মোহাম্মদ শাহজাহান

নিউজ আপলোড : ঢাকা , রোববার, ৩১ জানুয়ারী ২০২১

৩১ জানুয়ারি ছিল দেশ ও জাতির আলোকিত সন্তান, বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি, স্বাধীনতাযুদ্ধে বিরোচিত ভূমিকা পালনকারী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর জন্মদিন। বিচারপতি চৌধুরী ছিলেন যুদ্ধকালীন সরকারের বিদেশের বিশেষ প্রতিনিধি। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরোচিত ও অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেন বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বিকেলে জাতির পিতা স্বদেশে আসেন। ১২ জানুয়ারি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। লন্ডন থেকে বিচারপতি চৌধুরী দেশে ফিরে আসেন ৮ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ওই দিন সকালে লন্ডন পৌঁছেন।

মার্চ মাস বাঙালি জাতির ইতিহাসে যেমন গুরুত্বপূর্ণ মাস, তেমনি আবু সাঈদ চৌধুরীর জীবনেও মাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একাত্তরের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টার পরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। ধানমন্ডির বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ নেতারা চলে যান আত্মগোপনে। বঙ্গবন্ধু জীবিত না মৃত কেউ জানে না। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বিদেশি পত্রিকা ও বেতারে প্রচারিত হলেও আবু সাঈদ বা বাঙালি জাতি তখনও কিছুই জানেন না। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ওই কঠিন দুঃখের সময়ে অনেকটা ত্রাণকর্তার মতোই আবির্ভূত হন বিচারপতি চৌধুরী। বিবিসিতে পাকিস্তানি বর্বরতার কথা শুনে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ১ দিন পর ২৭ মার্চ শনিবার লন্ডনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পাকিস্তান সরকারের সাথে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করে বলেন, ‘আমি পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি জাতির ওপর বর্বর হত্যাকান্ডের কথা বিশ্ববাসীকে জানাবো।’ তিনি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করেন এবং পাকিস্তানি সামরিক চক্র যাতে নবজাত রাষ্ট্রের পিতাকে হত্যা করতে না পারে, এজন্য তিনি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

বিবিসির মাধ্যমে প্রচারিত আবু সাঈদ চৌধুরীর ওই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মানুষকে যেমন সাহস জোগায় তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাঙালিরা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। যুদ্ধকালীন সরকার গঠিত হওয়ার আগেই তিনি লন্ডন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে কাজ করতে শুরু করেন। পাকিস্তানি সামরিক চক্র লন্ডনে আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে। এমনকি তাকে হত্যারও চেষ্টা চালায়। কিন্তু কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করা ভালা-ভোলা নিরীহ বাঙালি সন্তান আবু সাঈদ চৌধুরী যেন রাতারাতি লৌহমানবে পরিণত হয়ে গেলেন। একপর্যায়ে তিনি এমন কথাও বলেন, ‘লন্ডনের রাস্তায় মরে যাবো, তবুও পরাভব স্বীকার করবো না। জয় আমাদের হবেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’ ইতিহাসে একদিন লেখা হবে- বিদেশে বিভিন্ন মতাবলম্বী বাঙালিদের স্বাধীনতার পক্ষে এক কাতারে শামিল করার কঠিন কাজটি আবু সাঈদ চৌধুরীরা ছিলেন বলেই সম্ভব হয়েছিল। আমি ভেবে এখনো আশ্চর্য হয়ে যাই, যিনি সরাসরি রাজনীতিবিদ ছিলেন না, জনপ্রতিনিধিও ছিলেন না, যার কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষও ছিল না- সেই নিরীহ নির্বিবাদী সরল-সোজা মানুষ এবং দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও উচ্চ আদালতের বিচারপতি রাতারাতি কীভাবে একজন বিদ্রোহী জাতীয় বীরে পরিণত হয়ে গেলেন।

একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদান করতে বিচারপতি চৌধুরী জেনেভা গিয়েছিলেন। সেখান থেকে খবর পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তিনি এ সংবাদ পাওয়া মাত্র এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। অথচ ছাত্র হত্যার ব্যাপারে তার কোনো দায় ছিল না। এমনকি তিনি দেশেও ছিলেন না। এভাবে মর্যাদার আসন ছেড়ে দিয়ে প্রতিবাদ করার নজির বিশ্ব ইতিহাসে খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে পদত্যাগপত্রে স্পষ্ট ভাষায় লিখেন- ‘আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম।’

১৫ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদ ছেড়ে দেয়ার ১০ দিনের মাথায় ২৫ মার্চ মধ্য রাতে পাকিস্তান সামরিক জান্তা নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ওই রাতে শুধু ঢাকা শহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়। ২৬ মার্চ সকালে বিবিসির খবরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বর হত্যাকান্ডের ভাসা ভাসা খবর প্রচারিত হয়। বিবিসির খবর শুনে বিচলিত বিচারপতি চৌধুরী মানবাধিকার কমিশনের সভায় উপস্থিত হয়ে ঢাকায় হত্যাকান্ড সম্পর্কিত বিবিসির খবরের কথা জানান। ঢাকায় গণহত্যার খবর শুনে বিচারপতি চৌধুরী ২৭ মার্চ শনিবার পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসে বিশ্ব জনমত গঠনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে সদর দফতর স্থাপন করে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে সমগ্র বিশ্ব ছুটে বেড়িয়ে সম্পন্ন করেছেন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ও তাদের দোসরদের প্রাণনাশের হুমকির মুখে অবিচলিত, শান্ত এই কর্মবীর সাহসের সাথে মাতৃভূমির মুক্তির লক্ষ্যে বিরামহীনভাবে কাজ করে গেছেন।

অসাধারণ গুণাবলীসম্পন্ন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন। টাঙ্গাইলের নাগবারী গ্রামে জমিদার পরিবারে ১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি জন্ম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পিতা আবদুল হামিদ চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের স্পিকার ছিলেন। খুবই মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদ চৌধুরীর পাঠ্যাতিরিক্ত বিষয়েও যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। ১৯৪০ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইতিহাসে এমএ এবং বিএল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি লন্ডনের লিংকনস ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন।

রাষ্ট্রপতি চৌধুরী ১৯৮৭ সালের ২ আগস্ট ইন্তেকাল করেন। আলোকিত মানুষ, অমৃতের সন্তান আবু সাঈদ চৌধুরীর পুণ্যস্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

[লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]

bandhu.ch77@yahoo.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews