ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে ঘিরে ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে। এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সক্রিয় অংশগ্রহণ ক্যাম্পাসে এক নতুন রাজনৈতিক বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। এটি কেবল তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির একটি নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত। ১৯৯৭ সালের পর এই প্রথম ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। অন্যদিকে, ১৯৭৮ সালের পর এবার আবার ছাত্রশিবিরের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এই দুই সংগঠনের প্রত্যাবর্তন একদিকে ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তুলেছে এবং অন্যদিকে সবার মনোযোগও আকর্ষণ করেছে। তাছাড়া, বাম ছাত্র সংগঠনগুলো তো আছেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নীরব সম্মতি এই ত্রিমুখী প্রার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে, যা একটি উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশের ইঙ্গিত বহন করে।
তবে, এবারের নির্বাচনে একটি বড় ফ্যাক্টর হতে পারেন নারী ভোটাররা। মোট ভোটারের প্রায় ৪৭.৫ শতাংশ ছাত্রী ভোটার, যা নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ছাত্রদল এবং শিবিরের প্যানেলে একাধিক নারী প্রার্থী থাকলেও, তারা নারী ভোটারদের কাছ থেকে কতটা সমর্থন আদায় করতে পারবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই নির্বাচন অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে নাকি ক্যাম্পাসে এক নতুন সহাবস্থানমূলক রাজনীতির জন্ম দেবে, তার উত্তর ৯ সেপ্টেম্বর যখন ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হবে তখনই পাওয়া যাবে।
ইতিহাস বলে, ঢাবি শিক্ষার্থীরা বরাবরই ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচন এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সেবার স্বাধীনতার পরপরই অনুষ্ঠিত হওয়া ডাকসু নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ভরাডুবি হয়েছিল। নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর জোট। ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে জয়লাভ করে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) এবং ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া) সমর্থিত প্রার্থীরা। তৎকালীন ছাত্রলীগ, যা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, অথচ তারাই নির্বাচনে পরাজিত হয়। এর কারণ ছিল, সদ্য স্বাধীন দেশে ব্যাপক দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। সাধারণ শিক্ষার্থীরা দ্রুতই বুঝতে পারে যে, নতুন সরকার তাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। তারা প্রতিবাদস্বরূপ ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল, যা ছিল সরকারের প্রতি তাদের অনাস্থার প্রতিফলন।
১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনও একই ধরনের চিত্র তুলে ধরে। স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ছাত্রদল জয়লাভ করে। যদিও ছাত্রদল তখন বিএনপির ছাত্র সংগঠন, তবে তাদের মূল শক্তি ছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা জনসমর্থন। শিক্ষার্থীরা এরশাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং পরবর্তীতে ডাকসু নির্বাচনে এরশাদ সরকারের সমর্থক ছাত্র সংগঠনকে প্রত্যাখ্যান করে তারই প্রমাণ দিয়েছিল।
সাম্প্রতিক উদাহরণ ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনও এই ধারার ব্যতিক্রম ছিল না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন পরাজিত হন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুরের কাছে। যদিও নুর পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় এসেছিলেন, তবে নির্বাচনের ফলাফল ছিল সরকারের প্রতি শিক্ষার্থীদের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। এসব ফলাফল প্রমাণ করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোনো নির্দিষ্ট দলের অনুগত নয়, বরং তারা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সরকারের কার্যক্রমের উপর ভিত্তি করে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
এবারের ডাকসু নির্বাচনে ফলাফল কী হবে তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। গতবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুরকে যারা ভোট দিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই পরবর্তীতে তার রাজনৈতিক দল গণ অধিকার পরিষদে যোগ দেন। এই দলটির কিছু নেতা এখন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। অনেকেই মনে করেন, নুরকে সেবার ছাত্রশিবিরের ভোটাররাই ভোট দিয়েছিলেন। যদি এই ধারণা সত্যি হয়, তাহলে বলা যায়, ছাত্রশিবির ও সাধারণ ছাত্রদের একটি অংশের ভোট একত্রিত হয়ে ১১ হাজারের কাছাকাছি ছিল, যা মোট ভোটের প্রায় ৪৪.৮৯%। বাকী ৫৫.১১% ভোট ছিল জামায়াত-শিবিরবিরোধী।
এখন প্রশ্ন হলো, এবার জামায়াত-শিবিরবিরোধী ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন? ২০১৯ সালের মার্চে শিবিরের উপর নিপীড়ন চালানো হয়েছিল, তবে ৫ আগস্টের পর দেখা গেল অনেক শিবির কর্মী ছাত্রলীগ করতেন এবং তারা বঙ্গবন্ধুর ভক্ত বলে নিজেদের দাবি করতেন। হেলমেট পরে হামলা চালানো হতো, যাতে তাদের পরিচয় গোপন থাকে। এখন ছাত্রলীগের নামে যত হামলা হয়েছে, তার কমবেশি দায় শিবিরের উপরেও বর্তায়। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে জামায়াতে ইসলামীর বড় প্রভাব রয়েছে এবং তাদের সহযোগী এনসিপি’র প্রভাবও কম নয়। সরকারি ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রশিবির ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো সুবিধা পাবে।
অন্যদিকে এবারের নির্বাচনে ছাত্রদল পূর্ণাঙ্গ প্যানেল নিয়ে অংশ নিচ্ছে, তাই তারা একটি বড় সংখ্যক ভোট পাবে বলে ধারণা করা যায়। ছাত্রশিবির-এনসিপি জোটেরও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। বাকী ভোট যাবে জামায়াত-শিবিরবিরোধী শক্তিগুলোর কাছে। এই শক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী এবং অন্যান্য বামপন্থী ছাত্র সংগঠন, যারা দীর্ঘদিন ধরে ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে।
তবে এই শক্তি যদি ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে, তাহলে এবারের ডাকসু’র নিয়ন্ত্রণ ছাত্রশিবির ও তাদের সহযোগীদের হাতে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এর ফলস্বরূপ, দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও তাদের প্রভাব বাড়বে। এটি দেশের ছাত্র রাজনীতিকে ঠিক কোন দিকে নিয়ে যাবে তা আসলেই দেখার বিষয়। কেননা, ডাকসু নির্বাচন শুধু একটি ছাত্র সংসদ নির্বাচন নয়, বরং দেশের ভবিষ্যতের একটি প্রতিফলনও বটে।
লেখক: সিইও, ইটিসি ইভেন্টস লিমিটেড
[email protected]