বর্ষীয়ান অভিনেতা ও নির্মাতা ফকরুল হাসান বৈরাগী প্রায় ১১ বছর ধরে আড়ালে রয়েছেন—এই অন্তর্ধান ছিল পুরোপুরি স্বেচ্ছায়। বহু বছর পর তার খোঁজ মিলেছে। জানা গেছে, তিনি বর্তমানে ঢাকার পার্শ্ববর্তী কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার এলাকায় সন্তানদের সঙ্গে বসবাস করছেন।

সেখানকার একটি হাউজিং সোসাইটির নয়তলা ভবনের চতুর্থ তলার চার দেয়ালের মধ্যেই কাটছে তার একান্ত দিনগুলো। ১ জুলাই বিকেলে সরেজমিনে সেখানে গিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দীর্ঘসময় কথা হয় এই কিংবদন্তীতুল্য অভিনেতা ও নির্মাতার। তিনি জানান, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বেচ্ছায় নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে অবসরে চলে গেছেন। শুধু তাই নয়, খোলামেলা কথা বলেন নিজের অবসর জীবন, অতীতের পথচলা ও বর্তমান উপলব্ধি নিয়ে-

নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া আর অবসরজীবনের স্বস্তি
বৈরাগী বলেন, “আমার বয়স অনুযায়ী আমি ভালোই আছি। হাঁটুতে জোর কম, চলাফেরায় কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে মাথা ঘোরে, ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলি। ২৫ বছর ধরে ডায়াবেটিস আছে—এসব নিয়েই বেঁচে আছি। ভালোই আছি। মেঝো ছেলের ছেলের সঙ্গে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে।”

তিনি জানান, ২০১৪ সাল থেকে তিনি নিজেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিয়েছেন। “ছাত্রজীবনে অভিনয়ে এসেছিলাম। আগের দিনগুলো এখন আর মনে পড়েনা, চাইও না। যেটা ভালো লেগেছে, সেটাই করেছি। যখন মনে হয়েছে অনেক হয়েছে, তখন সব ছেড়ে দিয়েছি। এখন ইউটিউবে নাটক দেখি, টিভিতে খবর দেখি—এই পর্যন্তই।”

অভিনয় থেকে নির্মাণ— এক দীর্ঘ যাত্রা
১৯৬৫ সালে মঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে শুরু তার পথচলা। স্বাধীনতার আগেই রেডিওতে কাজ করেছেন। এরপর চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক, পরে পরিচালক ও অভিনেতা। “১৯৬৮ সালে শিবলী সাদিকের ভাই খসরু নোমানের হাত ধরে ফিল্মে এসেছি। প্রথম কাজ করি ফতেহ লোহানীর ছবিতে। তিনি বলেছিলেন—তুমি শিগগির পরিচালক হতে পারবে, মন দিয়ে কাজ করো। তার কথায় অনেক বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। আমি অনেক ভাগ্যবান, কারণ দ্রুত এগিয়ে যেতে পেরেছি। নজরুল ইসলাম বাবুর ছবিতে প্রথমে পাঁচ নাম্বার সহকারি থেকে পরের সিনেমায় চিফ সহকারি হই। তারপরেও মুক্তিযুদ্ধে ওই বছর কাজ বন্ধ থাকে। পরে হাসান ঈমামের মাধ্যমে হৃত্বিক ঘটকের সঙ্গে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিতে সহকারি হিসেবে কাজের সুযোগ পাই। এরপর নিজেই ডিরেকশন শুরু করি।

পরিচালক হিসেবে ‘লুটেরা’, ‘মোকাবেলা’, ‘মানসী’, ‘রাজিয়া সুলতানা’, ‘শুধু তোমারই’—সহ বেশকিছু জনপ্রিয় ছবি পরিচালনা করেছেন বৈরাগী। তার নির্মিত অধিকাংশ ছবির গান তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে। শাবানা, রাজ্জাক, ওয়াসিম, রোজিনা, অলিভিয়া প্রমুখ তার পরিচালনায় অভিনয় করে খ্যাতি পান। খান আতাউর রহমানের পর তিনিই ছিলেন এমন একজন যিনি সমানভাবে সফল ছিলেন অভিনেতা ও নির্মাতা হিসেবে।

কথায় কথায় বৈরাগী ফিরে গেলে সেই ৭০-এর দশকে। বললেন, ‘প্রথম শ্বশুর’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলাম শুরুতে। এরপর রেডিওতে অভিনয় করেছি। তৎকালীন নির্দিষ্ট কিছু মানুষ সবখানে ঘুরে ঘুরে কাজ করতো। আমিও তাদের মধ্যে একজন ছিলাম। তখন ন্যাশনাল টিভিতে (বিটিভির পূর্ব নাম) প্রযোজকের সহকারী হিসেবে কাজ করতাম। কাজ করে মজা পেতাম।

পরিচালনায় পাশাপাশি তখন টিভিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করতেন ফকরুল হাসান বৈরাগী। তখন ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ মুক্তির পর মিথ চালু হয়, আর্ট ধারার ছবি হলেও বৈরাগীর ক্যারেক্টার থাকা লাগবে। তিনি বলেন, তখন যারাই ভালো ছবি আমার কাছে এসে বলতো আপনার একটু হলেও অভিনয় লাগবে। এটা কেন কীভাবে হয়েছে আমি জানি না। তখন থেকে আমার অভিনেতা হিসেবে অন্যরকম পরিচিতি আসে। তবে অভিনয় করে মনে হয়েছে, এটা পরিচালনা করার চেয়ে অনেক সহজ। পরিচালনার কাজটি অনেক কঠিন। এটা আসলে সবকিছু গুছিয়ে করতে হয়।

‘ইত্যাদি’র বৈরাগী—জনপ্রিয়তার এক ভিন্ন অধ্যায়
‘ইত্যাদি’র নাটিকা পর্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় আর্টিস্ট বলা হয়ে থাকে বৈরাগীকে। কীভাবে যুক্ত হয়েছিলেন হানিফ সংকেতের ইত্যাদিতে? সেই গল্পও শোনালেন বৈরাগী।

তিনি বলেন, ফতেহ লোহানী বিটিভিতে ‘যদি কিছু মনে না করেন’ নামে একটি অনুষ্ঠান করতেন। সেখানে হানিফ সংকেত সেটার সহকারি ছিল। সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। ফতেহ লোহানীর মৃত্যুর পর শুরু হয় ‘ইত্যাদি’। সেখানে হানিফ আমাকে রাখতে চাইতো। আমাকে দিয়ে যে অংশটা করানো হতো সেটা আমিও ভালোভাবে ক্যামেরায় ডেলিভারি দিতাম। হানিফ আমাকে এই কারণে অনেক পছন্দ করতো। পরবর্তীতে আমি ইত্যাদির জন্য খুব বেশি সময় দিতে না পারলে হানিফ আমাকে খুঁজে গিয়ে বের করতে কাজ করাতো। আমি যেটা করতাম সেটা একটি পজিটিভি বার্তা থাকতো যা মানুষ খুব পছন্দ করতো। এজন্য আমার অন্য ব্যস্ততা থাকলেও কাজ করে মজা পেতাম। অনেক বছর আমি ইত্যাদি করিনা। মানুষ আমাকে খোঁজে আমিও বুঝি, হানিফও আমাকে বলে। কিন্তু আমি যেহেতু অবসরে এসেছি তাই আর কাজে যুক্ত হতে চাই না। যদি ইত্যাদিতে কাজ করি, তাহলে অন্যরাও বলবে তাদের সঙ্গে কাজ করতে। আমি আসলে আর কাজে ফিরতে চাই না।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে উপলব্ধি
জীবনের এই পর্যায়ে এসে বৈরাগীর চোখে নেই কোনো অভিমান, নেই কোনো অতৃপ্তি। বরং অনেক পরিণত উপলব্ধি তার কথায়। “প্রতিটি পেশায় একটা সময় আসে অবসরের। তখন হ্যাসেল, আর্থিক কষ্ট, অসুস্থতা এসব আসে। আল্লাহর রহমতে আমি এখনও ভালো আছি। চাকচিক্য, সৌন্দর্য, শক্তি একসময় কমে যায়। তখন অনেকে ভেঙে পড়ে। আমি আগে থেকেই নিজেকে তৈরি করেছি—যেন সেই সময়গুলোও শান্তিতে কাটে।”

তিনি বলেন, “এখন দোয়ার প্রয়োজন। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কিছু নেই। কোনো আক্ষেপও নেই। আমি নিজের ইচ্ছায় সব ছেড়েছি, তাই ফিরে না যাওয়াই আমার শান্তি।”



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews