদা বাচ্চু, লেনিন প্রমুখ। সিনেমাটির প্রযোজক ছিলেন মসিহউদ্দিন শাকের। সংলাপও তার তৈরি। সংগীত পরিচালক ছিলেন আলাউদ্দিন আলী।

মসিহউদ্দিন শাকের

১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন মসিহউদ্দিন শাকের। আজিমপুর ওয়েস্টার্ন বিদ্যালয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হন। ১৯৭৫ সালে ফিল্ম সোসাইটির একটি পত্রিকায় লিখতেন তিনি, সেই পত্রিকার সদস্য ছিলেন আরেক পরিচালক শেখ নিয়ামত আলী। সেখান থেকে তাদের মধ্যে পরিচয় হয়। ১৯৭৯ সালে সরকারি অনুদান নিয়ে তারা যৌথভাবে নির্মাণ করেন সূর্য দীঘল বাড়ী। এ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে দুজন নির্মাতা যুগ্মভাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

শেখ নিয়ামত আলী

১৯৪০ সালের ৩০ এপ্রিল ভারতের চব্বিশ পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ নিয়ামত আলী। তবে তার পৈতৃক বাড়ি খুলনার বাগেরহাটে। ২০০৩ সালের ২৪ নভেম্বর তিনি মারা যান। সুস্থধারার সিনেমায় তার অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি একাধারে চিত্রপরিচালক, চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী, কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার ছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনেও তার রয়েছে বিশেষ অবদান। তার নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’। এটি দেশে বিদেশে বিশেষভাবে প্রশংসিত এবং পুরস্কৃত হয়েছিল। পাশাপাশি বাংলাদেশের সুস্থধারার সিনেমার মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews