স্বাধীন দেশের সরকার পতনের ঘটনাকে কখনো কখনো ‘বিপ্লব’ বলা হয়। কখনো তাকে ‘ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান’, কখনো আবার ‘নতুন পথের সন্ধান’। তবে এসব শব্দ দিয়ে সব সময় বাস্তবতার পুরো মানচিত্র আঁকা যায় না। কারণ কিছু কিছু ঘটনা শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না—তা একটি জাতির বিশ্বাস, নৈতিক স্থিতি ও ঐতিহাসিক চেতনার ভেতর এক গভীর ধ্বনি তুলে দেয়। বাংলাদেশের জন্য শেখ হাসিনার বিদায়ের পরের কয়েকদিন সেই ধ্বনির রেশেই কেটেছে। কেউ বলেছে মুক্তি, কেউ বলেছে দুর্ভাগ্য, কেউ চুপ থেকেছে। কিন্তু একটি ঘটনা অনেককেই নিঃশব্দে নাড়া দিয়েছে, পীড়াও দিয়েছে।

গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আয়োজিত এক বিশেষ বৈঠকে সেনাপ্রধান নিজেই উপস্থিত নেতৃবৃন্দের নাম ঘোষণা করছিলেন। কারা কারা আছে—সে তালিকায় একপর্যায়ে প্রথম যে দলের নামটি উচ্চারিত হয়, তা হলো জামায়াতে ইসলামীর নাম। শুধু একবার নয়, সেনাপ্রধান নামটি দ্বিতীয়বারও পুনরাবৃত্ত করেছিলেন। এই ঘোষণার মধ্যেই হয়তো ছিল এক ধরনের বার্তা, হয়তো তা সরল ছিল, হয়তো কৌশলী, কিংবা কারও কারও চোখে ছিল ঐতিহাসিক ভুলের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু ওই দলের নাম ঘোষণায় কেউ অভিভূত হয়েছিলেন কি না, বলতে পারবো না, তবে অনেকেই যে কেউ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেটা বলাই যায়। কারণ, এই নামটি শুধু একটি রাজনৈতিক সত্তার প্রতিনিধিত্ব করে না; এটি এক জাতিগত স্মৃতির কালো অধ্যায়, এক সময়ের রক্তাক্ত নিষ্ঠুরতার প্রতীক।

বাঙালির জাতীয় মনস্তত্ত্বে জামায়াত নামটি উচ্চারিত হওয়া মানেই একটা বেদনাবোধের তীব্র প্রতিধ্বনি বেজে ওঠে। তা শুধু একাত্তরের ইতিহাসের কারণে নয়—বরং দীর্ঘ রাজনৈতিক চর্চায়, সংস্কৃতির রসায়নে, গণমানসের গভীরে এই দলটির অবস্থান প্রায় ‘অঘোষিত নিষিদ্ধতা’র পর্যায়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ, জামায়াত অনেক সময় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, সংসদেও গিয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক প্রবাহে তারা ছিল প্রায় অচ্ছুত। রাজনীতির জটিল হিসাবনিকাশের কারণে দলটিকে কেউ সহ্য করলেও সম্ভবত অন্তর থেকে ভালোবাসেনি কেউ। কেউ ব্যবহার করলেও বিশ্বাস করেনি। আর তাই, সেই নাম একটি বিশেষ মুহূর্তে সেনাপ্রধানের মুখে উচ্চারিত হওয়ায় সেটা ছিল এক সামষ্টিক বিবেকের বিদীর্ণ আর্তনাদ।

এখন যদি বুঝে না বুঝে কাউকে শুধু প্রশ্নহীন অংশগ্রহণ না করার অপরাধে ‘গণশত্রু’ বানিয়ে ফেলা হয়, তবে সেটা এক রাজনৈতিক মূঢ়তার নামান্তর। সত্যিকার বিপ্লব কোনো দিন একরৈখিক হয় না। সেখানে দ্বিধা, ভিন্নতা, দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে। কিন্তু এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে সম্মিলিতভাবে বিপরীতে দাঁড়াবার সামর্থ্য। এই বোঝাপড়ার জায়গাটিই আজ দুর্বল হয়ে পড়েছে।

এই ঘোষণার পরে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। দেশের নানা প্রান্তে, বিশেষ করে জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, সংস্কৃতির প্রতীক ও সংখ্যালঘুদের ওপর একের পর এক আক্রমণ শুরু হলো। শহীদ মিনার ভাঙা হলো, স্মৃতিসৌধে আগুন লাগানোর চেষ্টা, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকে কালি লেপে দেওয়া, উদীচী কার্যালয়ে হামলা, ছায়ানটকে হুমকি, মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, মাজারে গালাগাল—এসব যেন সহসা বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। এসব হামলা-আক্রমণের ঘটনা যেন লক্ষ্য ছিল ধর্ম নয়—ধর্মের প্রতীক ব্যবহার করে মৌলিক সহনশীলতাকে ধ্বংস করা।

এই পরিস্থিতি দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা শেখ হাসিনার পতনের আনন্দে উল্লসিত হয়েছিল, তাদের অনেকে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। কারণ, তারা হয়তো স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পতন চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল সহিংসতার উল্লাস কারও কাম্য ছিল না। ইতিহাস এক ভয়াবহ রকমের পরিহাস করল। যারা ‘পরিবর্তন’ চেয়েছিল, তারা বুঝতে পারল—পরিবর্তন সব সময় উন্নততর কিছু নিয়ে আসে না; কখনো কখনো সে খোলস বদলায় মাত্র।

এই ভয় ও ধাক্কার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এল কিছু দল, সংগঠন ও গণমাধ্যমের নাম—সিপিবি, উদীচী, ছায়ানট, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার। এরা কেউই শেখ হাসিনার সরাসরি রাজনৈতিক মিত্র ছিল না, বরং সমালোচকই ছিল। সিপিবি তো ২০০৮ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে তাদের সমালোচনা করে আসছে। কিন্তু এই পরিবর্তিত সময়ের এক চূড়ান্ত পরিহাস হলো, জামায়াত-হেফাজত ও তাদের সহায়ক গোষ্ঠী এই দলগুলোকেই ‘আওয়ামী ঘেঁষা’, ‘মধ্যপন্থী প্রতারক’, ‘নিরপেক্ষতার মুখোশধারী’ হিসেবে চিহ্নিত করতে লাগল। হামলার হুমকি, প্রতীক ভাঙচুর, বয়কট ও অস্বীকৃতির এক নিঃশব্দ অভিযান শুরু হলো।

সিপিবির কর্মীরা, যারা আজীবন শ্রমিকের অধিকার, নারী স্বাধীনতা, সংখ্যালঘু নিরাপত্তা, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প রক্ষা, খাস জমির দাবি—এসব আন্দোলনে ছিলেন, তারাও আজ ভাবনায় পড়ে গেছেন। কোনো কোনো কর্মী নিজেদের ভূমিকা নিয়ে দ্বিধায় পড়ছেন—কারণ, তারা বুঝছেন, রাষ্ট্রের পরিবর্তন মানেই নিরাপত্তা নয়। বরং কারা ক্ষমতায় এসেছে, তাদের ব্যাকরণ কী—সেটা বোঝার আগেই অনেক ‘বিপ্লবী’ শক্তি হয়তো নিজেদের পরবর্তী লক্ষ্য নির্ধারণ করে ফেলেছে। সিপিবি, কিছু গণসংগঠন, এমন কি প্রগতিশীল সাংবাদিকরা এখন তাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নেতৃত্বও আজ দ্বিধায়। আন্দোলন শুনলেই তাতে যোগ দেবেন, কি দেবেন না? জনতার স্রোতে নিজেকে মিলিয়ে দেবেন, না কি বুঝে শুনে পা ফেলবেন? এ দ্বিধা হয়তো একদিন আত্মসংযমের ভাষা ছিল, এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে টিকে থাকার কৌশল। কারণ যে সময়টা সামনে এসেছে, তাতে শুধু সাহস নয়, থাকতে হবে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ঐতিহাসিক বোধবুদ্ধি।

এখন যদি বুঝে না বুঝে কাউকে শুধু প্রশ্নহীন অংশগ্রহণ না করার অপরাধে ‘গণশত্রু’ বানিয়ে ফেলা হয়, তবে সেটা এক রাজনৈতিক মূঢ়তার নামান্তর। সত্যিকার বিপ্লব কোনো দিন একরৈখিক হয় না। সেখানে দ্বিধা, ভিন্নতা, দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে। কিন্তু এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে সম্মিলিতভাবে বিপরীতে দাঁড়াবার সামর্থ্য। এই বোঝাপড়ার জায়গাটিই আজ দুর্বল হয়ে পড়েছে।

এখন অনেকে যে সহজ ব্যাখ্যাটি দিচ্ছে, তা হলো—‘তুমি আওয়ামী না বিএনপি?’ অথবা ‘তুমি কী জামায়াতের বিরুদ্ধে? তাহলে আওয়ামীপন্থী কেন বলো না নিজেকে?’ এই প্রশ্ন আসলে ভুল জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে। একজন রাজনৈতিক কর্মী কিংবা সচেতন নাগরিকের অবস্থান নির্ধারণের মানদণ্ড যদি শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়, তবে সব আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতা দখলের কৌশল মাত্র। কিন্তু প্রকৃত রাজনীতি, বিশেষ করে বাম রাজনীতি, বরাবরই সাময়িক লাভের বিপরীতে ন্যায়ের পক্ষ গ্রহণ করেছে—even if it hurts.

সিপিবির আজকের অবস্থান সেই বাস্তবতার সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারা শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন করেনি, এমনকি কঠোর সমালোচনায় গেছে। কিন্তু একইসাথে, জামায়াতের পুনরাবির্ভাব কিংবা উগ্র ধর্মান্ধতার রাজনৈতিক পুনর্বাসনকেও মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এখন যারা ‘যুদ্ধাপরাধীদেরও জোটে নিতে রাজি’, তারা যখন সিপিবিকেও ‘সন্দেহজনক’ ভাবে, তখন বোঝা যায়—নতুন বাস্তবতায় আদর্শ নয়, হিসাবই মুখ্য হয়ে উঠেছে।

এই হিসাবি রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে এখন প্রয়োজন—ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি। কাকে পাশে নেব, কাকে নয়, কীভাবে কোন অবস্থানে থাকব—এসব প্রশ্নের উত্তর শুধু অতীতের ওপর নির্ভর করে পাওয়া যাবে না। দেখতে হবে, এই মুহূর্তে কে কার বিপক্ষে এবং কে কোন চিহ্ন বহন করে।

শেখ হাসিনার পতনের পর যারা ভাবল, এখন একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসবে, তারা ভুল ভাবেনি। তবে বাস্তবতা হলো—গণতন্ত্র শুধু শাসকের বিদায়ে নয়, বিরোধীদের চরিত্র দিয়েও নির্ধারিত হয়। সেখানে জামায়াত, হেফাজত, তাদের অনুগত সশস্ত্র গোষ্ঠী, কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদীরা যদি নেতৃত্ব নিতে শুরু করে, তবে শাসক বদলালেও শোষণ বদলায় না—বরং রূপ বদলায় মাত্র।

এই বাস্তবতা চিনে ফেলা সিপিবির নেতৃত্ব ও কর্মীদের জন্য একটি নৈতিক পরীক্ষা। তারা কি জনতার উল্লাসে গা ভাসাবে, না কি বুঝেশুনে, ইতিহাসের পথ অনুসরণ করে অবস্থান নেবে? সেই অবস্থান নিতে গিয়ে যদি কেউ তাদের ‘নীরব’ বলে, তাহলে তাদের উচিত আরও উচ্চকণ্ঠে বলা—‘আমরা চুপ নই, আমরা বুঝে বলি।’ কারণ চিৎকার করলেই বিপ্লব হয় না, কখনো কখনো চুপ থেকেও স্পষ্ট অবস্থান জানানো যায়।

এই মুহূর্তে যেটি সবচেয়ে জরুরি, তা হলো—পুনর্গঠন। যারা জামায়াতের পুনরুৎপাদন চায়, যারা সংখ্যালঘু নিপীড়নকে 'জনরোষ' বলে চালায়, যারা সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘কুফরি’ আখ্যা দেয়, তাদের বিরুদ্ধে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা। সেই ঐক্যে থাকতে পারে না কোনো আপস, কোনো দ্ব্যর্থবোধকতা। আবার সেই ঐক্যকে বানাতে হবে পরিষ্কার ও সম্মানজনক—তাতে জোর করে কাউকে টেনে আনলে হবে না।

এই মুহূর্তে প্রয়োজন, পরস্পরের উপর আস্থা ফিরিয়ে আনা। কেউ কাউকে দোষারোপ না করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা। যারা সাবধানে হাঁটে, তাদের 'কৌশলী শত্রু' না বানিয়ে বোঝার চেষ্টা করা। কারণ বিভাজন যত গভীর হবে, তত সহজ হবে জামায়াত-ধর্মান্ধদের মাটি তৈরি করা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোর দায়িত্ব এখন শুধু ঐক্যের নয়, নতুন চেতনার রাজনীতি গড়ারও।

বিজয়ের আনন্দ দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয় তখনই—যখন আমরা ভুল মানুষকে বন্ধু ভাবি এবং ভুল সময়কে সঠিক বলি। এই ভুল যেন আর না হয়। ইতিহাস একাধিকবার আমাদের সুযোগ দিয়েছে। আরেকবার হয়তো দেবে না।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এএসএম



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews