বন্ড সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। বন্ড ইস্যু করে ঋণ নেওয়া হয়। বন্ডের ক্রেতা হচ্ছেন ঋণদাতা। আর বন্ড ইস্যুকারী হচ্ছেন ঋণগ্রহীতা। শেয়ারের মতো বন্ডেরও প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি মার্কেট আছে। আমাদের দেশে নানা কারণে কার্যকর বন্ডমার্কেট এখনো গড়ে ওঠেনি। ট্রেজারি বিল ও বন্ড : সরকার যে বন্ড বাজারে ছাড়ে তাকে ট্রেজারি বন্ড বলে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প, বিশেষ করে বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প অর্থায়নের জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ফান্ডের দরকার হয়। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দুই দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের আলাদা নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। এটা হচ্ছে প্রাইমারি মার্কেট। প্রাইমারি ডিলাররা এতে অংশ নেন। বর্তমানে ২১টি ব্যাংক প্রাইমারি ডিলার হিসেবে কাজ করছে। সেকেন্ডারি মার্কেটে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের কেনাবেচা এখনো তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মেয়াদ : ট্রেজারি বিল স্বল্পমেয়াদি হয়। মেয়াদ এক বছরের কম। বর্তমানে ১৪, ৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল বাজারে চালু আছে। পক্ষান্তরে, ট্রেজারি বন্ড দীর্ঘমেয়াদি। বর্তমানে ২, ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড বাজারে প্রচলিত আছে।
বিনিয়োগের পরিমাণ : ১ লাখ টাকা বা এর গুণীতক যে কোনো অঙ্কের অভিহিত মূল্যের সমপরিমাণ সরকারি ট্রেজারি বিল বা বন্ডে বিনিয়োগ করা যায়।কারা কিনতে পারেন : বাংলাদেশে নিবাসী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারেন। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যাংক, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা কোম্পানি, করপোরেট প্রতিষ্ঠান, ভবিষ্যৎ তহবিল, পেনশন তহবিল ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া অনিবাসী বা বিদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শুধু ট্রেজারি বন্ড কিনতে পারেন।
কীভাবে কিনতে পারেন : যে কোনো তফসিলি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘সিকিউরিটিজ হিসাব’ খুলতে হবে। ওই ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ট্রেজারি বিভাগের সহায়তায় প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে ট্রেজারি বিল বা বন্ড কেনা যাবে। প্রয়োজনে মেয়াদ পূর্তির আগেই সেকেন্ডারি মার্কেটে প্রাইমারি ডিলার, অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে তা বিক্রি করা যাবে।
ট্রেজারি বন্ডের সুদ : ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার বা ‘কুপন রেট’ বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত নিলামে ইলেকট্রনিক বিডিং সিস্টেমের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। সুদের হার বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ‘মনিটরি পলিসি অ্যান্ড অপারেশন্স’ লিঙ্কে দেখানো আছে। ট্রেজারি বন্ডের সুদ প্রতি ছয় মাস অন্তর পরিশোধ করা হয়। অন্যদিকে, ট্রেজারি বিল ফেস ভ্যালু বা অভিহিত মূল্য থেকে কম মূল্যে (ডিসকাউন্ট) ইস্যু করা হয়। মেয়াদ পূর্তিতে ক্রেতা অভিহিত মূল্য ফেরত পান। ট্রেজারি বিল বা বন্ডের সুদ আয়ের ওপর কোনো উৎসে কর কর্তন করা হয় না। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রের মতো ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা ট্রেজারি বিল বা বন্ডে বিনিয়োগের ওপর ট্যাক্স রিবেট সুবিধা পান।
করপোরেট বন্ড : কোনো কোম্পানি প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা পরিপালন সাপেক্ষে বন্ড ইস্যু করে বাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করতে পারে। এ ধরনের বন্ডকে বলা হয় করপোরেট বন্ড। আমাদের দেশে করপোরেট বন্ডের প্রচলন তেমন একটা নেই। ইদানীং কয়েকটি ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাজারে সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ছেড়ে মূলধন সংগ্রহ করেছে। পরিশোধের দিক থেকে সাব-অর্ডিনেটেড বন্ডধারীদের অবস্থান কোম্পানির ঋণদাতাদের মধ্যে সবার নিচে।
অধিকাংশ বন্ডের নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। কনভার্টিবল বন্ড নির্দিষ্ট সময় পর শেয়ারে রূপান্তরিত হয়। ইস্যুর শর্ত মোতাবেক কনভার্টিবল বন্ড আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে শেয়ারে রূপান্তরযোগ্য হতে পারে। নন-কনভার্টিবল বন্ডকে শেয়ারে রূপান্তর করা যায় না। কিছু বন্ড আছে যার মেয়াদ নির্দিষ্ট নয়। একে পারপিচুয়াল বন্ড বলে। জিরো কুপন বন্ড অভিহিত মূল্যের কম মূল্যে ইস্যু করা হয়। মেয়াদ শেষে বিনিয়োগকারী অভিহিত মূল্য ফেরত পান। ডিসকাউন্টে এ বন্ড ইস্যু করা হয় বলে একে ডিসকাউন্ট বন্ডও বলা হয়। রিডিমেবল বন্ডের ক্ষেত্রে নিয়মিত বিরতিতে সুদসহ বন্ডের মূল টাকার অংশবিশেষ পরিশোধ করা হয়। এভাবে মেয়াদ পূর্তিতে এটা সম্পূর্ণ পরিশোধিত হয়ে যায়।
করপোরেট বন্ডের সুদ : করপোরেট বন্ডের ওপর নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করা হয়। সাধারণত ছয় মাস অন্তর সুদ দেওয়া হয়। কিউমুলেটিভ বন্ডের ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে চক্রবৃদ্ধি সুদসহ আসল টাকা একবারে প্রদান করা হয়। পারপিচুয়াল বন্ডের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় পরপর সুদহার পরিবর্তন হয়। জিরো কুপন বন্ড অভিহিত মূল্য থেকে কম মূল্যে ইস্যু করা হয় বিধায় কোনো সুদ দেওয়া হয় না।
বন্ডের বাজার দর : সেকেন্ডারি মার্কেটে বন্ডের বাজার দর ওঠানামা করে। সাধারণত বন্ডের সুদের হার পুরো মেয়াদকালের জন্য অপরিবর্তিত থাকে। বাজারে সুদের হার বাড়লে পুরনো বন্ডের চাহিদা কমে। ফলে এর বাজারদর পড়ে যায়। আবার বাজারে সুদহার কমলে ঘটে এর উল্টোটা, পুরনো বন্ডের চাহিদা বাড়ে। ফলে বাড়ে বাজারদর।
ঝুঁকি : বন্ড ঝুঁকিশূন্য নয়। নির্দিষ্ট সময় পরপর সুদ প্রদান বা মেয়াদ পূর্তিতে মূল টাকা পরিশোধে ইস্যুকারীর ব্যর্থতার ঝুঁকি আছে। করপোরেট বন্ডে লগ্নি করার আগে করপোরেট সংস্থার আর্থিক ইতিহাস, আর্থিক স্বাস্থ্য ও রেটিং যাচাই করতে হয়। তবে সরকারি ট্রেজারি বিল বা বন্ডে বিনিয়োগ নিরাপদ।
লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক।