একটি শান্তিময় ও সম্প্রীতির সমাজ গড়তে হলে অন্যায় ও অপরাধকে দমন করার বিকল্প নেই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই একজন মুমিনের কর্তব্য। বিখ্যাত দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন, ‘সমাজে অন্যায় তখনই বিস্তার লাভ করে যখন সৎ লোকেরা নীরব থাকে।’ ঠিক তাই, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে অন্যায়কারীরা আরো বেশি অপরাধ করে।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, মানুষের কল্যাণে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজে বাধা প্রদান করবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১১০)।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো ইরশাদ করেন, ‘আর অন্যায়ের প্রতিশোধ অন্যায় অনুপাতে হয়ে থাকে। কিন্তু (অন্যায়কারীকে) শোধরানোর উদ্দেশ্যে যে ক্ষমা করে তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে রয়েছে। নিশ্চয় তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না’ (সুরা আশ শূরা, আয়াত: ৪০)। ইসলামে শাস্তির বিধান অবশ্যই রয়েছে কিন্তু পাশাপাশি ক্ষমা এবং মার্জনার নির্দেশও রয়েছে।

আর আমরা দেখতে পাই, মদিনায় শাসনকালে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তারপর খলিফারা পবিত্র কুরআনের নির্দেশের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে এর শিক্ষা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। একজন অপরাধীকে কতটা শাস্তি দেয়া উচিত আর কোন অপরাধীকে ক্ষমা করলে তার সংশোধন হবে অর্থাৎ শোধরানোর উদ্দেশ্যে, তা যাচাই করে ক্ষমা করেছেন এবং শাস্তি দিয়েছেন।

হজরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুুল করিম (সা.) বলেছেন, সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! নিশ্চয়ই তোমরা সৎকাজের জন্য আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করবে। তা না হলে আল্লাহতায়ালা শিগগিরই তোমাদের ওপর তার শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। তোমরা তখন তার নিকট দোয়া করলেও তিনি তোমাদের সেই দোয়া গ্রহণ করবেন না। (তিরমিজি)

ইসলামে পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর মত বাড়াবাড়ি নেই। এর সুমহান দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই মহানবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায়। তিনি (সা.) যখন দেখেন, অপরাধীর সংশোধন হয়ে গেছে তখন চরম শত্রুকেও তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন।

বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর, তার (সা.) সন্তান-সন্ততির ওপর এবং তার (সা.) সাহাবিদের ওপর হেন কোন অন্যায় বা অত্যাচার নেই যা করা হয় নি কিন্তু শত্রু যখন ক্ষমার প্রত্যাশী হয়ে ক্ষমা কামনা করেছে তখন বিশ্বনবি, মানবতার নবি ও সম্প্রীতির নবি হজরত মোহাম্মদ (সা.) সবকিছু ভুলে গিয়ে তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন।

এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মক্কা থেকে হিজরতের সময় বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবির (সা.) আদরের কন্যা হজরত যয়নবের ওপর এক পাষণ্ড হাব্বার বিন আসাদ বর্শা দিয়ে প্রাণঘাতি আক্রমণ করে। তিনি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। সেই হামলার কারণে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন এবং তার গর্ভপাত ঘটে। অবশেষে এই আঘাত তার জন্য প্রাণহারী কারণে পরিণত হয়। এ অপরাধে এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যার রায় প্রদান করা হয়।

মক্কা বিজয়ের সময় এই ব্যক্তি কোথাও পালিয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে মহানবি (সা.) যখন মদিনায় ফিরে আসেন তখন হাব্বার মদিনায় মহানবির (সা.) সকাশে উপস্থিত হয়ে বলে, আপনার ভয়ে আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম। আমার বড় বড় অপরাধ রয়েছে আর আপনি আমাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। কিন্তু আপনার দয়া এবং মার্জনার খবর আমাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে। যদিও আপনি আমার বিরুদ্ধে শাস্তির রায় দিয়েছেন কিন্তু আপনার ক্ষমা এবং মার্জনা এত ব্যাপক যে, এর ফলে আমার মাঝে এই সাহস সৃষ্টি হয়েছে আর আমি আপনার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। আরও বলতে লাগলেন, হে আল্লাহর নবি! আমরা অজ্ঞতা এবং শিরকে নিমজ্জিত ছিলাম, আল্লাহতায়ালা আমাদের জাতিকে আপনার মাধ্যমে হেদায়াত দিয়েছেন এবং ধ্বংস থেকে রক্ষা করেছেন। আমি আমার সীমালঙ্ঘন এবং অপরাধ স্বীকার করছি, আপনি আমার অজ্ঞতা উপেক্ষা করুন। এতে মহানবি (সা.) তাকেও ক্ষমা করেন এবং বলেন, যাও হাব্বার! তোমার ওপর আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ হয়েছে, তিনি তোমাকে ইসলাম গ্রহণের এবং সত্যিকার তওবা বা অনুশোচনা করার তৌফিক দিয়েছেন।’

(আল মাজুমুল কাবির লিল তিবরানী, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৪৩১, মুসনাদ আন নিসায়ে যিকরে সুনানে জয়নাব, হাদিস: ১০৫১, আল সিরাতুল হালবিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৩১-১৩২, বৈরুত-২০০২)।

অনুরূপভাবে আরেকটি হাদিসে বর্ণিত আছে, একজন কবি যার নাম ছিল কা’ব বিন জহির। সে মুসলমান নারীদের সম্পর্কে অত্যন্ত নোংরা ভাষায় কবিতা লিখতো, তাদের সম্ভ্রমে হামলা করতো। তার বিরুদ্ধেও শাস্তির সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছিল। যখন মক্কা বিজয় হয় তখন কাবের ভাই তাকে পত্র লিখে, মক্কা বিজয় হয়ে গেছে, তোমার জন্য ভালো হবে মহানবির (সা.) কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়া। সে মদিনায় এসে পরিচিত এক ব্যক্তির ঘরে অবস্থান করে আর মসজিদে নববিতে গিয়ে মহানবির (সা.) সাথে ফজরের নামাজ পড়ে।

এরপর নিজের পরিচয় না দিয়েই সে বলে, হে আল্লাহর রাসুল! কাব বিন জহির অনুশোচনার সাথে ফিরে এসেছে এবং ক্ষমা চাচ্ছে, যদি অনুমতি থাকে তাহলে তাকে আপনার সকাশে উপস্থিত করা যেতে পারে। তিনি (সা.) যেহেতু তার চেহারা সম্পর্কে জানতেন না, তাকে চিনতেন না বা হতে পারে সে ব্যক্তি মুখ ঢেকে রেখেছিল যার ফলে অন্যান্য সাহাবিরাও চিন্তে পারেনি, তাই তিনি (সা.) বলেন যে, হ্যাঁ, সে আসতে পারে। তখন সেই ব্যক্তি বলে, আমিই কাব বিন জহির।

তখন এক আনসারি তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কেননা, তার অপরাধের কারণে তার বিরুদ্ধেও মৃত্যুর দণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মহানবি (সা.) পরম স্নেহ পরবশ হয়ে বলেন, একে ছেড়ে দাও, কেননা, সে ক্ষমা প্রত্যাশী হয়ে এখানে এসেছে। এরপর সে মহানবির (সা.) সন্নিধানে একটি কাসীদা বা কবিতার অর্ঘ্য পেশ করে। মহানবি (সা.) তার এক দৃষ্টিনন্দন চাদর তখন পুরস্কারস্বরূপ তাকে উপহার দেন।

এই শত্রু, যার বিরুদ্ধে মৃত্যু দণ্ডাদেশ জারি করা হয়েছিল, তার দরবার থেকে শুধু প্রাণ ভিক্ষা নিয়েই ফিরেনি বরং পুরস্কার সহকারে ফিরে গিয়েছে। এমন আরো অনেক ঘটনা মানবতার নবি ও দয়ার সাগর নবি শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে দেখা যায়।

যা থেকে স্পষ্ট হয়, সংশোধনের পর তিনি (সা.) তার ব্যক্তিগত শত্রুদেরও ক্ষমা করেছেন, তার নিকটাত্মীয়ের যারা শত্রু ছিল তাদেরকেও ক্ষমা করেছেন এবং ইসলামের শত্রুদেরও ক্ষমা করে দিয়েছেন। কিন্তু যেখানে সংশোধনের জন্য শাস্তি দেয়ার প্রয়োজন ছিল সেখানে তিনি শাস্তিও দিয়েছেন।

আমাদের চোখের সামনে কোনো অন্যায় কাজ দেখলে আমরা যদি তা প্রতিরোধ না করি সেক্ষেত্রে আমরাও আল্লাহপাকের কাছে শাস্তির সম্মুখীন হবো। হাদিসে এসেছে হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)কে বলতে শুনেছি, ‘যদি মানুষ কোনো মন্দ কাজ দেখে এবং তা প্রতিরোধ না করে, তবে আল্লাহ শিগ্‌গির তাদের সবাইকে শাস্তির সম্মুখীন করবেন।’ (তিরমিজি : ২১৬৮)।

আল্লাহতায়ালা যেখানে শাস্তির কথা বলেছেন সেখানে ধনী-দরিদ্র সবার সাথে সমান ব্যবহারের শিক্ষাও দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা রাব্বুল আলামিন যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘ঠিক ততটাই শাস্তি দাও যতটা অপরাধ করেছে এবং শাস্তি প্রদানের কিছু নিয়ম-নীতি নির্ধারণ কর।’ মহানবি (সা.) ঠিক তাই করেছেন।

আর আমরা দেখতে পাই, মদিনায় শাসনকালে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তারপর খলিফারা পবিত্র কুরআনের নির্দেশের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে এর শিক্ষা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। একজন অপরাধীকে কতটা শাস্তি দেয়া উচিত আর কোন অপরাধীকে ক্ষমা করলে তার সংশোধন হবে অর্থাৎ শোধরানোর উদ্দেশ্যে, তা যাচাই করে ক্ষমা করেছেন এবং শাস্তি দিয়েছেন।

আমরা যদি সমাজ ও দেশে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ দেখতে চাই আর বিশ্বের সব নৈরাজ্য দূর করতে চাই তাহলে পবিত্র কুরআনের শিক্ষার ওপর আমলের বিকল্প নেই।

আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ও শ্রেষ্ঠনবির (সা.) অতুলনীয় আদর্শ অনুসরণ এবং নিজ জীবনে তা বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]

এইচআর/জিকেএস



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews