রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড় ক্রস করতে গিয়ে একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম। মোড়ে নতুন ট্রাফিক বাতি লাগানো হয়েছে। ট্রাফিক বাতি পূর্বে থাকলেও এবারের গুলো বেশ স্মার্ট এলইডি বাতিই মনে হল। সেইসাথে পথচারীদের রাস্তা পারাপারের জন্য লাল ও সবুজ বাতির ভেতরে ‘ওয়াক/ডোন্ট ওয়াক’ প্রতীক যুক্ত লাল ও সবুজ রঙের সিগন্যালও চালু করা হয়েছে। মনে হলো, দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থায় নতুন সংযোজন। বিষয়টি ভালোই লাগল। পরবর্তীতে বাংলা মোটর এবং সোনারগাঁও হোটেল মোড়ের সড়কে ওই একই ধরণের ট্রাফিক বাতি লাগানোর তোড়জোড় দেখলাম। ইতোমধ্যে বাতিগুলো চালু হয়ে গেছে। যানবাহন এবং পথচারীরা ট্র্যাফিক সিগন্যাল দেখে চলাচল করুক আর না করুক বাতির স্বয়ংক্রিয় কাজ কিন্তু শুরু হয়েছে। যেহেতু বেশ কিছু ট্র্যাফিক পয়েন্টে এই বাতি লাগানোর ব্যাপারটা চোখে পড়েছে সেকারণে মনে হলো, বিষয়টি হয়ত বর্তমান সরকারের নতুন কোন সংযোজন বা ট্র্যাফিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর চিন্তাও হতে পারে। তাই একরকম কৌতূহল নিয়েই বিষয়টির খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম।
যেটা জানতে পারলাম সেটা হচ্ছে, রাজধানীর সড়কে ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফেরাতে চালু হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থা। সবুজ, হলুদ ও লাল বাতি দেখে সিগন্যাল পার হওয়া এবং সিগন্যালের বাতির ধরণ অনুযায়ী সব ধরনের যানবাহন নিয়ন্ত্রিত হবে। সিগন্যাল পয়েন্টে থাকছে শক্তিশালী মনিটরিং ক্যামেরা। প্রথমে পরীক্ষামূলভাবে এটি দেখা হচ্ছে। এই ট্র্যাফিক ব্যবস্থায় শুধু যানবাহন নিয়ন্ত্রণই নয়, পথচারী পারাপারের জন্য ২-৩ মিনিট পরপর নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হবে। এই সময় নির্দিষ্ট সিগন্যাল পয়েন্টের সব সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। নাগরিকদের রাস্তা পার হওয়া শেষ হলে আবারও যানবাহন চলাচল শুরু হবে। জনসাধারণের রাস্তা পারাপারের সময় সিগন্যাল পয়েন্টে মনোরম মিউজিক বাজতে থাকবে। পাইলটিং প্রকল্পের আওতায় এই কার্যক্রম আপাতত রাজধানীর চারটি সিগন্যাল পয়েন্টে (ইন্টারকন্টিনেন্টাল তিন রাস্তা মোড়, বাংলামোটর চৌরাস্তা ট্রাফিক মোড়, সোনারগাঁও চৌরাস্তা মোড় ও ফার্মগেট মোড়) চালু হচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে শিঘ্রই পরীক্ষামূলকভাবে এই চার পয়েন্টে চালু করা হবে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ও পথচারী পারাপার কার্যক্রম। ক্রমান্বয়ে এটি প্রসারিত হবে হাইকোর্টের দক্ষিণ পাশের গেট চৌরাস্তা মোড় থেকে শুরু করে মৎস্য ভবন হয়ে কাকরাইল মসজিদ পয়েন্ট, জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী রেলক্রসিং পয়েন্ট দিয়ে উত্তরা আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত। সর্বসাকুল্যে ২২টি সিগন্যাল পয়েন্টে চালু করা হবে এই কার্যক্রম। পাইলট প্রকল্পের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ক্রমান্বয়ে কার্যক্রম সারা ঢাকা শহরে বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
আরও জানতে পারলাম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর কারিগরি সহায়তায় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এবং ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) অবকাঠামো তৈরি করে দিচ্ছে। চারটি সিগন্যাল পয়েন্টের প্রতিটিতে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে বসানো হয়েছে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি কন্ট্রোল বক্স। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে লাইভ মনিটরিং করার জন্য পুলিশ বক্সে রয়েছেন বুয়েটের এক্সপার্ট। আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু হলে তিন শিফটে তিনজন অপারেটর দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা ডিসপ্লে মনিটরিং বোর্ডে সড়কের কার্যক্রম মনিটরিং করবেন। মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করবে ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেবে বুয়েটের এক্সপার্টরা।
সম্প্রতি বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। সেসময় প্রধান উপদেষ্টা ওই বিশেষজ্ঞদের দেশীয় প্রযুক্তি এবং স্থানীয় মেশিনারিজ ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনার যন্ত্রপাতি তৈরি করার পরামর্শ দেন। প্রধান উপদেষ্টার উৎসাহে স্থানীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সিগন্যাল বাতি এবং কন্ট্রোল বক্স তৈরি করেন বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা। দেশীয় প্রযুক্তি হওয়ায় খরচও অনেক কম হবে। বুয়েট বিশেজ্ঞরা জানান, বিদেশ থেকে সমমানের মেশিনারিজ আনা হলে অন্তত ১৮-২০ গুণ বেশি খরচ বেশি হতো। এছাড়া দেশীয় মেশিনারিজ হওয়ায় কোনো ধরনের সমস্যা তৈরি হলে তা খুব দ্রুত সমাধান করা সম্ভব বলেও জানান। দেশীয় যন্ত্রপাতি সহজলভ্য, খরচ কম এবং কম সময়ের মধ্যে সমস্যার সমাধান করা যাবে বলেও মতামত দেন তারা। এই সিস্টেমে জরুরি প্রয়োজনে ম্যানুয়ালিও অপারেট করা যাবে। তাই এটাকে পরিপূর্ণ স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম না বলে সেমি-অটোমেটেড কন্ট্রোল সিস্টেম বলা যায়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, অনেক সময় নানা কারণে রাস্তাঘাট বন্ধ থাকে। দীর্ঘ সময় পর ওই সড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হলে তখন সেটি বেশিক্ষণ চালু রাখতে হয়। অটোমেটিক সিস্টেমে চললে তখন ওই সড়কের যাত্রীদের ভোগান্তি দূর হতে অনেক সময় লাগবে। জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। তখন ম্যানুয়ালি অপারেট করে সময়সীমা কম-বেশি নির্ধারণ করা যাবে।
তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে ট্রাফিক পুলিশ কাজ কি থাকবে? ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা হাত দিয়ে গাড়ি চলাচল এবং থামানোর কাজ করবেন না। তবে প্রতিটি সিগন্যাল পয়েন্টে সার্জেন্ট এবং স্বল্পসংখ্যক ট্রাফিক সদস্য থাকবেন। কোনো গাড়ি ট্রাফিক বাতির সিগন্যাল অমান্য করলে আইনগতভাবে জরিমানা করবেন তারা। তাৎক্ষণিকভাবে আইন অমান্যকারী যানবাহনকে ধরতে না পারলে ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে ওই গাড়িকে জরিমানার আওতায় আনা হবে। পুলিশ বক্সে স্থাপিত স্বয়ংক্রিয় কন্ট্রোল বক্স এ বুয়েটের নিয়োগপ্রাপ্ত অপারেটরের সঙ্গে থেকে শিফট অনুযায়ী ট্রাফিক সদস্যরা অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। পুরোপুরি এক্সপার্ট হয়ে গেলে বুয়েট অপারেটররা ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন। এরপর পরিপূর্ণভাবে দায়িত্ব পালন করবেন ট্রাফিক সদস্যরা।
অনেক সভ্য দেশে ট্রাফিক সিগন্যাল চালুর শতবর্ষ পার হলেও আমাদের দেশে এখনো ট্রাফিক সদস্যদের হাত, মুখের বাঁশির শব্দ এবং লেজার লাইট ভরসা। ঢাকাতেও ট্রাফিক সিগন্যাল চালুর চেষ্টা হয়নি, তা নয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি উদ্যোগই চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যার পেছনে রয়েছে অপরিকল্পিত উদ্যোগ, সমন্বয়হীনতা, নিজস্ব বাস্তবতা অনুধাবন না করে ভিনদেশের অনুকরণ, জনগণের সচেতনতার অভাব ও সর্বোপরি দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিদারুণ উদাসীনতা। চীনে থাকার ৪ বছরের অভিজ্ঞতার মধ্যে তাদের ট্র্যাফিক ব্যবস্থা আমাকে অনেক বেশি বিমোহিত করেছিল। স্বয়ংক্রিয় ট্র্যাফিক সিগন্যাল চীনে বহু আগে থেকে প্রচলিত এবং পথচারী থেকে শুরু করে সব ধরণের যানবাহন সেটি মানতে বাধ্য। ট্র্যাফিক পুলিশের উপস্থিতি সেখানে খুব একটা চোখে পড়েনা। স্বয়ংক্রিয় বাতিগুলো তার মত করেই সিগন্যাল দিয়ে যায়। এমনকি গভীর রাতের ফাঁকা এবং নির্জন রাস্তায়ও প্রতিটি পরিবহন ট্র্যাফিক সিগন্যাল মেনে চলে। রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি ট্র্যাফিক সিগন্যালে থেমে অপেক্ষা করুক, চলা শুরু করুক কিংবা দ্রুত গতিতে চলতে থাকুক না কেন, কোন হর্নের শব্দ শোনা যায় না। চীনাদের ট্র্যাফিক ব্যবস্থায় একটি অতিরিক্ত সংজোযন আছে। সিগন্যাল শুরু অথবা শেষ হওয়ার ৬০ সেকেন্ড (কোথাও তারও বেশি) আগে থেকে এলইডি লাইটে টাইমার কাউন্ট ডাউন শুরু হয়। কোন নির্দিষ্ট রাস্তায় লাল সিগন্যাল শুরুর আগে সবুজ বাতিতে এবং সবুজ সিগন্যাল শুরুর আগে লাল বাতিতে এই কাউন্ট ডাউন শুরু হয়। যাতে করে সেদিক থেকে আসা গাড়ির চালক সহজেই তাদের গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। পথচারীদের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতিতে সময় কাউন্ট ডাউনের ব্যবস্থা থাকে। এতে করে সময় শুরু থেকে শেষ হওয়ার মধ্যেই পথচারীরা রাস্তা পারাপারের কাজ শেষ করে। প্রতিটা ট্র্যাফিক সিগন্যালে কমকরে হলেও ৩০-৪০ টি সিসি ক্যমেরা থাকে। রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে যেমন, প্রধান সড়কগুলোতে একাধিক, প্রতিটি সড়কের সাথে পথচারী পারাপারের দিকে একাধিক সিসি ক্যামেরা বসানো থাকে। ট্র্যাফিক সিগন্যাল অমান্যকারীকে এই সিসি ক্যামেরা দিয়ে সনাক্ত করে মুহূর্তের মধ্যে শাস্তির আওতায় আনা হয়। আমাদের বর্তমান এই ট্র্যাফিক সিগন্যালে সময় কাউন্ট ডাউনের বিষয়টি আছে কিনা আমার জানা নেই। যদি না থাকে, তাহলে এটির সংযোজন নিয়ে বুয়েটের অভিজ্ঞ টিম ভেবে দেখতে পারে। মোদ্দা কথা হলো, ট্র্যাফিক সিগন্যাল মেনে চলতে কিংবা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সবার আগে জনগণের স্বদিচ্ছা জরুরি। এই স্বদিচ্ছা থাকতে হবে পথাচারি থেকে শুরু করে সকল যানবাহন চালকদের মধ্যে। সভ্য দেশের মত সকল সুযোগ-সুবিধা আশা করতে চাইলে এই বিষয়টি অতীব জরুরি। আমাদেরকেও সভ্য হতে হবে। আইন প্রয়োগ করে কিংবা জোর পূর্বক কোন কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেয়ে মানুষের ভিতর থেকে যদি স্বদিচ্ছা থাকে, তাহলে এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য সফল হবে। অন্যথায় পূর্বের বহু প্রকল্পের মতো এটিও আশার মুখ দেখতে ব্যর্থ হবে।
ঢাকার যানজট নিরসনে আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যালের কাজে গত ২৫ বছরে কয়েকটি প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০০০ সালের দিকে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের আওতায় ৭০টি জায়গায় আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি বসানোর কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ২০০৮ সালের দিকে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবহার না হওয়ায় অল্প দিনেই অধিকাংশ বাতি অকেজো হয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০১০-১১ অর্থবছরে ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ নামে আরেকটি প্রকল্পের আওতায় স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরঞ্জাম কেনা হয়। এর আওতায় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ৯২টি মোড় বা ইন্টারসেকশনে সোলার প্যানেল, টাইমার কাউন্টডাউন, কন্ট্রোলার ও ক্যাবল স্থাপন করা হয়। এই স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল-ব্যবস্থাও এখন অকার্যকর। শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়নে ২০১৫ সালে ‘ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট’ নামে আরেকটি প্রকল্পটি নিয়েছিল ডিটিসিএ। প্রকল্পটিতে ঋণসহায়তা দেয় জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা। প্রকল্পের আওতায় ২০১৯ সালে গুলশান-১, মহাখালী, পল্টন ও ফুলবাড়িয়া মোড়ে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা বা ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেমের জন্য সিসি ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, অত্যাধুনিক শব্দধারণ যন্ত্র, বাতি, বিশেষায়িত তার এবং খুঁটি স্থাপন করা হয়। ৫২ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পও সফলতার মুখ দেখেনি। ডিটিসিএর কর্মকর্তাদের মতে, ঢাকার মতো শহরের জন্য এ ব্যবস্থা বাস্তবসম্মত ছিল না। অযান্ত্রিক যানবাহনের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবস্থা কার্যকর নয়। প্রকল্প শুরুর সময় কেন অযান্ত্রিক যানবাহনের বিষয়টি মাথায় রাখা হয়নি, সেটি বড় প্রশ্ন। ফলে ট্রাফিক সংকেতবাতির ব্যবস্থায় অপচয়ের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয় এ প্রকল্প।
নতুন করে ট্র্যাফিক বাতি স্থাপনের সুফল নগরবাসী কতটুকু পাবেন, তা নিয়ে অনেক মতবিরোধ থাকতে পারে। তবে, ট্র্যাফিক পুলিশের হাতের ইশারার পাশাপাশি লাঠি, বাঁশি, দড়ি এবং লেজার লাইট ব্যবহার করে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের এই সনাতনী ব্যবস্থা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। এগুলো দেখতে যেমন অশোভনীয় ঠিক তেমনি এর বিপরীত কিছু প্রতিক্রিয়াও আছে। যেমন, সজোরে বাঁশিতে ফু দিলে একদিকে ট্র্যাফিক পুলিশের স্বাস্থ্য ক্ষতি এবং সর্বোপরি পথচারীদের উচ্চ শব্দের সম্মুখীন তথা শব্দ দূষণের সম্মুখীন হওয়ার বিষয় আছে। লেজার লাইট ব্যবহার করে দূর থেকে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা গাড়ি লক্ষ্য করে লেজারের সবুজ আলো ফেলেন। থামার জন্যও সবুজ, চলার জন্যও সবুজ আলো। এতে সৃষ্ট মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় বিভ্রান্তিতে পড়েন চালকেরা। অনেক সময় চালকের চোখে আলো পড়ার পর অস্বস্তিতে পড়েন। লেজার লাইটের রশ্মি মূলত ফোকাস রেডিয়েশন। চিকিৎসকদের মতে, লেজার লাইটের রশ্মি এসে পড়লে মানুষের চোখ ও ত্বকের সাময়িক বা স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। রেটিনার ক্ষতিসহ তা অন্ধত্বের ঝুঁকি তৈরি করে। এ ধরনের লাইটের ব্যবহার দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ায়। পুলিশের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের সময় এই লেজার লাইটের ব্যবহার কতটা যুক্তিসঙ্গত সেটিও ভেবে দেখা সমীচীন।
ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণে যে ব্যবস্থায় অনুসরণ করা হোক না কেন, এটা সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং হবে। কেননা, ঢাকার সড়কগুলোতে চলাচলকারী যানবাহনের গতি মিশ্র। এখানে একই সড়কে স্বল্পগতির পায়েচালিত রিকশা যেমন আছে, মাঝারি গতির ব্যাটারিচালিত রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা, আবার দ্রুতগতির বাস, মোটরসাইকেল ও ট্রাকের মতো বাহনও আছে। যানবাহনের সংখ্যাও সড়কের ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। এমন জগাখিচুড়ি সড়কে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল চালু করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও যানজট নিরসনের ক্ষেত্রে ট্রাফিক সিগন্যাল একটি অংশমাত্র। অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি ট্রাফিক সিগন্যাল চালুর ক্ষেত্রে যথাযথ গবেষণার ভিত্তিতে বাস্তবসম্মত, কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। আগেই বলেছি, এক্ষেত্রে সকল স্তরের জনগণের সমান ভূমিকা আছে। আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে পিক ও অফপিক সময়ে কোন সড়কে যানবাহনের চাপ কেমন থাকে, তা নিরূপণ করে সেভাবেই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার ডিজাইন করা জরুরি।
লেখকঃ গবেষক ও কলামিস্ট।
Email: [email protected]