সাম্প্রতিক সুয়াইদা সঙ্ঘর্ষ এবং ইসরাইলের ধারাবাহিক বিমান হামলার প্রেক্ষাপটে সিরিয়ার সরকারের সামনে এখন এক জটিল বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে। একদিকে অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত, অন্যদিকে বহিরাগত সামরিক উত্তেজনা। এই দুই চাপে সিরিয়া তার ভূখণ্ডের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে চায়। তবে বিশেষজ্ঞরা একমত যে ইসরাইলি হামলার মুখে সিরিয়ার বিকল্পগুলো সীমিত এবং জটিল।
সামরিক প্রতিক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা
সামরিক বিশেষজ্ঞ ফায়েজ আল-আসমার আল জাজিরাকে জানান, ইসরাইলি গুণগত ও পরিমাণগত শ্রেষ্ঠত্ব এবং সিরিয়ার সামরিক সক্ষমতার পতনের কারণে সামরিকভাবে ইসরাইলের মুখোমুখি হওয়া বাস্তবসম্মত নয়। পূর্ববর্তী সরকার থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ৮৫ শতাংশ কৌশলগত সামরিক শক্তি ইতোমধ্যে ইসরাইলি হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই সামরিক উত্তেজনায় জড়ালে তা হবে ‘পরাজয়মূলক প্রস্তাব’, যার ফলে আরো ধ্বংস ও দুর্ভোগ নেমে আসবে সিরিয়ার জনগণের ওপর।
অভ্যন্তরীণ ফ্রন্ট ও রাষ্ট্র গঠনের বিকল্প
প্রেসিডেন্ট আহমদ আল-শারা তার সাম্প্রতিক ভাষণে ইসরাইলের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিলেও তিনি সামাজিক ঐক্য ও অভ্যন্তরীণ সংহতির উপর জোর দিয়েছেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাষ্ট্র গঠন ও অভ্যন্তরীণ বিভাজন প্রশমনের মাধ্যমেই সিরিয়া তার প্রতিরক্ষা সুসংহত করতে পারে।
এড্রাক সেন্টার ফর স্টাডিজ অ্যান্ড কনসালটেশনের পরিচালক বাসিল হাফফার বলেন, বিদেশী হস্তক্ষেপ রোধে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা অর্জনে সর্বোত্তম কৌশল হলো অভ্যন্তরীণ বিভাজন দূর করা এবং একটি সুসংহত জাতীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এতে রাষ্ট্র কেবল নিরাপত্তাগতভাবে নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সুদৃঢ় হবে।
কূটনৈতিক বিকল্প ও আঞ্চলিক মধ্যস্থতা
জুসুর সেন্টার ফর স্টাডিজের গবেষক ওয়ায়েল আলওয়ান জানান, সরাসরি সামরিক উত্তেজনার পরিবর্তে সিরিয়ার জন্য সবচেয়ে কার্যকর বিকল্প হলো বৈদেশিক কূটনীতিকে সক্রিয় করা। তুরস্ক, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও আজারবাইজানের মতো প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যস্থতায় আঞ্চলিক উত্তেজনা প্রশমিত করার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, সিরিয়ার উচিত আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর অবস্থান বিবেচনায় রেখে সংযত কূটনৈতিক অবস্থান নেয়া এবং কোনো উস্কানিমূলক পদক্ষেপ পরিহার করা। এছাড়া কেবল যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার ওপর নির্ভর না করে আরো বিস্তৃত কূটনৈতিক প্রচারণায় যাত্রা করা জরুরি।
জনমত ও অভ্যন্তরীণ সংলাপ
সামরিক বিশ্লেষক আম্মার ফারহুদ বলেন, সিরিয়ার সরকার এখন যেসব বিকল্প বিবেচনা করছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জনমতকে সংগঠিত করা এবং ইসরাইলি হস্তক্ষেপের বিপদ সম্পর্কে দেশবাসীকে সচেতন করা। একইসাথে সরকারবিরোধী দলগুলোর সাথে জাতীয় সংলাপ পুনরায় শুরু করে প্রশাসনে তাদের অন্তর্ভুক্তির পথ খুলে দিতে পারে, যাতে ইসরাইল বা অন্য কোনো শক্তি হস্তক্ষেপের অজুহাত না পায়।
তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও জাতীয় সংহতির মাধ্যমে সামরিক বাহিনী এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রতিনিধিত্বমূলক করে গড়ে তোলাই ইসরাইলি হুমকির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরক্ষা কৌশল হতে পারে।
সমঝোতা ও যুদ্ধবিরতির কৌশল
সাম্প্রতিক সুয়াইদা সঙ্ঘর্ষের পর সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনী এলাকাটি থেকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করেছে এবং যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। স্থানীয় দল এবং দ্রুজ আলেমদের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে সিরিয়া এখন প্রকাশ্য সঙ্ঘর্ষের চেয়ে অভ্যন্তরীণ সমঝোতার পথে হাঁটছে।
প্রেসিডেন্ট আল-শারাও তাঁর ভাষণে এই কৌশলগত মনোভাবকে প্রতিফলিত করে বলেন, ‘আমাদের ভূমিতে অন্যদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কোনো স্থান নেই... আমাদের জাতীয় স্বার্থই সর্বাগ্রে।’ বিশ্লেষকদের মতে, এটাই বর্তমান বাস্তবতায় সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও ব্যালান্সড কৌশল।
সিরিয়া বর্তমানে যে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তা নিরসনে সামরিক উত্তেজনা নয় বরং অভ্যন্তরীণ সংহতি, আঞ্চলিক কূটনীতি এবং রাষ্ট্র গঠনের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর পথ। যদিও ইসরাইলি হামলা একটি বড় হুমকি। তবে রাষ্ট্রের ভেতরে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেই সেই হুমকির মোকাবিলা করতে চায় বর্তমান সিরিয়ান নেতৃত্ব।
সূত্র: আল জাজিরা নেট