টাইমস স্কয়ারে এনআরবি ওয়ার্ল্ডওয়াইডের আয়োজনে বৈশাখ উদযাপন, মঙ্গল শোভাযাত্রা, শতকণ্ঠে শিশুদের পরিবেশনা। গত বছরের এই ছবিটি মহীতোষ তালুকদার তাপসের ফেইসবুক থেকে নেওয়া।
টাইমস স্কয়ারে এনআরবি ওয়ার্ল্ডওয়াইডের আয়োজনে বৈশাখ উদযাপন, মঙ্গল শোভাযাত্রা, শতকণ্ঠে শিশুদের পরিবেশনা। গত বছরের এই ছবিটি মহীতোষ তালুকদার তাপসের ফেইসবুক থেকে নেওয়া।
১.
সেই চার দশক আগের কথা। দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র এলাম। লেখাপড়া করতে। হয়ে গেলাম প্রবাসী। বড্ড ইচ্ছে হতো, মায়ের সঙ্গে কথা বলতে আর দেশের কথা জানতে। তখন ইন্টারনেট ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি বাংলাদেশে ফোন করা যেত না। টিঅ্যান্ডটিতে কল বুক করে বসে থাকতাম। চার-পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর হয়তো কাঙ্ক্ষিত শব্দ শুনতে পাওয়া যেত, অপর পাড়ে অপারেটরের সোনালি কণ্ঠ– ‘বাংলাদেশের লাইন দিচ্ছি, কথা বলুন।’
–হ্যালো হ্যালো হ্যালো, মা? মা? মা?
না, অন্যদিকে আমার মায়ের গলা নয়। কেমন ঝন ঝন যান্ত্রিক আওয়াজ। কত পরিচিত আমার মায়ের সেই মধুর কণ্ঠ– 'খোকা খোকা খোকা।’ আরও কয়েক বার ‘হ্যালো হ্যালো’ করার পর, ধপ করে টেলিফোনটা রেখে দিলাম।
প্রবাসে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ সেই নীল জামাপরা লোকটা, যার জামার হাতে আটা রয়েছে ইউএসপিএসের একটা মনোগ্রাম। ইউনাইটেড স্টেটস পোস্টাল সার্ভিসের সেই লোকটা প্রতিদিন অনেক চিঠি-পত্র নিয়ে আসেন, রেখে যান দোরগোড়ায়। আমেরিকার বড় বড় কোম্পানির চোখ ঝলসানো বিজ্ঞাপনী চিঠিগুলোর ফাঁকে কখনো কখনো লুকিয়ে থাকত বহু দেশ ঘুরে আসা একটা ছোট্ট হলুদ মলিন এনভেলাপ। দেখলেই আমি চিনতে পারতাম, আমার মায়ের চিঠি। আমার প্রবাসী জীবনে স্বদেশের ছায়া পড়ে– আমার মায়ের ছায়া, স্বজনদের ছায়া। সেই ছোট্ট একটা এনভেলাপ, আমার অতি কাছে নিয়ে আসে আমার বাংলাদেশকে।
তখন আরো একটা এনভেলাপ আমার মনে বড্ড দোলা দিত, পাবলিশার্স ক্লিয়ারিং হাউসের লটারির সেই লম্বা খামটা, যার মাঝে আমি প্রতিনিয়ত শুনতে পেতাম এক মিলিয়ন ডলারের ঝন্ঝনে আওয়াজ। বার বার হাত বুলিয়ে দেখতাম এক মিলিয়ন ডলারের সেই চেকটা, যাতে বড় বড় করে লেখা রয়েছে আমার পুরো নামটা। মনে মনে ভাবতাম, এই চেকটা যদি সত্য হয়, কেমন হবে আমার এই প্রবাসী জীবন?
আমেরিকাতে আমরা পরবাসী। প্রবাসের আলো-ঝলমল সোনালি স্বপ্নের ফাঁকে ফাঁকে মনটা অন্ধকারে মুষড়ে উঠত, চলে যেত নিজের দেশের ছায়াতে। বারে বারে মনে পড়ত স্বজনদের কথা। আটলান্টিকের সমুদ্র সৈকতের নরম বালিতে হেঁটে যাওয়া নিখুঁত মাপে গড়া সোনালি চুলের তরুণীদের পদচিহ্ন অনুসরণ করেও শান্ত হতো না আমার ক্লান্ত মন। এরা কেউতো বনলতা সেন নন। পাখির নীড়ের মতো সেই নিরাপদ চোখের আশ্বাস যে তাদের চোখে নেই।
২.
ইতোমধ্যে বেশ সময় গড়িয়ে গেছে। বিদেশে লেখাপড়া শেষ করে আমি কর্মজীবনে আছি অনেকদিন, এখানকার নাগরিকও। সময় পাল্টেছে। কিন্তু মায়ের টান ও দেশের টানে ভাটা পড়েনি। নতুন দশক নিয়ে এসেছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। বাংলাদেশ এখন অনেক কাছে এসে গেছে। মায়ের সঙ্গে কথা বলি যখন-তখন, যখনই মন চায়। ইন্টারনেটের বদৌলতে টেলিফোন করা এখন খুব সহজ, বাংলাদেশের টেলিভিশন দেখা যায়, দেখি যখনই সময় পাই। দেশের সব খবর পেয়ে যাই বিদ্যুৎগতিতে। আমার সন্দ্বীপের হাসু মামা শুনতে পাওয়ার আগেই আমি পেয়ে যাই ঢাকা চিড়িয়াখানার সুন্দরী চিতার মৃত্যুসংবাদ। ইন্টারনেটের সৌজন্যে আমি প্রতিদিন পড়ি বাংলাদেশের অনেকগুলো সংবাদপত্র। দেশে যাবার বাড়তি খরচ ক্রেডিট কার্ড ভাঙিয়ে রাতারাতি মিলে যায়।
আর হ্যাঁ, পাবলিশার্স ক্লিয়ারিং হাউসের সেই লম্বা খামটা আমি আর খুলি না, ছুঁড়ে ফেলে দিই গার্বেজে। নীল জামাপরা সেই ডাকপিয়ন এখনো সাদা জিপ হাঁকিয়ে আসেন আমার দোরগোড়ায়। যদিও দেখা হলে, ‘হাই-হ্যালো’ বলি, তবে তেমন আপন মনে হয় না সেই আগেকার দিনের মতন। আমি আর নিজেকে পুরাপুরি পরবাসী ভাবি না। এখন আমি কিছুটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এদেশীও বটে।
আমরা অনেক বাংলাদেশী পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি জীবিকার প্রয়োজনে। আমরা প্রবাসী। দূরে থাকি, কিন্তু কখনো বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করিনি। বাংলাদেশকে মনে-প্রাণে ধারণ করেই আমরা বিদেশে আছি। প্রবাসীদের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে বৈশ্বিক অর্থনীতি। আমরা এখন বৈশ্বিক, প্রবাসী এবং অবশ্যই বাংলাদেশীও। বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে প্রবাসীদের ভাগ্য ও দেশপ্রেম। প্রবাসী, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রাই দেশের অর্থনীতির একটি মূল চালিকাশক্তি। ইন্টারনেট ও সর্বাধুনিক জেট ইঞ্জিনের কল্যাণে পৃথিবীটা অনেক ছোট হয়ে গেছে। ভৌগোলিক দূরত্ব আগের মতো বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে না। বাংলাদেশ এখন প্রবাসীদের অনেক কাছে।
আমরা বিদেশেও ডাল-ভাত খাই। ইলিশ মাছ পছন্দ করি। অবসরে রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীত শুনি। একুশের সকালে আমরা গলা মিলিয়ে গাই– ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?’ বিদেশেও আমরা ঈদ করি, করি দুর্গাপূজা। আমরা নিউইয়র্কে বসে টিভিতে বাংলা নাটক দেখি। ছুটির দিনে আমরা বন্ধুদের বাসায় আড্ডা দিই। জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী– এইসব পার্টি লেগেই থাকে। মাঝে মাঝে হয় পটলাক– খাবার আসে প্রতি পরিবার থেকে, সবাই মিলে উপভোগ করি। বাংলাদেশ থেকে শিল্পীরা আসেন, প্রবাসীরা দল বেঁধে যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করতে।
আর হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই রাজনীতি করি। যতটা না ডেমোক্রেটিক, রিপাবলিকান, লেবার বা কনজারভেটিভ, তার চেয়ে বেশি আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি। বিদেশেও আমরা মুর্দাবাদ ও জিন্দাবাদ স্লোগান দিই। দেশ থেকে নেতারা বিদেশে এলে, আমরা ফুলের মালা নিয়ে এয়ারপোর্টে যাই, তাদেরকে বরণ করতে। আবার যাদেরকে পছন্দ নয়, কালো পতাকা দিয়ে তাদের বিরোধিতা করি।
আমরা সমিতি গড়ি, সমিতি ভাঙি। বিদেশেও আমরা মোহামেডান, আবাহনী বানিয়ে ফুটবল খেলি। খেলায় গোল হলে মারামারি করি, না হলেও করি। এখন আমরা ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেট নিয়ে বেশি মাতামাতি করি, বাংলাদেশের খেলা রাত জেগে শেষ বল পর্যন্ত দেখি। বাংলাদেশ হেরে গেলে, খেলোয়াড়দের খুব খারাপ ভাষায় সমালোচনা করি, দলে সাকিব আল হাসানের মতো তারকা থাকলে তার প্রতি খুব মন খারাপ করি, প্রতিজ্ঞা করি আর দেখব না বাংলাদেশের ক্রিকেট। পরের খেলায় আবার একহাতে কফির মগ এবং অন্য হাতে রিমোট নিয়ে টিভির সামনে বসি।
বাঙালির আড্ডার ঐতিহ্য আমরা বিদেশেও টিকিয়ে রাখছি, আমরা জ্যাকসন হাইটস বা চার্লস ম্যাকডোনাল্ডে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিই। হার্ভার্ড স্কয়ারে মানববন্ধন করি, বিক্ষোভে মিলিত হই। আমাদের যতজন, তত মত– কারো কথা কেউ শুনতে চাই না। নিউ ইয়র্ক, টরন্টো, লন্ডন থেকে আমরা বাংলা পত্রিকা বের করি, করি সাহিত্যসভা এবং বইমেলা। গ্রীষ্মকালে আমরা দলবেঁধে পিকনিকে যাই, একই লোক একই খাবার। ভিন্ন ভিন্ন ব্যানারে দলবেঁধে স্টেট পার্কগুলোতে ঘুরে বেড়াই।
আমরা প্রতি বছর, না পারলে বছর দুয়েক পর বাংলাদেশে যাই। ছুটির চেয়েও বাড়তি কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে আসি মিষ্টির বাক্স হাতে করে। এয়ারপোর্ট, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের ঝঞ্ঝাট মিটিয়ে আবার ফিরে আসি প্রবাসী জীবনে। আমাদের জাতীয় চরিত্রের সব বৈশিষ্ট্য আকঁড়ে ধরে রেখে আমরা এখন প্রবাসী। আমরা যেখানেই যাই, সেখানেই গড়ে তুলি এক খণ্ড বাংলাদেশ।
৩.
প্রবাসীরাই বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তাদের কষ্টার্জিত অর্থে আজকাল বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভরপুর থাকে। বাংলাদেশকে আগের মত অর্থ সাহায্যের জন্য প্রতিনিয়ত দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছে ধরনা দিতে হয় না।
গত কয় বছর ধরে প্রতি বছর বাংলাদেশী প্রবাসী কর্মজীবী মানুষরা বাংলাদেশে গড়ে ২২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়েছেন, যা বিদেশী দাতা দেশগুলোর সাহায্যের চেয়ে ৬ গুণেরও বেশি। দেশের জিডিপির প্রায় ৫ শতাং আসে প্রবাসীদের পাঠানো টাকা থেকে। বাংলাদেশে ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের শতকরা ৩০ ভাগই ব্যয় করা হয় বিদেশী পণ্য আমদানিতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৩ সালের তথ্যনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাংলাদেশী প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি অর্থ দেশে পাঠিয়ে থাকে– ৮৬৭.৩১ মিলিয়ন ডলার, যা মোট অংকের ১৫.৬৫ শতাংশ, এরপরে সৌদি আরব ৮৫৩.৭৮ মিলিয়ন ডলার, যা ১৫.৪১ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসীরা মোট অংকের ১৫.৬ শতাংশ পাঠিয়ে থাকেন।
যে প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখছেন, তারা এখনও বাংলাদেশে দারুণভাবে অবহেলিত। সংসারের পুরুষেরা যখন বিদেশে চলে যান, তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর নানাভাবে নিপীড়ন চালানো হয়। যখন প্রবাসীরা চাকরি হারিয়ে দেশে চলে আসেন, তাদের কর্মসংস্থানের এমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা করা হয় না। বিদেশেও বিপদ-আপদে সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মীরা প্রবাসীদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করেন না। এই ধরনের অনেক অভিযোগ প্রবাসীদের।
প্রবাসীদের প্রতিও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।একজন বিক্ষুব্ধ প্রবাসীর চেয়ে একজন সুখি প্রবাসী জাতীয় উন্নয়নে অনেক বেশি অবদান রাখতে পারেন।