ভোরেই আনাস লাপাত্তা। আনাস মানে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শহিদ শাহরিয়ার খান আনাস। সেদিন সূর্য ওঠার আগেই মা-বাবাকে ফাঁকি দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন আনাস। এর আগে ভোরেই মায়ের কাছে একটি চিঠি লিখে পড়ার টেবিলে রেখে যান। তাতে লেখা ছিল, ‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য করে বের হলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না...।’ ৫ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশ গুলি করে আনাসের বুক ঝাঁজরা করে দেয়। আনাস শহিদ হওয়ার পর প্রথম বিশ্ব মা দিবস ছিল রোববার। দিবসটি উপলক্ষ্যে রাজধানীর গেণ্ডারিয়া শহিদ আনাস সড়ক ধরে হাঁটছিলেন যুগান্তরের এই প্রতিবেদক। সন্ধান করছিলেন তাদের বাড়ি। প্রখর রোদে সড়কের দুপাশের দেওয়ালে চোখ পড়তেই দেখা গেল শহিদ আনাসের ছবি, তার লিখা চিঠির ব্যানার-ফ্যাস্টুন। একপর্যায়ে ৯১নং বাসার দ্বিতীয় তলায় উঠতেই কানে ভেসে আসে কান্নার আওয়াজ। পাশের কক্ষে কাঁদছেন শহিদ আনাসের মা সানজিদা খান দীপ্তি। মা তার পাঁজরভাঙা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, বিশ্বাস করুন, আমার আনাস ছাড়া আমি একেবারেই শূন্য। আমার কিছুই ভালো লাগে না। গুলিবিদ্ধ শরীরটা আমাকে প্রতিমুহূর্ত কাঁদায়। আনাস প্রতিবছরই মা দিবসে আমাকে উপহার দিত। আমার জন্য চকলেট, লিপস্টিকসহ নানান ধরনের উপহার নিয়ে আসত। জড়িয়ে ধরে বলত, ‘আম্মা আজ বিশ্ব মা দিবস। আম্মা তুমি আমার দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সম্পদ। কপালে চুমু দিত, জড়িয়ে ধরত।’ বছর ঘুরে সেই দিবস ফিরে এসেছে; কিন্তু আমার আনাস নেই। আমি তাকে অনুভব করি; কিন্তু বাস্তবে ধরতে পারি না, তার স্পর্শ নিতে পারি না।

বাসায় দেখা ও কথা হয় আনাসের বাবা, নানা আর ছোট্ট দুই ভাইয়ের সঙ্গে। মা সানজিদা খান বলছিলেন, আনাস আমার প্রথম সন্তান। সে গর্ভে আসার খবরেই আনন্দে ব্যাকুল হয়েছিলাম। মায়ের অনুভূতি কী, মা হওয়া যে কী আনন্দের, তা বুঝতে পারি। যখন জন্ম নিল, আমি মা বনে গেলাম। সন্তানের নাম রাখা হয় শাহরিয়ার খান আনাস। তখন থেকে আমাকে কেউ আর সানজিদা বলে ডাকে না, সবাই আনাসের মা বলে ডাকতে শুরু করল। কিন্তু এখন আমি শহিদ আনাসের মা। সবাই আমাকে শহিদ আনাসের মা বলে ডাকে। আমার বাপজান যেদিন শহিদ হয়, ওইদিন বিকালে খুনি হাসিনা পালিয়ে যাওয়ায় সবাই আনন্দ-উল্লাস করছিল। কিন্তু আমি গুলিতে শহিদ আমার আনাসকে মিটফোর্ড হাসপাতালে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছিলাম। ওখান থেকে অটোরিকশায় ছেলের লাশ কোলে নিয়ে বাসায় আসি।

বাবার প্রতি আনাসের অগাধ শ্রদ্ধা ছিল বলে জানান মা দীপ্তি। তিনি বলেন, টেবিলে খাবার নিয়ে বসলে বাবার প্লেটে খাবার তুলে দিত আনাস। কখনোই বাবার অবাধ্য হয়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকত। আমাদের ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে পড়ত। ওই সময় ডায়রিতে লিখে রাখত, হাসিনা সরকারের বর্বর হত্যাকাণ্ড। ৪ আগস্ট রাত ২টার দিকে আনাস ব্যাকুল হয়ে ওঠে, বারবার বলছিল তখনই সে (রাত আড়াইটা) বেরিয়ে পড়বে। তাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছিল না। তখন তার বাবা তাকে আশ্বস্ত করেন, সকালে আমরা সবাই ছাত্র-জনতার সঙ্গে যুক্ত হব। মরলে সবাই একসঙ্গে মরব।

পাশে থাকা আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ কথাগুলো শুনে কাঁদছিলেন। কোলে থাকা ছোট্ট শিশু সাফওয়ান খান বাবার চোখের পানি মুছে দিচ্ছিল। এ সময় বাবা কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ওই রাতে হঠাৎই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘণ্টাখানেক ঘুমের পর জেগে দেখি আনাস বাসায় নেই। পড়ার টেবিলে বই চাপা দেওয়া তার লেখা একটা চিঠি পাই। সেই চিঠি পড়ে বুঝতে পারলাম আমার আনাস যুদ্ধে গেছে। আনাসের সঙ্গে রাতেই কথা হয়েছিল, আমরা সবাই একসঙ্গে যাব। কিন্তু আনাস একাই বেরিয়ে পড়ে। মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। কারফিউ চলছে, চারপাশে গোলাগুলির শব্দ। খোঁজ পাচ্ছিলাম না আনাসের। পরে মিটফোর্ড হাসপাতালে আনাসের লাশ পাওয়া যায়। এমন শত শত হত্যাকাণ্ডের জন্য খুনি হাসিনাসহ দায়ীদের প্রকাশ্যে ফাঁসি চাই আমি। সব শহিদকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। খুনিদেরও মৃত্যু হবে প্রকাশ্যে, বলেন আনাসের বাবা।

মা সানজিদা খান বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষ্যে তার ফেসবুক পেজে ‘মা দিবসে-শহীদ মায়ের কথা’ শিরোনামে একটি লেখা পোস্ট করেন। তাতে লিখেছেন, ‘আমার প্রথম সন্তান আনাস/ যাকে পেয়ে আমি প্রথম মা হয়েছি/...তুমি আমাকে মা বানিয়েছ/ আমি তোমাকে চিরকাল ভালোবাসব, কিন্তু আমি তোমাকে আগলে রাখতে পারি নাই/ এদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমার সন্তানের ঘাতক। আনাস আমাকে তুমি মাফ করে দিও বাপ...।’ আনাসের স্মৃতি তার মাকে ঘুমাতে দেয় না। ঘরের দেওয়ালে আনাসের শেষ চিঠি বাঁধানো আছে। পড়ার টেবিলটা পড়ে আছে, শুধু মানুষটা নেই। বই, খাতা, কলম-সবই ঠিকঠাক, দেখা যাচ্ছে, ধরা যাচ্ছে। শুধু আনাসকেই দেখা যাচ্ছে না, ধরা যাচ্ছে না। শহিদ আনাসের পোশাক মা-বাবাকে খুব বেশি কাঁদায়। আর ছোট্ট দুই ভাই সাফওয়ান খান (৫) ও সুফিয়ান খান (২) কী হারিয়েছে, এখনো বুঝে উঠতে পারছে না। তবে সাফওয়ান খান বলছিল, তাকে নিয়ে আনাস খেলা করত। আদর করত। এখন ভাইকে খোঁজে। ভাইয়ের কবরে গিয়ে দোয়া করে।

মা সানজিদা ছেলের ছবি বুকে নিয়ে কাঁদছেন, মাঝেমধ্যে কথা বলছেন। তিনি বলেন, ঘরের অনেক কাজ আনাস করত। সবকিছু গুছিয়ে রাখত। তার দাদিকে জুরাইন কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়েছে। বাবার সঙ্গে প্রায়ই জুরাইন গিয়ে দাদির কবর পরিষ্কার করে, ফুলগাছে পানি দিত। বাবা-ছেলের মধ্যে কথা হতো, বাবা বলতেন তিনি মারা গেলে তাকে যেন মায়ের কবরে দাফন করা হয়। কিন্তু বাবার আগেই চলে গেছে ছেলে। তাই ছেলে আনাসকেই দাফন করা হয়েছে দাদির কবরে।

সানজিদা বলেন, আনাসের জন্ম হয়েছিল ঈদুল ফিতরের দিন। তখন তার বয়স ১৮ বছর ছুঁইছুঁই। সে গেণ্ডারিয়ার আদর্শ একাডেমিতে বিজ্ঞান বিভাগে দশম শ্রেণিতে পড়ত। শাহারিয়ার ছাত্র হিসাবে বেশ ভালো ছিল। সে প্রকৌশলী হতে চেয়েছিল। খুব মেধাবী ছাত্র ছিল। স্কুলের শিক্ষক, সহপাঠী-সবাই তার জন্য দোয়া করেন। তার সিটে গোলাপ রেখে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানান। আনাস তার শেষ চিঠিতে লিখেছিল, ‘একদিন তো মরতে হবেই। তাই মৃত্যুর ভয় করে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যুও অধিক শ্রেয়। যে অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয়, সেই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো।’ সানজিদা বললেন, আমাকে শহিদ আনাসের মা হিসাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে গিয়ে আজও শুনি ‘আনাস, সাঈদ, মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ।’ আমাদের যুদ্ধটা কবে শেষ হবে, প্রশ্ন রাখেন সানজিদা।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews