এমপিওভুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে শিক্ষক যদি নকল ধরার বদলে চোখ বন্ধ করে থাকেন, খাতায় কোনমতে লেখা দেখলেই নম্বর দেন– সেই দায় কি রাষ্ট্রের ওপর বর্তায় না? ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
এমপিওভুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে শিক্ষক যদি নকল ধরার বদলে চোখ বন্ধ করে থাকেন, খাতায় কোনমতে লেখা দেখলেই নম্বর দেন– সেই দায় কি রাষ্ট্রের ওপর বর্তায় না? ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়– প্রশ্ন হলো, সেই মেরুদণ্ড ভেঙে পড়লে আমরা দায় চাপাই কার ওপর? শিক্ষক? ছাত্র? বলাবাহুল্য দায়টা এই দুই শ্রেণীর ওপরই চাপানো হয়। না; আসল দায় যার, সেই রাষ্ট্রের দিকে আমাদের আঙুল যায় না বললেই চলে। অথচ শিক্ষার এই সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে আজ রাষ্ট্র নিজেই।
প্রতিবছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় এলে এক অলিখিত ‘উৎসব’ শুরু হয়– নকল, প্রশ্নফাঁস, শিক্ষক-কেন্দ্র সচিব বহিষ্কার, ফল প্রকাশে জিপিএ:৫-এর বন্যা। আবার পরদিনই সংবাদমাধ্যমে চরম হতাশা: ‘শিক্ষার মান কোথায় গেল?’ অথচ এ সবের কেন্দ্রে শিক্ষকরা যেভাবে কাঠগড়ায় দাঁড়ান, তেমন করে কেউ রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা বা চরম অসঙ্গতির দিকে তাকায় না।
প্রশ্ন হলো, কেন শিক্ষক নকলকে প্রশ্রয় দেন? কেন তিনি ‘অনৈতিকতা’য় জড়িয়ে পড়েন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হবে সমস্যার শেকড়ে– রাষ্ট্রের আরোপিত চাপ, বৈষম্যমূলক নীতিমালা এবং অপেশাদার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে।
বিশেষ করে মফস্বলের হাজার হাজার বেসরকারি শিক্ষক যে বাস্তবতার মধ্যে দিনাতিপাত করেন, তা কল্পনারও অতীত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত রাখতে বোর্ড পরীক্ষায় নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষার্থীকে পাশ করানো তাদের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। ‘৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী যদি পাশ না করে, এমপিও বন্ধ’– এমন নির্মম ও অমানবিক শর্ত শিক্ষকদের দাঁড় করিয়ে দেয় এক ভয়াবহ নৈতিক সংকটে। শিক্ষক তখন আদর্শ নয়, পেটের দায়ে সিদ্ধান্ত নেন। নকল ধরার বদলে চোখ বন্ধ করেন, খাতায় কোনমতে লেখা দেখলেই নম্বর দেন। কারণ তিনি জানেন, সন্তানের স্কুল ফি বা পরিবারের বাজার খরচ নির্ভর করছে এই পরীক্ষার ফলাফলের উপর।
শুধু কি এমপিওর চাপ? বোর্ড কর্তৃপক্ষ অনেক সময় খাতা মূল্যায়নের মৌখিক নির্দেশ দেয়– ‘সবাইকে পাশ করিয়ে দিতে হবে।’ মানে, রাষ্ট্র নিজেই শিক্ষকের হাতে তুলে দেয় ‘অসততা’র ছুরি, পরে সেই শিক্ষকের গলায় ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়ে দেয়। এটি নিছক দ্বিচারিতা নয়, এটি শিক্ষাকে ধ্বংস করার রাষ্ট্রীয় নীলনকশা।
আজকের বাস্তবতায়, অনেক শিক্ষার্থী জানে– যদি পরীক্ষার খাতায় কিছু লিখে আসে, তাহলে পাশ নিশ্চিত। ফলে তারা পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারায়, পাঠ্যপুস্তক তাদের কাছে জেলখানার গাইডবই। আর জিপিএ-৫? সেটা এখন আর কৃতিত্বের প্রতীক নয়, বরং এক প্রাতিষ্ঠানিক ভেলকিবাজির ফল। অথচ এই শিক্ষার্থীরাই একদিন হয়ে উঠবে রাষ্ট্রের নেতৃত্ব। কল্পনা করা যায়, যখন দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে থাকা নেতৃত্ব গঠিত হবে এই অর্ধশিক্ষিত, চাতুর্যময় মূল্যবোধশূন্য প্রজন্ম দিয়ে– তখন আমাদের রাষ্ট্রের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
এই দুঃসময়ের সবচেয়ে করুণ চরিত্র হচ্ছে শিক্ষক। একজন শিক্ষকের কাজ শিক্ষাদান, চরিত্র গঠন, আলোকিত মানুষ গড়া। কিন্তু যখন তাকে এমন এক কাঠামোর মধ্যে ফেলে রাখা হয় যেখানে ‘সততা মানে চাকরি হারানো, আর অনৈতিকতা মানে চাকরি বাঁচানো’– তখন তার দায় কতটা আর ব্যক্তিগত থাকে?
এখানেই রাষ্ট্রের ভূমিকা অনিবার্য। রাষ্ট্র যদি চায় শিক্ষক আবার আদর্শবান হোক, তাহলে তাকে আগে নিজের চেহারা আয়নায় দেখতে হবে। কারণ পচন শুরু হয়েছে ওপর থেকে, নিচে নয়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অশিক্ষিত নেতৃত্ব, নীতি নির্ধারণে স্বজনপ্রীতি– এসবই আজ শিক্ষার সবচেয়ে বড় শত্রু।
তাই সমাধান চাইলে শুধু শিক্ষক নয়, গোটা শিক্ষানীতিকেই ঢেলে সাজাতে হবে। প্রথমত, অবিলম্বে বাতিল করতে হবে ‘পাশ-ফেল নির্ভর এমপিও’র মতো কালো আইন। শিক্ষককে নিশ্চিত করতে হবে, তিনি ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়িত হবেন না। তিনি যেন মুক্ত মনে শিক্ষা দিতে পারেন এবং রাষ্ট্র তার পাশে থাকবে– এই নিশ্চয়তা দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, রাজনীতিকে শিক্ষিত নেতৃত্বের অধীন করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত- প্রতিটি জনপ্রতিনিধির জন্য ন্যূনতম গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করতে হবে। গণ্ডমূর্খ, দখলবাজ, সুবিধাবাদীরা যেন আর রাজনীতির নামে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিতে না পারে। তবেই ছাত্ররাজনীতি হবে আদর্শিক, দেশপ্রেমভিত্তিক। নইলে রাজনীতি হবে শিক্ষার শত্রু, জাতির দুর্ভাগ্য।
তৃতীয়ত, শিক্ষা প্রশাসনে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রশ্নফাঁস, খাতা মূল্যায়নে দুর্নীতি কিংবা নীতিনির্ধারণে অস্বচ্ছতা– এসব বন্ধ না হলে নিচের কোনো সংস্কারই দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি এগোয় না- এ সত্য আমরা মুখে বলি, কিন্তু কাজে দেখাই না। এই আত্মপ্রবঞ্চনার সময় শেষ। এখনই যদি শিক্ষাকে মুক্ত করে না তোলা হয় রাষ্ট্রীয় শর্ত আর সংকীর্ণ রাজনীতির শৃঙ্খল থেকে, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ কেবল ব্যর্থতা আর মেধাশূন্য নেতৃত্বে ভরা এক বিষাদগ্রস্ত জাতি হবে।
এখনও সময় আছে। রাষ্ট্র চাইলে এই অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব। কিন্তু যদি রাষ্ট্র নিজের দায় এড়িয়ে শুধু শিক্ষকদের শাস্তি দিয়ে আত্মতৃপ্ত থাকে, তবে ভবিষ্যতের ইতিহাসে লেখা থাকবে– ‘এই জাতি নিজের শিক্ষাকে গলা টিপে মেরেছিল।’