ফারাজী আজমল হোসেন

কাবুল দখল করার পর তালেবানরা ঘোষণা করেছিল, সকলকে ক্ষমা করা হবে। আফগান নাগরিকদের ওপর কোনও শাস্তি বলবত হবে না। তাদের এই প্রতিশ্রুতি যে মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়, সেটা আগেই টের পেয়েছিলেন সেখানকার মানুষ। তাই প্রাণে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন অনেকে। পালাতে গিয়ে অনেকেই প্রাণও হারিয়েছেন। উড়ন্ত বিমান থেকে মানুষ পড়ার ভয়ঙ্কর দৃশ্য গোটা দুনিয়াকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।

আসলে তালেবানি প্রতিশ্রুতি যে মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়, সেটা আবারো প্রমাণ করলো। তালেবানদের আফগান জয়ের পর গোটা দেশে চলছে সন্ত্রাস, খুন, লুটপাট ও নৈরাজ্য। এমন কর্মকাণ্ড দেখেই বোঝা যায় কেন আফগানরা জীবন বাজি রেখে পালাবার চেষ্টা করেছিলেন। সাধারণ মানুষের তালেবানি ভীতি যে মোটেই অমূলক নয়, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে সন্ত্রাসের বহর দেখে। বিদেশী সেনাদের দোভাষী হিসাবে কাজ করা আফগানদের করা হচ্ছে মুণ্ডচ্ছেদ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূত্রের খবর, বিশ বছরে সন্ত্রাসের ধরন বদলালেও খুন বা অত্যাচারের বহর কমেনি। বদলেছে শুধু বাস্তব ছবিটা ঢেকে রাখার কৌশল। তাই আজও দেশ ছাড়তে উদগ্রীব সাধারণ আফগানরা। তাঁরা বাঁচতে চান তালেবানি জুলুম থেকে।

আসলে তালেবানরা মুখে যাই বলুক না কেন, গোটা দুনিয়া ইতিমধ্যেই টের পেয়েছে আফগানিস্তানে তাদের নৃশংস অত্যাচারের বহর। তারা যতোই বলুক না কেন, বিশ বছরে বদলে গিয়েছে তারা। কিন্তু বাস্তবে যে তাদের নৃশংসতা বিন্দুমাত্র কমেনি সেটা বোঝা যায় সাধারণ মানুষের দেশ ছাড়ার হিড়িকে। হেলিকপ্টারে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে অমানবিক অত্যাচারের ভিডিও গোটা দুনিয়াকে চমকে দিয়েছে। গতবার বিশ্বব্যাপি তাদের অত্যাচারের ভয়াবহতা জানতে পারলেও এবার পেশাদার জনসংযোগ সংস্থাকে নিয়োগ করে আসল সত্যি গোপন করছে তারা। মিডিয়ার কণ্ঠ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আফগান জনতা ও গোটা দুনিয়াকে বোকা বানাবার চেষ্টা করছে তালেবানরা। সম্প্রতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্কুলগামী ছাত্রীর ছবি প্রকাশ করে বোঝাতে চেয়েছে সবকিছু স্বাভাবিক চলছে। অথচ, নারীর শিক্ষা, পোশাক বা কাজ করার অধিকার নিয়ে বাস্তবের ছবিটা পুরো বিপরীত। শরিয়ত আইনের ভুল ব্যাখ্যা করে তালেবানরা ফের সন্ত্রাসের রাজত্বই কায়েম করেছে আফগানিস্তানে।

আফগানিস্তান জয়ে তালেবানদের দুটি লক্ষ্য ছিল। প্রথমটি ছিল বিদেশি সেনাকে দেশ থেকে অপসারিত করা। মার্কিন সেনা কাবুল ছাড়ার পরই তালেবানরা প্রথম লক্ষ্য পূরণে সাফল্য পায়। দ্বিতীয়ত, শরিয়ত আইন অনুযায়ী দেশ গঠন। কিন্তু তাদের এখনও বোধগম্য হচ্ছে না, সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি ও ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষদের অংশীদারিত্ব ছাড়া দেশ কখনও স্থিতিশীল হতে পারে না। আগামী দিনে আফগান কোন পথে এগোবে, তা নিয়েও কোনও সুস্পষ্ট চিন্তাভাবনার প্রকাশ নেই তালেবানদের কর্মসূচিতে। ধর্মের দোহাই দিয়ে এভাবে দেশ চলতে পারে না, এটাই বুঝতে নারাজ বন্দুকের শক্তিতে ক্ষমতা দখলকারীর দল।

১৯৯৫ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানি শাসনে গান-বাজনা, ঘুড়ি ওড়ানো, টিভি দেখা, ইন্টারনেট বা নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল। নারীদের শুধু সংসারের কাজ করাই ছিল একমাত্র কর্তব্য। পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বাইরে বের হওয়া মানা ছিলো। পুরুষদের দাড়ি রাখাটাও ছিল বাধ্যতামূলক। অমুসলিমদের সব অধিকারই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তালেবান শাসনামলে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অবাধ বিচরণ ভূমি হয়ে উঠেছিল আফগানিস্তান। ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়দার মতো জঙ্গিবাদীদের জন্য মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছিল তালেবানি আফগানিস্তান। এখনও একই ছবিই ফুটে উঠছে। সেখান থেকে পালিয়ে আসা আফগান মুসলিমরাই শোনাচ্ছেন, নতুন করে তালেবানি উত্থানের পর সেখানকার অমানবিক অত্যাচারের কথা।

তালেবান মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ অবশ্য সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নারীদের শিক্ষা বা কাজ করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। ইসলামি অনুশাসন মেনেই নারীর স্বাধীনতা রক্ষিত হবে। দুনিয়াকে বোঝাতে চাইছেন, তাদের চিন্তাভাবনা এখন অনেক বদলে গিয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ঠিক বিপরীত। কিছুই বদলায়নি তালেবান মানসিকতার। কিছুদিন আগে আফগানিস্তানের বিখ্যাত নারী রোবোটিক্স টিম-এর ৫ সদস্যা পালিয়ে মেক্সিকোয় এসে পৌঁছান। এই দলটি করোনা মহামারির সময় কম দামে ভেন্টিলেটর উদ্ভাবন করে জুটিয়ে নিয়েছিল আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এখন প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে রোবোটিক্স টিমের সেই নারী সদস্যরা জানিয়েছেন, ‘আফগানিস্তানের পরিস্থিতি কিছুই বদলায়নি। ২০ বছর আগে নারীদের প্রতি তাদের যেমন মনোভাব ছিল, এখনও তাই রয়েছে। আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে ওরা বোকা বানাচ্ছে।’

বিশ বছরে তালেবানদের মনোভাব বা হিংস্রতা বিন্দুমাত্র বদলায়নি। কাবুল দখলের আগেই তারা তাই মৌলভীদের কাছে ১৫ থেকে ৪৫ বছরের নারীদের তালিকা চেয়ে পাঠিয়েছিল তারা। তালেবান সেনারা এই নারীদের বিয়ে করবে। বিয়েতে অবশ্য নারীর ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই। মালালা পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত নারীবাদী কণ্ঠ পশতানা দুররানি তালেবানদের পরিবর্তন সম্পর্কে বলেন, ‘এই দানবদের বিয়ে করতে বাধ্য করা হচ্ছে নারীদের। সমস্ত রাজ্য থেকেই আমার কাছে রিপোর্ট আসছে। গত কয়েকদিনে আমার নিজের আত্মীয়রাও অনেকেই খুন হয়েছে।’

আসলে বেশির ভাগ তালেবানেরই প্রথাগত শিক্ষার বড় অভাব। তাদের কোনও উন্নত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও নেই। অনেকেরই চেতনা দক্ষিণ আফগানিস্তানের নির্জনতাতেই আবদ্ধ। বাইরের বদলে যাওয়া দুনিয়া তাদের কাছে এখনও অজানা এবং অচেনা। নারীর প্রতি তাদের কোনো সম্মান নেই। ধর্মশিক্ষার নামে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করে তারা হিংস্রতাকেই বাড়িয়ে দিয়েছে। তালেবান বেশিরভাগ সেনাই খুব উগ্র এবং অসহনশীল। বিশ বছর আগে ধর্মীয় অনুশাসনের নামে মুসলিমদের ওপরও তারা অমানবিক অত্যাচার চালিয়েছে। বহু মুসলিম নারী ও পুরুষ তালেবানদের হাতে বিনা অপরাধে খুন হয়েছেন। তাই ১৯৯০ সালের তালেবান উত্থান কিছুতেই ভুলতে পারেন না আফগানরা। সম্প্রতি কাবুল পতনের পর ফের সেই দিনগুলিই ফিরে এসেছে তাদের কাছে।

তালেবানদের বর্তমান নেতৃত্ব ২০০১ সালের বামিয়ান বধ্যভূমি থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছে। কিন্তু সেই হত্যাকাণ্ডের জন্য আজও ক্ষমাও চায়নি তারা। তালেবান মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদিনের সাফাই, বৌদ্ধদের কোনো অস্তিত্ব নেই আফগানিস্তানে। তাই ক্ষমা চাওয়ারও নাকি প্রশ্ন নেই। তবে হিন্দু ও শিখ আফগানদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতির কথা জানান তিনি। কিন্তু তার সেই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। প্রতিদিনই তালেবানরা হিন্দু ও শিখদের ওপর চড়াও হচ্ছে। আসলে কোনো শৃঙ্খলা নেই তালেবান শাসনে। কেউ কারও কথা শোনেনা, দেশজুড়ে চলছে অস্ত্রের শাসন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews