মতিউর রহমান ও মারুফ আল্লাম
অপরাধীর বিচার ও শাস্তির জন্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ১৮৯৮ সালে ফৌজদারি কার্যবিধি আইন প্রণীত হয়। বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনের নিরিখে এই আইনটি অনেকবার সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু জনগণের হয়রানি রোধ, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি, অপরাধীর শাস্তি বিধান এবং নির্দোষকে দ্রুততম সময়ে হয়রানিমুক্ত করতে এসব সংশোধনী খুব একটা ফলদায়ক হয়নি। তাই স্বল্প সময়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সোয়া শতকের এই আইনটির আমূল সংস্কারের খুব প্রয়োজন ছিল। বিভিন্ন মামলায় উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে সম্প্রতি এটি সংশোধন করা হয়েছে।
বিদ্যমান ফৌজদারি কার্যবিধিতে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের জরিমানা করার এখতিয়ার ছিল মাত্র ১০ হাজার টাকা। সমাজে অপরাধ প্রতিরোধে এই জরিমানা ছিল খুবই অপ্রতুল। ফলে অপরাধীরা আইন আদালতকে গ্রাহ্য করতে চাইত না। এবারের সংশোধনীতে জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের জরিমানা করার ক্ষমতা ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা এবং তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষেত্রে দুই হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা করা হয়েছে।
আসামি গ্রেফতারের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বøাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ ফৌজদারি কার্যবিধিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুন ৪৬ (এ) ধারায় বলা হয়েছে, গ্রেফতার করার সময় গ্রেফতারকারীর নেমপ্লেট থাকতে হবে, নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে হবে এবং পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। আসামিকে তার বাড়ির বাইরে থেকে গ্রেফতার করা হলে, গ্রেফতারের পর অবিলম্বে (যা কোনোভাবেই ১২ ঘণ্টার বেশি হবে না) তার পরিবার বা নিকটজনকে জানাতে হবে।
গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির সুরক্ষায় এবারের সংশোধনীতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো- ‘মেমোরেন্ডাম অব অ্যারেস্ট’-এর প্রবর্তন-ধারা ৪৬ (এ)। গ্রেফতারের সময় আসামিকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য ধারা ৪৬ (ক) থেকে ৪৬ (ঙ) অন্তর্ভুক্ত করে এ সম্পর্কিত একটি ফর্ম যুক্ত করা হয়েছে। যেকোনো গ্রেফতারের ক্ষেত্রেই পুলিশকে এখন থেকে ‘মেমোরেন্ডাম অব অ্যারেস্ট’ প্রস্তুত করতে হবে। এই ফর্মে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির আইনি সুরক্ষাগুলোর একটি চেকলিস্ট রয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে উপস্থাপনের সময় এই ফরমটিও দাখিল করতে হবে।
গ্রেফতারকৃতের তথ্য পেতে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির পরিবারকে ভয়ানক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। গ্রেফতারকৃতকে কেন বা কোন মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে, কোথায় রাখা হয়েছে, তার সাথে কীভাবে যোগাযোগ করা যাবে- এমন তথ্য পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। নতুন বিধান যুক্ত করে এই সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। ৫৪ (এ) ধারায় বলা হয়েছে- গ্রেফতারের সময় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে। আবার ৪৬ (বি) এবং ৪৬ (সি) ধারায় বলা হয়েছে- প্রতিটি গ্রেফতারের তথ্য গ্রেফতারকারীর অফিসের রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি যে থানা এলাকা থেকে আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই থানার সাধারণ ডায়েরিতেও এন্ট্রি করতে হবে। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির পক্ষে কেউ থানায় যোগাযোগ করলে তাকে গ্রেফতার-সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য অবশ্যই সরবরাহ করতে হবে। একই সাথে প্রতি থানা, জেলা ও মহানগর পুলিশ অফিসে প্রতিদিন গ্রেফতারের তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
আমলযোগ্য অপরাধে ৫৪ ধারায় গ্রেফতারের ক্ষেত্রে পুলিশের ক্ষমতা আরো সুনির্দিষ্ট ও জবাবদিহিমূলক করা হয়েছে। নতুন সংশোধনীতে আমলযোগ্য অপরাধে কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে হলে পুলিশকে দেখাতে হবে, পুলিশের সামনে ওই ব্যক্তি অপরাধটি ঘটিয়েছেন। তদন্তাধীন মামলার ক্ষেত্রে অপরাধটি ওই ব্যক্তি করেছেন মর্মে পুলিশের সন্দেহ করার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে হবে। নতুন সংশোধনীতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো- আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে আসামিকে গ্রেফতার করা কিংবা না করা উভয় ক্ষেত্রেই পুলিশকে এর কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। একই সাথে কোনো ব্যক্তিকে নিবারণমূলক আটক করার প্রয়োজনে ৫৪ ধারার বিধান প্রয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
গ্রেফতার সম্পর্কিত যেসব বিধান আইনে আছে, সেগুলো সঠিকভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কি না, তা দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেটকে। কোনো ব্যত্যয় পাওয়া গেলে আদালত অবহেলাকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাকরিবিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিতে পারবে। একজন আসামিকে কত দিন পর্যন্ত পুলিশ রিমান্ডে রাখা যায়, সে ব্যাপারে ফৌজদারি কার্যবিধির বিদ্যমান বিধান অস্পষ্ট। এবার ১৬৭ ধারায় সংশোধন করে বলা হয়েছে- এক মামলায় কোনোভাবেই ১৫ দিনের বেশি পুলিশ রিমান্ড নয়। একই সাথে রিমান্ডে প্রেরণের আগে-পরেও আসামির স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। রিমান্ডে নির্যাতন করলে এবং আসামির শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেলে ম্যাজিস্ট্রেট আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন, এমন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এখন থেকে এক মামলার আসামিকে অন্য মামলায় গ্রেফতার দেখাতে চাইলে পুলিশকে আদালতে আসামি ও পুলিশ ডায়েরি উপস্থাপন করতে হবে এবং আসামিকে শুনানির সুযোগ দিতে হবে।
ফৌজদারি কার্যবিধিতে প্রথমবারের মতো তদন্তের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৭৩ (বি) ধারায় বলা হয়েছে- এখন থেকে যেকোনো মামলার তদন্ত সাধারণভাবে ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। এই সময়সীমার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব না হলে বিস্তারিত কারণ এবং প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত সময় প্রার্থনা করে তদন্তকারী প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তের সময়সীমা বাড়াতে পারবেন। বর্ধিত সময়ের মধ্যেও তদন্ত সম্পন্ন না হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা আবারো তার কারণ ব্যাখ্যা করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রতিবেদন দেবেন। তদন্তকারীর গাফিলতি প্রতীয়মান হলে ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজনে তদন্তকারী পরিবর্তন বা তদন্তকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করতে পারবেন।
সংক্ষিপ্ত বিচারের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের আর্থিক এখতিয়ার বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে এই মূল্যমান বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করা হয়েছে। নতুন সংশোধনী অনুযায়ী সংক্ষিপ্ত বিচারের ক্ষেত্রে এক বৈঠকেই আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাবে এবং যেকোনো স্থানে সংক্ষিপ্ত বিচার আদালত পরিচালনা করা যাবে।
আগের আইনে অনুপস্থিত আসামির বিচারে ক্রোকি ও হুলিয়া পরোয়ানা ছিল কেবল দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টিকারী একটি প্রক্রিয়া। ৩৩৯ (বি) ধারা সংশোধনের ফলে আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার করার জন্য ক্রোকি ও হুলিয়া পরোয়ানা জারির কোনো আবশ্যকতা আর থাকছে না। ফলে পলাতক আসামির মামলা দ্রুততর সময়ের মধ্যে বিচারের জন্য প্রস্তুত হবে। একই সাথে পলাতক আসামিকে আদালতে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দু’টি পত্রিকার পরিবর্তে একটি বাংলা পত্রিকায় এবং পাশাপাশি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার বিধান সন্নিবেশ করা হয়েছে।
বেআইনি সমাবেশ সম্পর্কিত দণ্ডবিধির ১৪৩ ধারাকে আপসযোগ্য করা হয়েছে। এখন থেকে আদালত নিজে আপস কার্যক্রমে সহযোগিতা করতে পারবে এবং পাশাপাশি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে আপসের জন্য মামলা পাঠাতে পারবে। শুধু তাই নয়, আপসের ভিত্তিতে কোনো চুক্তি সম্পাদিত হলে সেই চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নে আদালত প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।
সাজার পরিবর্তে প্রবেশন অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ দেয়। জামিন প্রদানের সময়ও আদালত প্রবেশনের যুক্তিসঙ্গত ন্যায্য যেকোনো শর্ত ও সমাজকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণের শর্ত আরোপ করতে পারবে। যা সংশোধনমূলক বিচার প্রক্রিয়ায় সহায়ক হবে।
ফৌজদারি মামলায় মূল ভোগান্তি হলো- মামলা হওয়ার পর থেকেই তারিখে তারিখে আদালতে হাজিরা দেয়া। হাজিরায় সামান্য ব্যত্যয় ঘটলেই আসামির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়। এবারের সংশোধনীতে তদন্ত চলাকালে আসামির হাজিরা শিথিল করা হয়েছে। ৫৪০ (এ) ধারায় বলা হয়েছে, আদালত চাইলে তদন্ত রিপোর্ট শুনানি পর্যন্ত জামিনপ্রাপ্ত আসামিকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে। এ সময় আসামি তার আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দিতে পারবেন। আগে ২০৫ ধারার অধীনে এ ধরনের প্রতিকার সীমিত আকারে কেবল মামলা আমলে গ্রহণের পর প্রযোজ্য ছিল। নতুন আইনে স্পষ্ট বিধান যুক্ত হওয়ায় সারা দেশের অসংখ্য জামিনপ্রাপ্ত আসামি ব্যক্তিগত হাজিরার ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবেন।
একই সাথে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে কোনো আসামি উপস্থিত না থাকলেও এখন থেকে আসামির আইনজীবী আদালতের অনুমতিক্রমে সাক্ষীদের জেরা করতে পারবেন। এত দিন পর্যন্ত এই সুযোগ নিতে হলে অন্তত একজন আসামিকে আদালতে উপস্থিত থাকতে হতো।
ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে কোনো মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হলে মামলাকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ আগে ঐচ্ছিক ছিল (২৫০ ধারা)। বর্তমানে এটিকে ম্যাজিস্ট্রেটের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব করা হয়েছে। একই সাথে মিথ্যা মামলার সর্বোচ্চ অর্থদণ্ড তিন হাজার থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকা এবং ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এক হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা কমবে আশা করা যায়।
এ ছাড়া নতুন সংশোধনীতে ডিজিটাল মাধ্যমে সমন জারি ও অনলাইনে বেল বন্ড দাখিল করার সুযোগ রাখা হয়েছে। বেত্রাঘাতের মতো অবমাননাকর সাজার সব বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে। এক কথায়, বিচার প্রক্রিয়ায় দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যে সব আইনি কারণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা দূর করে বিচারপ্রার্থী মানুষের দীর্ঘদিনের চাওয়া পূরণ করা হয়েছে। আদালত অঙ্গনে হয়রানিমুক্ত ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে এই সংশোধনী অনেক ফলপ্রসূ হবে আশা করা যায়।
লেখকদ্বয় : সরকারি কর্মকর্তা