বসন্তের অপার্থিব সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এলো বনান্তে পাগল বসন্ত/ বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায়, চঞ্চল তরুণ দুরন্ত।’ ঋতুরাজখ্যাত বসন্তের আগমনে প্রকৃতি যেন ফিরে পায় তার চিরায়ত রূপ, সৌন্দর্য। শীতের শীর্ণতায় ঝরা পাতাগুলো ফাগুনের ঝিরিঝিরি দখিনা বাতাসে অল্প অল্প বাতাসে উড়ছে। নবপত্রপল্লবে শোভিত হয়ে উঠছে বনরাজি, ফুলের বাগান। বাংলার শ্রীযুক্ত নৈসর্গিক প্রকৃতিতে ফাগুনের মাতাল হাওয়া দোলা দিয়েছে। বসন্তের ছোঁয়ায় প্রকৃতি যেন নতুনরূপে সাজবে। বসন্তের আগমনে অকপটে হৃদয়ে জাগে এ যেন মধুময় বসন্ত, ফুলেল বসন্ত, যৌবনের উদ্দামতা বয়ে আনার বসন্ত এবং আনন্দ, উচ্ছ্বাস, প্রফুল্লতা ও উদ্বেলতায় মন কেড়ে নেওয়ার বসন্ত, বাঙালি জাতিসত্তায় আনে মুগ্ধতার পরশ।
ইতিহাস বলে, মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৫ সালে ১৪টি উত্সবের প্রবর্তন করেছিলেন। তন্মধ্যে বসন্ত উৎসব অন্যতম। এরপর থেকেই বাঙালি প্রতিবছর বিভিন্ন উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে বরণ করে নেয় ঋতুরাজ বসন্তকে। বসন্তকে ঋতুরাজ বলার কারণ, বসন্ত প্রকৃতিকে এক নতুন সাজে সাজিয়ে তোলে। এমনকি সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে তার আপন মহিমায়। বিশ্বকবি রবি ঠাকুর থেকে শুরু করে আধুনিককালের বাউল কবির মনকেও বারবার দুলিয়েছে বসন্তের ছোঁয়ায়। বসন্ত অশোক-পলাশ-শিমুলেই উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায়।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তরুণ মনে লাগছে বসন্তের ছোঁয়া, চারদিকে যেন সাজ সাজ রব। গাছ-গাছালির কচি পাতার দোলায় দোলে প্রকৃতি, তারই সঙ্গে দোলে মানবাবেগী মন। নবাগত প্রাণের সতেজতা ফিরে পায় ফাগুনের হাওয়ায়। ঋতুরাজ বসন্তের আগমন যেন প্রত্যেকের হৃদয়কে করে উচাটন।
ঋতুর অভিধানে বসন্ত ঋতুর যে অর্থ আছে, আজকের বাংলাদেশে এসে সেই মানে যেন সাতখানা হয়ে গেছে। যদি কেউ ভাবেন, উপমা দিয়ে বসন্তের রূপ ধরতে গেলে বসন্তের প্রকৃত রূপ অবলোকন করা যাবে, তাহলে তা অজন্মও অসম্ভব। বসন্ত চিরকাল পলাতকই থেকেই যাবে। বসন্তের আগমনে নিতান্ত, নিরীহ, নির্বিরোধ, নির্বিকার, নিরাপদ, নির্জীব মানুষের প্রাণও এতে আলোড়িত না হয়ে পারে না; কিন্তু বর্তমানে আদৌ কি তার দেখা মিলে? ফাগুন তথা বসন্ত কোথায়? বসন্তের আগমনে বর্তমানে যা দেখি, তা অনেকটা প্রাক-গ্রীষ্ম নয় কি? বর্তমানে বসন্ত উৎসব যেন আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব। ‘বউ কথা কও’ বলে কোনো পাখি কি ডেকেছে?, ‘চোখ গেল’ বলে কোনো পাখি কি ফিরেছে? বা ‘কৃষ্ণ কোথায় রে’ বলে কোনো পাখির কণ্ঠে হাহাকার শোনা গেছে? কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম ব্যস্ত ফ্যাশন হাউসগুলোতে বসন্তের ফিউশন পোশাকগুলো এসেছে কি না?, ফেসবুকের পাতায় ই-কার্ডে বসন্তের নতুন কোনো মাত্রা যুক্ত হয়েছে কি না? মোবাইল অপারেটরগুলো বসন্তকালীন অফার দিয়েছে কি? এই তিনটি উত্তর পেলেই বুঝে নেয়—বসন্ত এসেছে। মূলত, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে যে নিবিড় সখ্য তা অনেকটাই নেই বললেই চলে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সখ্য গড়ে তুলতে হবে প্রকৃতির সঙ্গে নচেত্ মানুষরূপী রোবট তৈরি হবো আমরা। মনে রাখা প্রয়োজন, এই বসন্ত যেমনভাবে আনন্দের, পক্ষান্তরে বেদনারও। কারণ এই বসন্তে আসে বাঙালির অমর একুশে ফেব্রুয়ারির আগমনী বার্তা। স্মরণ করিয়ে দেয় ভাষা শহিদদের রক্তের ইতিহাস। সেই সঙ্গে এই বসন্তকে ঘিরে রয়েছে তারুণ্যের বিভিন্ন রকম চিন্তাভাবনা, কবিদের বিভিন্ন কবিতার সমাহার, রয়েছে বিভিন্ন গান।
বসন্ত যেন বাঙালির মনের অনেকখানি জায়গা জুড়েই বিস্তৃত। শুকনো পাতায় ভর করে ঋতুরাজ বসন্তের আগমন। বৃক্ষরাজিতে সবুজ পাতা আর নানা রঙের ফুল। কৃষ্ণচূড়া এবং শিমুল বন সাজে সূর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রক্তিম রঙে। কোকিলের কুহু গানের সুরে ভ্রমরের নৃত্যের গুনগুনানিতে সতেজতার ষোলআনাই পূর্ণ হয় প্রকৃতিতে। চারদিকে ধ্বনিত হয় ঝরা পাতার নিক্কন শব্দে। বসন্ত যেন খুঁজে পায় নিজের নামের সার্থকতা। তাই তো কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত।’ প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বাঙালি তার চিরায়িত ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নেবে বসন্তকে। নবীন থেকে প্রবীণ-সবাই যেন প্রকৃতির রঙের সঙ্গে নিজেদেরও রাঙিয়ে তোলে— সেই প্রত্যাশাই রইল।
লেখক :শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়