রাজশাহীর সুমিষ্ট আমের খ্যাতি রয়েছে বিশ্বজুড়ে। স্বাদে আর ঘ্রাণে অতুলনীয় এ অঞ্চলের আমের চাহিদা ব্যাপক। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন এ আম বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকায় রপ্তানি হয়েছে। এ বছর চীনেও যাচ্ছে দেশের আম। এ অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ু আম চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। এ কারণে মাত্র এক যুগের ব্যবধানে বাণিজ্যিকভাবে আমের চাষ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ‘ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার’ অনুযায়ী ১৫ মে থেকে রাজশাহী অঞ্চলে শুরু হয়েছে গুটি জাতের আম পাড়া।
অন্য জাতের আম পাড়া আরও কয়েক দিনের মধ্যে শুরু হবে। আম পাড়া এবং বাজারজাতকরণে চাষিরা ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকাররা মোকামগুলো আসতে শুরু করেছেন। বৃহত্তর রাজশাহীর চার জেলায় চলতি মৌসুমে সব মিলিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজশাহীতে মৌসুমের শুরুতে এবার এক হাজার তিনশ থেকে দেড় হাজার টাকা মন দরে বিক্রি হচ্ছে গুটি জাতের আম। কৃষকদের আশা, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার আমের উৎপাদন বেশি হবে। দামও পাবেন বেশ ভালো। শুধু রাজশাহী জেলায় এক হাজার ছয়শ কোটি টাকার আম বাণিজ্যের আশা করা হচ্ছে। রাজশাহী জেলা প্রশাসনের ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, এবার ২২ মে থেকে গোপালভোগ আম সংগ্রহ করা যাবে। ২৫ মে থেকে লকনা, লক্ষণভোগ ও রাণীপছন্দ আম পাড়া হবে। এছাড়া হিমসাগর ৩০ মে, ল্যাংড়া ও বানানা ম্যাংগো ১০ জুন, আম্রপালি ও ফজলি আম ১৫ জুন সংগ্রহের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, বৃহত্তর রাজশাহীতে যে পরিমাণ আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তার বাজারমূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে আমকে কেন্দ্র করে উৎসব শুরু হয়েছে। আমপাড়া, বাজারজাত এবং কুরিয়ারসহ নানা কর্মকাণ্ডে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
রাজশাহীর আটটি উপজেলার মধ্যে আম উৎপাদনে শীর্ষে বাঘা। এই উপজেলাতেই জেলার এক-তৃতীয়াংশ আম উৎপাদন হয়। গেল বছর এই উপজেলা থেকে ১০টি দেশে ৩৬ টন আম রপ্তানি করা হয়েছে।
বাঘার আড়ানি এলাকার আমচাষি মকবুল হোসেন বলেন, বাঘার আম অত্যন্ত সুস্বাদু। এ আমের ভিন্ন একটি ঘ্রাণ রয়েছে। গত বছর আমি ৫০ মন আম রপ্তানি করেছি। সুযোগ পেলে এ বছর আরও বেশি রপ্তানি করব। এ উপজেলার আম রপ্তানি আরও বাড়বে বলে আমি আশাবাদী। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, এবার সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত হওয়ায় গাছে প্রচুর আম রয়েছে। বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রাজশাহীর উপপরিচালক উম্মে সালমা বলেন, জেলায় এ বছর ১৯ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ২ লাখ ৬০ টন। আশ করছি, চাষিরা এবার আমের ফলন ভালো পাবেন।
বরেন্দ্র অঞ্চল খ্যাত নওগাঁয় গত কয়েক বছরের তুলনায় আমচাষ বেড়েছে। এ জেলায় কয়েক বছরে অসংখ্য নতুন বাগান হয়েছে। ২২ মে থেকে বাজারে আসবে এ জেলার আম। চাষিরা বলছেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় গেল কয়েক বছরের তুলনায় এবার আমের ফলন হবে দ্বিগুণ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, নওগাঁর উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, এ বছর জেলায় ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের আমচাষ হয়েছে। এ পরিমাণ জমিতে ৩ লাখ ৬৬ হাজার টন আমের উৎপাদন আশা করা হচ্ছে। এ হিসাবে এ বছর নওগাঁ থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার আম বাণিজ্যের সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শেষ মুহূর্তের পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছেন আম বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। জেলায় এ বছর প্রায় চার লাখ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এ হিসাবে পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকার আম বাণিজ্যের আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপপরিচালক ড. ইয়াছিন আলী জানান, জেলায় ৩৭ হাজার ৫০৪ হেক্টর জমিতে নানা জাতের আমচাষ হয়েছে। চলতি বছর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ২৯২ টন। আধুনিক পদ্ধতি এবং বাণিজ্যিকভাবে আমচাষে নতুন নতুন উদ্যোক্তা আসায় গত ১০ বছরে প্রায় ১৩ হাজার ২৪৪ হেক্টর জমিতে আমচাষ বেড়েছে।
জেলার আম গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোখলেসুর রহমান জানান, ভৌগোলিক উৎপত্তিস্থল এবং সুস্বাদু আমের জন্য এ জেলা প্রসিদ্ধ। তাই বরাবরই এ জেলার চাষিরা আমের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবছর প্রায় তিন থেকে চার লাখ টন আম দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যকভাবে সরবরাহ করেন। এছাড়া কয়েক বছর ধরে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে জেলার আম।
অপরদিকে নাটোরে ১৫ মে থেকে গুটি আমপাড়া শুরু করেছেন চাষি ও বাগান মালিকরা। চলতি মৌসুমে নাটোরে পাঁচ হাজার ৬৯৩ হেক্টর জমিতে আমচাষ হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকার আম বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, নাটোরের উপপরিচালক হাবিবুল ইসলাম খান বলেন, চলতি মৌসুমে আমের ফলন ভালো হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে চাষি ও বাগান মালিকরা লাভবান হবেন।
ইউরোপ-আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানির পর বৃহত্তর রাজশাহীর আম এবার যাবে চীনেও। গত বছর শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকেই এশিয়ার ১১টি দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি এবং ইউরোপের সাতটি দেশে আম রপ্তানি করা হয়েছে। এ বছর চীনেও যাবে এ জেলার আম। প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক চীন সফরের সময় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশের আম আমদানির বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২৮ এপ্রিল চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনসহ আমদানিকারকরা চাঁপাইনবাবগঞ্জের কয়েকটি আমবাগান পরিদর্শন করেছেন। এ সময় রাষ্ট্রদূত বলেন, কম খরচে বাংলাদেশের আম আমরা আমদানি করতে চাই।
কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপপরিচালক ড. ইয়াছিন আলী জানান, চলতি বছর এ জেলায় তিনশ ৩৯ হেক্টর জমিতে ১২২ জন আমচাষি (উত্তম কৃষিচর্চা) মেনে রপ্তানিযোগ্য আমচাষ করেছেন। গত বছর ৮৩৯ টন আম রপ্তানি করা হয়েছে।
এ ছাড়া রাজশাহী এবং নাটোরের আমও বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। রাজশাহী ম্যাঙ্গো প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনোয়ারুল হক বলেন, কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই বিদেশে রপ্তানির আমগুলো ছোট থাকতেই ব্যাগের মধ্যে রাখা হয়। আর একে বলে ফ্রুট ব্যাগ। এ ফ্রুট ব্যাগগুলো চীন থেকে আমদানি করা হয়। যে আমগুলো আকারে বড় বা দেখতে সুন্দর, শুধু সেই আমগুলোতে ফ্রুট ব্যাগ পরানো হয়। এই পদ্ধতিতে একবারে বিষমুক্ত আম পাওয়া যায়।