(৪ ঘন্টা আগে) ১২ আগস্ট ২০২৫, মঙ্গলবার, ৭:১২ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৭:২৮ অপরাহ্ন

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও লবণাক্ততা দিন দিন মানুষের জীবন ও অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলছে। ভবিষ্যতে বিএনপি যদি সরকার গঠন করে, তাহলে তাদের ৩১-দফা কর্মসূচির আলোকে জলবায়ু অভিযোজন ও টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানের দিকনির্দেশনা দেওয়া খুবই প্রয়োজন।

জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব এখন একটি বাস্তব রাজনৈতিক কর্তব্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও জনঘনত্ব,  প্রতি বর্গমাইলে ১,১১৯ জন (বিবিএস ২০২২), যা, দেশটিকে জলবায়ু দুর্যোগে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল করে তুলেছে। প্রতিবছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ, নদীভাঙন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো বহুমাত্রিক জলবায়ু ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে দেশটি, যার ফলে কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হচ্ছে। এ সংকট কেবল ব্যক্তি বা পরিবার নয় পুরো জাতির উন্নয়ন সম্ভাবনাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

জার্মানওয়াচের গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০২১ অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জলবায়ু দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে ছিল (Germanwatch, ২০২১)। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হতে পারে (World Bank Country Climate & Development Report, ২০২২)। এর প্রভাব কর্মসংস্থান, জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর পড়বে এবং জলবায়ু অভিযোজন ব্যবস্থার ঘাটতি সংকটকে আরও তীব্র করে তুলবে।

উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে, ২০২৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান, তাদের ৩১ দফার সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করেন (বিএনপি, ২০২৩)। সে ঘোষণায় ২৯ দফাতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোাগ মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ এবং নদী শাসন খাল খননের উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও  কর্মসূচির প্রশাসনিক সংস্কার (দফা ১১), সুশাসন (দফা ১৮), দুর্নীতি দমন (দফা ১৩), তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন (দফা ৩০) এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালীকরণের (দফা ২১) প্রতিশ্রুতিসমূহ জলবায়ু অভিযোজনের জন্য একটি কাঠামোগত ভিত্তি তৈরি করেছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে টেকসই ভবিষ্যতের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে।

বাংলাদেশের জলবায়ু বাস্তবতা আজ বহুমাত্রিক ও ভৌগোলিকভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ। ঢাকায় ২০২৩ সালে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গিয়েছিল (BMD, ২০২৩), যা শহরের ঘনবসতি, কংক্রিটের আধিক্য ও বৃক্ষহীনতার কারণে তৈরি শহুরে তাপ দ্বীপ প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ১৫০ ফুটের নিচে নেমে গেছে, যা কৃষি ও পানীয় জলের উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে (Ullah & Ahmed, ২০২৫)। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে কৃষিপণ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে (Haque, & Huq. ২০২৩), পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধ্বসের হার বেড়েছে এবং হাওর অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা কৃষিজ ফসল ধ্বংস করছে। ২০২২ সালে সিলেট ও সুনামগঞ্জে আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রায় ৭.২ মিলিয়ন মানুষ এবং মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬৭,৫৫০.৮৪ কোটি টাকা (Khan, et al., ২০২৪)। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক কর্মসূচির কেন্দ্রে জলবায়ুবিষয়ক উদ্যোগকে স্থান দেওয়া নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়; তবে কার্যকর অভিযোজন নিশ্চিত করতে হলে তা অবশ্যই কাঠামোগত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাস্তবায়নের উপযোগী হতে হবে। সেটি এখন দেখার বিষয়।

দুর্নীতি দমন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ সংক্রান্ত দফাগুলো বিশেষত দফা ১১, ১২ ও ৩০ দুর্নীতি দমন ও জবাবদিহিতা পরিবেশ প্রকল্পের স্বচ্ছ ও দক্ষ বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য। অতীতে জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্পে অনিয়মের অভিজ্ঞতা এই প্রয়োজনীয়তাকে আরও জোরদার করে। বিএনপির উচিত হবে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্পে স্বচ্ছতা, তদারকি ও প্রযুক্তিনির্ভর মনিটরিং, এবং স্থানীয় জনগণ ও বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে কিভাবে এ ধরনের ইস্যুসমূহ জবাবদিহিতামূলক হবে সে বিষয়ে এখনই রাজনৈতিক অঙ্গীকার করা। 

বিএনপি’র দফা ১০-এ স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, খাল পুনঃখনন, নদীভাঙন প্রতিরোধ ও জলাবদ্ধতা নিরসনের মতো কাজে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মডেলিং ও পূর্বাভাস ব্যবস্থার ব্যবহার কিভাবে হবে, তা এখন থেকেই জনগণকে জানানো উচিত। অতীতে এসব বিষয় শুধু ব্যানারে ছিল, বাস্তবে অগ্রগতি হয়নি। আমরা “ডিজিটাল বাংলাদেশ” শুনেছি, কিন্তু তা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার মতো ছিল এ বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা জরুরি।

তথ্যপ্রযুক্তি এবং ভূ-তথ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। বিএনপির ৩১ দফার ৩০ নম্বর দফায় প্রযুক্তিনির্ভর প্রশাসন, উন্মুক্ত তথ্যভার এবং অংশীদারিত্বমূলক পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে, যা জিওস্পেশিয়াল প্রযুক্তি, রিমোট সেন্সিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও আইওটির (IoT) সাহায্যে দুর্যোগ পূর্বাভাস, ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল শনাক্তকরণ এবং দ্রুত পুনরুদ্ধার পরিকল্পনায় বাস্তব ভিত্তি প্রদান করতে পারে। জলবায়ু অভিযোজন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির এই ব্যবহারকে আরও কার্যকর করতে বিএনপি তাদের রূপকল্পে ‘জাতীয় জিওডেটাবেইস সেন্টার’, ‘পাবলিক অ্যাকসেস ম্যাপিং প্ল্যাটফর্ম’ এবং ‘রিয়েলটাইম হ্যাজার্ড ড্যাশবোর্ড -এর মতো আধুনিক উদ্যোগ যুক্ত করতে পারে।

এই প্রযুক্তিনির্ভর পদক্ষেপগুলো সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি সমন্বিত জাতীয় ভূ-তথ্য নীতি এবং কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার প্রণয়ন অপরিহার্য। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় একটি “জাতীয় ভূ-স্থানিক বুদ্ধিমত্তা কেন্দ্র (Geospatial Intelligence Hub)” গড়ে তোলা যেতে পারে, যা নীতি নির্ধারণ, পরিকল্পনা ও তথ্য-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য, কৃষি, নগর পরিকল্পনা এবং শিক্ষা খাতে ভূ-তথ্যভিত্তিক সমাধান ও প্রশিক্ষণ প্রদান সম্ভব হবে। বিএনপির রূপকল্পে এই ধরনের উদ্ভাবনী ও প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ বাংলাদেশের জলবায়ু অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে। এ বিষয়ে এখনই জনগণের কাছে স্পষ্ট ও দৃঢ অঙ্গীকার পৌঁছে দিতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সমাজের দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর সবচেয়ে বেশি পড়ে। বিএনপি’র দফা ২০, ২৪, ২৭ ও ৩১-এ দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক নিরাপত্তা ও কৃষি অভিযোজনের যে প্রস্তাবনা এসেছে তা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অভিযোজন কাঠামো গঠনে সহায়ক হতে পারে। আবার সেটি কোন প্রক্রিয়ায় করা হবে, সে বিষয়েও স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা জরুরি। পাশাপাশি, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য আবাসন, সুপেয় পানি, পরিচ্ছন্ন শক্তি এবং জীবন-জীবিকাভিত্তিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করারও নির্দেশনা থাকতে হবে।
তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ ছাড়া জলবায়ু অভিযোজন ও প্রযুক্তিনির্ভর রূপান্তর কল্পনা করা যায় না। বিএনপি’র দফা ১৫ ও ২১-এ বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও সবুজ অর্থনীতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ক্লাইমেট ইনোভেশন হাব, গ্রীন স্কিল ট্রেইনিং, পরিবেশ উদ্যোক্তা বিকাশ ও স্টার্ট-আপ ইনকিউবেশন সেন্টার গঠনের মধ্য দিয়ে তরুণদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা সম্ভব। এতে তারা কেবল চাকরি প্রত্যাশী নয়, বরং অভিযোজন সক্ষমতার উদ্যোক্তা হয়ে উঠবে।

একটি জলবায়ু-সহনশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গঠন ও জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। বিএনপি যদি তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে জলবায়ু বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়, তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থ, প্রযুক্তি ও জ্ঞান আহরণের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘের ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনে (COP27) গৃহীত ‘ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ তহবিল’ জলবায়ু ক্ষতির জন্য অর্থপ্রাপ্তির একটি নতুন পথ খুলে দিবে (UNFCCC, ২০২২)। এছাড়া, কার্বন মার্কেট ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সৌরশক্তি, জৈবসার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ইটভাটা সংস্কারের মতো খাতে বৈদেশিক সহায়তা অর্জন সম্ভব। এর জন্য জাতীয় কার্বন অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম ও প্রযুক্তি বিনিময় চুক্তির প্রতি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি জরুরি। জাতি আশা করে, এ ধরনের বিষয়ে বিএনপি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

এই উদ্যোগগুলো সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য বিএনপি একটি দলীয় ‘জলবায়ু ও পরিবেশ সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি’ গঠন করতে পারে, যেখানে গবেষক, বিশেষজ্ঞ ও তরুণরা থাকবেন। এছাড়া, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ‘ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন টাস্কফোর্স’, ‘ক্লাইমেট ইনোভেশন হাব’ এবং ‘আন্তর্জাতিক সংলাপ সেল’ গঠন করে সংস্কার বাস্তবায়নের কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। এতে একটি জলবায়ু-দায়বদ্ধ, প্রযুক্তিনির্ভর ও ভবিষ্যতমুখী রাষ্ট্র গঠনের চিত্র তৈরি হবে।
 

লেখক: অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কনভেনর, সাদা দল, আর্থ এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews