ময়মনসিংহের মানসুরা এক সন্তানের জননী। স্বামী খলিল সৌদি আরব প্রবাসী শ্রমিক। সংসার ভালোই চলে। আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্য ও অবসর কাটাতে গরু লালন-পালন করেন মানসুরা। গেল বছর ঈদুল আজহার আগে ৯৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন তার লাল গরুটি। নগদ টাকা পেয়ে হাসি ধরে না তার মুখে। স্ত্রীর উৎপাদনমুখী কাজের আগ্রহে স্বামীও খুশি। পাবনার আতিউরের খামারে গেল বছর ২০টি গরু ছিল। সবগুলোই বিক্রি করেছেন তিনি। এবার আছে ৩০টি গরু এবং ভালো লাভের আশাও করছেন তিনি।
মানসুরার মত পরিবারকেন্দ্রিক ছোট ছোট যেসব খামার আছে, তার হিসেব সরকারের কাছে নেই। তবে আতিউরদের মত প্রাতিষ্ঠানিক খামারিদের হিসেব আছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাছে। দপ্তরটির দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় ৩১ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলছে, এ বছর ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৫৪৪টি খামারে ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি কোরবানির পশু প্রস্তুত রয়েছে। প্রাথমিক হিসাবে দেশে এবার ৬৭ হাজার কোটি টাকার কোরবানির পশু বিক্রি হবে।
উৎসবকে সামনে রেখে এভাবেই টাকার লেনদেন বাড়ে, তাতে চাঙ্গা হয় দেশের অর্থনীতি। উৎসবের মাঝে যেমন ঈদ আছে, তেমনি আছে পূজা, বড়দিন কিংবা বুদ্ধ পূর্ণিমার মত প্রধান প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এর বাইরে সার্বজনীন কিছু উৎসব হিসেবে আছে–বাংলা নববর্ষ, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস ইত্যাদি। তবে এসব উৎসবে ঈদের তুলনায় লেনদেন কম হয়। ঈদুল ফিতরে শুধুমাত্র পোশাক কেনাবেচা, গ্রামের বাড়ি কিংবা বিনোদন কেন্দ্রে বেড়াতে যাওয়া বা জাকাত দেওয়াকে কেন্দ্র করে বাড়ে আর্থিক লেনদেন।
ঈদুল আজহায় জাকাত বাদে যুক্ত হয় কোরবানির পশুকেন্দ্রিক এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। গরুর হাট থেকে রেমিটেন্স, মোবাইল ব্যাংকিং থেকে চামড়ার বাজার—ঈদুল আজহা ধর্মীয় উৎসব তো বটেই, সেই সঙ্গে লাখ কোটি টাকার এক বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞও। খামারগুলোতে যেমন গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া ইত্যাদি পশু লালন পালন হয়, তিনি পরিবারকেন্দ্রিক খামারেও হয়। আবার বিদেশ থেকে উট, দুম্বার মত পশুও আমদানি হয়। খামার পরিচালনায় সুযোগ হয় কর্মসংস্থানের। গোখাদ্যকে কেন্দ্র করে হয় শত শত কোটি টাকার ব্যবসা। আছে গরু মোটা তাজাকরণ প্রক্রিয়া। সেখানেও কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে কর্মব্যস্ত খামারি কিংবা কৃষকরা।
এবার পশুগুলোকে কোরবানির হাটে নেওয়ার পালা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানী ঢাকা কিংবা অন্য বড় শহরগুলোতে পশু সরবরাহ হয়। এতে ব্যবহার করা ট্রাক, পিকআপ, ট্রেন কিংবা ট্রলার। পশু পরিবহনে হয় বড় বাণিজ্য। হাট ইজারা নেওয়ায় খরচ হয় কোটি কোটি টাকা। পছন্দের পশু কিনে দিতে হয় নির্ধারিত হাসিল বা কর। সেখানেও আদায় হয় শত শত কোটি টাকা।
এই কেনার মাঝে গেল কয়েক বছরে যুক্ত হয়েছে অনলাইন বেচাকেনা। হাটে যাওয়ার ঝক্কি ঝামেলা এড়াতে অনেকে ঘরে বসেই কিনে ফেলছেন পছন্দের পশুটি। আবার খামার থেকেই সেই পশু জবাই করে মাংস পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও থাকছে। এবার অনলাইনে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি পশু বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানাচ্ছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
পছন্দের পশু বাসায় আনার পর অন্তত এক দুই দিনের খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। শহরাঞ্চলে এই খাবার উচ্চ মূল্যেই কিনতে হয়। এবার পশু জবাই করে মাংস প্রস্তুত করতে প্রয়োজন কসাইয়ের। তার পারিশ্রমিকতো আছেই। আর নিজেরা করলে প্রয়োজন ছুরি, চাপাতি, দা, কুড়াল ও কাঠের টুকরা। গ্রামে হয়তো এই আনুসাঙ্গিক বিষয়গুলোর পেছনে তেমন খরচ হয় না। কিন্তু শহরে খরচ নিতান্ত কম নয়। এগুলো হিসেবে আনলেও শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
কোরবানির পশু জবাই পরবর্তী বড় যে অর্থনৈতিক পণ্য তা হলো চামড়া। ঈদুল আজহায় বিভিন্ন পশুর ৯০ থেকে এক কোটি চামড়া সংগ্রহ করা হয়, যা সারা বছরের চাহিদার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ। প্রাথমিকভাবে চামড়া সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন পড়ে লবণের। এসময় চাহিদা বেড়ে লবণের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়, বাণিজ্য হয় কয়েক শত কোটি টাকা।
চামড়া থেকে বছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি বা ১২ থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকা আয় হয়। আবার স্থানীয় বাজারেও চামড়ার জুতা বেচাকেনা হয়।
মাংস কাটাকুটি শেষে এবার রান্নার পালা। সেখানেও প্রয়োজন মসলার। তাইতো ঈদুল আজহাতে চাহিদা বাড়ে এই পণ্যের। বাণিজ্যের পরিমাণ কম বেশি ৩০০ কোটি টাকা বলে মোহাম্মদ আবদুল মজিদের বই ‘উৎসবের অর্থনীতি’ থেকে জানা যায়। তাহলে দেখা যায়, শুধু কোরবানির পশুকেন্দ্রিক যে অর্থনীতি তা লাখ কোটি টাকার বেশি। অন্যান্য কিছু মিলিয়ে এর পরিমাণ আরও অনেক বেশি।
এর মধ্যে আছে উৎসবকে কেন্দ্র করে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা। আবার ঈদের ছুটির পর কর্মস্থলে ফিরে আসা। এ বাবদও প্রচুর অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগের ফলে অন্য সময়ের তুলনায় ঈদে পরিবহন ভাড়া বাবদ প্রায় দ্বিগুণ টাকা খরচ করতে হয় জনগণকে। এছাড়া উৎসব কেন্দ্রিক অর্থনীতিকে বড় চাঞ্চল্য তৈরি করেন প্রবাসীরা।
কোরবানি পশু কেনাকে কেন্দ্র করে ঈদুল আজহায় কিংবা অন্যান্য কেনাকাটায় ঈদুল ফিতরে পরিবারের জন্য অন্য মাসের তুলনায় বেশি অর্থ পাঠিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গেল বছর জুনে ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে রেমিটেন্স এসেছিল ২৫৩ কোটি ডলার, যা বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এসব বিবেচনায় নিলে উৎসব কেন্দ্রিক অর্থনীতির পরিমাণ বলা মুশকিল। সরকার থেকেও আলাদা ভাবে এর হিসেব করা হয় না। তবে অর্থ লেনদেনে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান দেখে কিছুটা আন্দাজ করা যায়।
গেল বছরের জুনের মাঝামাঝি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঈদুল আজহা। জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে অস্থিশীলতা দেখা দেয়। তাই জুনকে স্বাভাবিক মাস বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, চেক লেনদেনের ক্ষেত্রে রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট তথা আরটিজিএস দিয়ে ওই মাসে (জুন ২০২৪) লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যা মে মাসে ছিল প্রায় ৪ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বেশি ছিল সাড়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
আবার, গেল বছরের জুনে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল প্রায় ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, মে মাসে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এখানে লেনেদেন বেশি ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে এটিএম, পস মেশিন, সিআরএম, ই-কমার্সে জুন মাসে লেনদেন হয়েছিল ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা মে মাসে ছিল ৪৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের মাসের তুলনায় বেশি ছিল ৫ হাজার কোটি টাকা। এই সব তথ্যই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া।
ডিজিটাল মাধ্যম হওয়ায় এসব লেনদেনের হিসেব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আলাদা ভাবে হালনাগাদ থাকে। এর বাইরে নগদ টাকায় বিপুল পরিমাণ লেনদেন হয়। যার হিসাব হালনাগাদ পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ ফিনানসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর হিসেবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে নগদ টাকায় লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ২২ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি।
এ তো গেল ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে একটি ধারণাগত হিসেব। এর বাইরে আছে ঈদুল ফিতর, পূজা, পহেলা বৈশাখ, বড় দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমা, যেগুলোর কথা আগে বলা হয়েছে। এসব উৎসবকে কেন্দ্র করে অর্থের যে লেনদেন তা বিবেচনায় নিলে পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। টাকার অংক যাই হোক বছরের এসব উৎসব আমাদের অর্থনীতিতে প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনে। শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশেও একই ধরনের পরিস্থিতি। যেমন-প্রতিবেশী ভারতে দুর্গা পূজা ও দোল পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে উৎসব, ইউরোপ আমেরিকায় বড় দিনকে কেন্দ্র করে উৎসব।
এসব উৎসবে দেশগুলো বহু পণ্য ও সেবায় ছাড় দেয়। এতে ভোক্তারা উৎসাহী হয়ে তাদের লেনদেনের পরিমাণ বাড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই উৎসবকে কেন্দ্র করে সব কিছুর দাম বা খরচ বেড়ে যায়। বাড়তি এই খরচ নির্দিষ্ট মানুষের আয়ে প্রভাব ফেলে। এ দিকটায় সরকারগুলো নজর দিতে পারলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত কম দামে বেশি পণ্য কিনে অর্থনীতিকে আরো বেশি চাঙ্গা করতে পারতো জনসাধারণ।