প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাড়াজাগানো উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’। উপন্যাসটি ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের পটভূমিতে রচিত। সে উপন্যাসে ‘হাড্ডি খিজির’ নামে একটি চরিত্র আছে। হাড্ডি খিজির তার আসল নাম নয়। নাম খিজির আলি। কিন্তু হাড় জিরজিরে শরীরের জন্য মহল্লায় তার নাম পড়ে যায় ‘হাড্ডি খিজির’। স্বল্পশিক্ষিত হাড্ডি খিজির কখনো রিকশা গ্যারেজের ম্যানেজার, আবার কখনো অটোরিকশাচালক। বউ-বাচ্চা থাকলেও সে সংসারবিবাগী। বউ-বাচ্চার কোনো খোঁজখবরই রাখে না। সংসারের খোঁজখবর না রাখলেও আন্দোলনের খবর সে ভালোই রাখে। মহল্লার ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তার ওঠাবসা। তাদের সঙ্গে সে মিছিলে যায়, জনসভায় যায়, গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেয়- ‘আইয়ুব-মোনেম দুই ভাই, এক রশিতে ফাঁসি চাই’, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’, ‘আসাদের মন্ত্র, জনগণতন্ত্র’ ইত্যাদি। সংসারধর্মে তার আগ্রহ না থাকলেও রাজনীতি, মিছিল, স্লোগানে প্রবল আগ্রহ। রাস্তায় মিছিলের স্লোগান শুনলেই তার নেশা ছুটে যায়। দৌড়ে শামিল হয় মিছিলে। থাকে সবার আগে। ঢাকা তখন উত্তাল। আইয়ুবের পতন ও শেখ মুজিবের মুক্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। এক রাতে কারফিউ ভেঙে মিছিল বেরোয় ঢাকার রাস্তায়। পুরান ঢাকার বাসা থেকে বেরিয়ে মিছিলের সঙ্গে স্লোগান দিতে দিতে হাড্ডি খিজির চলে আসে বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায়। আর তখনই পড়ে যায় মিলিটারির গাড়ির সামনে। দুটি গুলি বিদ্ধ হয় হাড্ডি খিজিরের বুকে। তার পরও স্লোগানে বিরতি নেই। অবশেষে পড়ে যায় বাহাদুর শাহ পার্কের রেলিং-ঘেঁষে ফুটপাতে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হাড্ডি খিজিরের শেষ পরিণতির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- ‘ভোর হতে না হতেই তিনটে বড় মাছি খিজিরের হাঁ করা মুখের ওপর ভোঁ ভোঁ করে ওড়ে। কিছুক্ষণ পর তাদের নীল পাখায় গোলাপি আভা পড়ে তেরছা হয়ে।... কিন্তু ভালো করে রোদ ওঠার আগেই মিলিটারির গাড়ি এসে দেখতে দেখতে সব লাশ তুলে নেয়। শেষ লাশটি ছিল খিজিরের।’ (পৃষ্ঠা ২৭৭, প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ, অক্টোবর ১৯৯৫, ইউপিএল)।

ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে আত্মদানকারী নাম না জানা এক যুবকের চিত্র এভাবেই এঁকেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। আমাদের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এমন কত হাড্ডি খিজিরের আত্মদান জড়িয়ে আছে আমরা জানি না। জানার চেষ্টাও করি না। অযত্ন-অবহেলায় তারা হারিয়ে যান গভীর অন্ধকারে। সেখান থেকে ইতিহাসের আলোয় তাদের টেনে তোলার চেষ্টা আমরা করি না। ফলে নিঃস্বার্থে আত্মবলীদান করা এসব মানুষের ঠাঁই হয় না ইতিহাসের পাতায়। এঁরা নিঃস্বার্থে নিঃশেষে প্রাণ দান করে যায়। কিন্তু কেউ তাদের কথা মনে রাখে না। এখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার বাণী- ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তাঁর ক্ষয় নাই’ কেমন যেন অর্থহীন মনে হয়। নিঃশেষে প্রাণ দানকারী হাড্ডি খিজিররা হারিয়ে যান ইতিহাস থেকে, মানুষের স্মৃতি থেকে। প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান দিবসের খবরের সঙ্গে একটি ছবি ছাপা হয় পত্রিকাগুলোয়। মিছিলের একেবারে সামনে একটি শিশু হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে। কোমরে তার জামা পেঁচানো। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন হয়েছে। তারপর দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু সেই শিশুটির কোনো খবর আমরা রাখিনি। রাখার প্রয়োজনও বোধ করিনি। রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন-সংগ্রামের আওয়াজ শুনলেই আমার হাড্ডি খিজিরের কথা মনে পড়ে। তাকে আমরা চোখে দেখিনি। তবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চোখে আমরা তাকে দেখছি। মিছিলের আগে আগে হাঁটা যুবক কিংবা প্রৌঢ়, বালক কিংবা শিশুটিকেই আমার হাড্ডি খিজির মনে হয়। আন্দোলনের ফলাফল যা-ই হোক, এর সুফল সে বা তার পরিবার কোনো দিনই পায় না। দু-চার জন ছাড়া কেউ থাকেও না স্মরণে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে রাজপথে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে যুবক, সেই নিঃশঙ্কচিত্তে প্রাণোৎসর্গকারী নূর হোসেনকে আমরা কি মনে রেখেছি? কখনো কি ভেবে দেখেছি- যে স্বপ্ন চোখে মেখে জীবন দিয়েছিল নূর হোসেন, সেই স্বপ্ন মানে গণতন্ত্র নামের বৃক্ষটিকে সাবলীল বেড়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছি কি আমরা? একই আন্দোলনে শহীদ বিল্লাল হোসেন, নাজির উদ্দিন জেহাদদের কি আমরা বিস্মৃত হইনি? বলতে পারেন প্রতি বছর তাদের শাহাদাতবরণের দিনটি তো ‘যথাযোগ্য মর্যাদায়’ পালন করা হয়। অস্বীকার করছি না। কিন্তু তাদের আত্মত্যাগের মর্যাদা কি আমরা সঠিকভাবে দিতে পেরেছি? যদি পারতাম তাহলে আজও দেশে গণতন্ত্র আছে কি নেই তা নিয়ে বিতর্ক চলত না। কোনো পক্ষকে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ কথিত জেহাদ ঘোষণা করতে শোনা যেত না।

১০ অক্টোবর ছিল শহীদ জেহাদ দিবস। এ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে বিএনপির হাজারো নেতা-কর্মী প্রাণ দেবে’। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১১ অক্টোবর, ২০২২)। বিএনপি মহাসচিবের কথাগুলো পাঠ করার পর থেকেই আমার মাথায় চিলেকোঠার সেপাইয়ের হাড্ডি খিজির এসে ভর করেছে। ভাবছি আরও কতজন হাড্ডি খিজির তৈরি হবে আমাদের দেশে। বিগত দিনের আন্দোলনে বিএনপির বহু নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। তারা কি সেসব সন্তানহারা মা-বাবা, স্বামীহারা স্ত্রী, পিতাহারা সন্তানদের কোনো খোঁজখবর রেখেছেন? এই তো মাত্র কদিন আগে মির্জা আলমগীরদের ডাকে রাস্তায় নেমে ভোলা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জে তিনটি তাজা জীবনপ্রদীপ চিরতরে নিভে গেল। কী সান্ত্বনা দেবেন তাদের পরিবারগুলোকে? বলবেন, ক্ষমতায় গেলে এসব পরিবারকে স্বর্গসুখে থাকার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু অতীত কি সে রকম সাক্ষ্য দেয়? কেউ হয়তো বলবেন, বিএনপি তাদের কর্মসূচি পালন করতে চেয়েছে। সরকারের বাহিনী কেন গুলি করল? এখানে সরকার তার দায় এড়াতে পারবে না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি ন্যূনতম আস্থার অভাবের কারণেই এসব মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। সংযম ও পরমতসহিষ্ণুতার অভাব যেভাবে আমাদের রাজনীতি গ্রাস করেছে, তাতে সামনে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতির আশঙ্কা অনেকেই করছেন। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে কালবৈশাখী ঝড়ের আগে গুমোট আবহাওয়ারই তুলনা চলে। এক পক্ষ ঘোষণা দিয়েছে রাজপথ দখলে নেওয়ার, অন্য পক্ষ বলছে তারা তা হতে দেবে না। দুই পক্ষের এ মল্লযুদ্ধের পূর্বাভাস জনমনে জন্ম দিচ্ছে শঙ্কার। এর ফলে কত হাড্ডি খিজিরের জীবন ধ্বংস হবে তা ভেবে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। দুই পক্ষ থেকেই আক্রমণাত্মক কথা বলা হচ্ছে। এর মধ্যে বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমানের ‘১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়’ উক্তিটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। রাজনৈতিক মহল ভেবে পাচ্ছে না, কারাবন্দি খালেদা জিয়ার কথায় কীভাবে ওইদিন থেকে দেশ চলবে? দেশ চলে সরকারের নির্দেশনায়। ১০ ডিসেম্বর কি তাহলে খালেদা জিয়া অলৌকিকভাবে সরকারপ্রধানের আসনে বসে যাবেন? বলা নিষ্প্রয়োজন, আমান উল্লাহ আমানের বক্তব্যটি কোনো মহলেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বরং সর্বত্র হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের হাস্যকর কথা সাধারণত রাজনৈতিক জ্ঞান-গরিমাহীন তৃতীয়-চতুর্থ সারির কর্মীরা বলতে পারেন। আমান উল্লাহ আমান তো এখন জাতীয় রাজিনীতিতে জায়গা পেয়েছেন। তিনি তো আর আশির দশকের ছাত্রনেতা নেই। কথা বলার আগে তার ভাবা উচিত মানুষের কাছে তা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, বাস্তবতার সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমান উল্লাহ আমানের ওই কথা নিয়ে যখন চারদিকে সমালোচনার ঝড় বইছে, তখন বিএনপি মহাসচিব তাকে দিলেন বাহবা। বললেন, ‘এই যে, আমান উল্লাহ আমান যে একটা ধমক দিয়েছে, তাতেই ওদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’ (প্রাগুক্ত)। সর্বত্র সমালোচিত উক্তির জন্য খোদ মহাসচিব যদি সাধুবাদ দেন, তাহলে বক্তা যে দ্বিগুণ উৎসাহে একই কাজ লেগে করতে থাকবেন তাতে আর সন্দেহ কী। অক্টোবরে চট্টগ্রাম, খুলনা ও রংপুরে সমাবেশ করেছে বিএনপি। সমাবেশে প্রচুর লোকসমাগম বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে নিঃসন্দেহে। সমাবেশ মঞ্চেও কোনো কোনো নেতার আক্রমণাত্মক বক্তৃতা লক্ষ করা গেছে। অন্যদিকে কোনো কারণ ছাড়াই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, ‘আগুন নিয়ে খেলার পরিণতি শুভ হবে না’। একটি রাজনৈতিক দলের আন্দোলন করা যদি আগুন নিয়ে খেলা হয়, তাহলে তো রাজনীতির সংজ্ঞা পরিবর্তন করতে হয়। দীর্ঘদিনের গৃহবন্দি রাজনীতি ছেড়ে বিএনপি রাজপথে পা রাখতে শুরু করেছে মাত্র। এতেই যদি কাদের সাহেবদের মনে শঙ্কার ঢেউ জাগে তাহলে বলার কিছু থাকে না। গণতন্ত্রের কথা বলবেন, নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ চাইবেন আর তাদের কর্মসূচিকে বক্রদৃষ্টিতে দেখবেন তা তো হয় না। তবে আন্দোলনের নামে বিএনপি যদি আক্ষরিক অর্থেই নৈরাজ্য সৃষ্টিতে লিপ্ত হয় তখন যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। আওয়ামী লীগের সেটা দেখার দায়িত্ব নয়। বিরোধী দলের একটি সফল কর্মসূচিই যদি ক্ষমতাসীনদের কাছে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা বলে অনুমিত হয় এবং তারা তা প্রতিহত করতে মাঠে নামে, তাহলে রাজপথে সংঘাত হয়ে উঠতে পারে অনিবার্য। আর এ ধরনের সংঘাতে হাড্ডি খিজিরদের হতে হয় বলির পাঁঠা।

সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির আড়মোড়া ভেঙে নড়েচড়ে বসাকে রাজনীতিসচেতন মহল ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছে। তাদের মতে, দেশে রাজনীতির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একাধিক শক্তিশালী রাজনৈতিক পক্ষ থাকা দরকার; যাতে জনগণের সামনে বিকল্প পছন্দের সুযোগ থাকে। ঢাকার ফুটবল মাঠে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও আবাহনী লিমিটেডকে একসময় বলা হতো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব। প্রায় দুই যুগ এ দুটি দল লিগ শিরোপা নিজেদের দখলে রাখতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেছে। ঠিক তেমনি আমাদের রাজনীতির মাঠে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। শিরোপার জন্য তারা লড়াই করবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে খেলতে হবে শৃঙ্খলা বজায় রেখে, আইন ভঙ্গ না করে। একে অন্যকে পরাজিত করতে জানবাজি লড়াই করবে, তবে ফাউল প্লে যাতে না হয় ক্যাপ্টেনদের সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। সংযত রাখতে হবে নিজ নিজ দলের খেলোয়াড়দের। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ যাতে অরাজকতার কবলে না পড়ে, উভয় দলের নীতিনির্ধারকরা সে ব্যাপারে যত্নবান হবেন- দেশবাসী সেটাই প্রত্যাশা করে। কারণ তারা চান, আর একজনও হাড্ডি খিজির যেন বেঘোরে প্রাণ না হারায়।





লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews