বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘন জনবসতিপূর্ণ একটি নগরী। ঢাকা নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে পরিবহনসংকট অন্যতম জটিল একটি সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হওয়ার দাবি রাখে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, পিক আওয়ারে রাজধানী ঢাকা শহরে যানবাহনের গড় গতিবেগ মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও মন্থর হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ (এনবিইআর) বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিশ্বের বিভিন্ন শহরের যান চলাচলের গতি নিয়ে একটি বিস্তৃত গবেষণা করেছে। বিশেষত বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল ও দরিদ্র শ্রেণির ১৫২টি দেশের ১ হাজার ২০০ শহরের ওপর এই গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির নগরী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

আমার দৃষ্টিতে গবেষণাটি অত্যন্ত যৌক্তিক এবং তথ্যবহুল। বিভিন্ন শহরের যাতায়াতের তথ্য এবং সড়ক নেটওয়ার্ক ও ভূমিসংক্রান্ত তথ্য (টপোগ্রাফিক্যাল) যথাক্রমে গুগল ম্যাপস এবং ওপেন স্ট্রিট ম্যাপ থেকে নিয়ে গবেষণাটি সম্পাদিত হয়েছে। আমরা যখন ঢাকার যানবাহনের গতি নিয়ে গবেষণা করি, তখন আমাদের ফোকাস থাকে শুধু মূল সড়কের ওপর। অর্থায়নের সংকটে চাইলেও বিস্তৃত গবেষণা করা সম্ভব হয় না। মূল সড়কের ওপর ফোকাস থাকার ফলে শাখা সড়কে যানজট সমস্যা কতটুকু তীব্র আকার ধারণ করেছে, তা আমাদের অজ্ঞাতেই থেকে যায়। কিন্তু এনবিইআরের গবেষণাটি এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে। তারা মূল সড়কের পাশাপাশি শাখা সড়কের যানজটের বিষয়টিও গবেষণার সময় বিবেচনায় রেখেছে। তাদের এই গবেষণার ফলাফল থেকে অনুধাবন করা যায়, রাজধানী ঢাকা শহরের যানজট কতটা জটিল পর্যায়ে চলে গেছে।

অন্যদিকে নামিবিওর (সার্বিয়ান ক্রাউড-সোর্সড অনলাইন ডাটাবেস) ট্রাফিক সেকশন বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন শহরের ট্রাফিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য ও অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। এটি যানজট, যাতায়াতের সময় ও পরিবহন অবকাঠামো সম্পর্কিত ডাটা অনুসন্ধান করে সড়কের গড় গতিবেগ হিসাব করে। চার-পাঁচ বছর আগে তাদের এক গবেষণায় ঢাকার অবস্থান ছিল নবম। এখন তা পঞ্চম স্থানে চলে এসেছে। কিন্তু এসব তথ্যের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এগুলো প্রধানত মূল সড়ককেন্দ্রিক। ফলে শহরের যানজটের তীব্রতা সঠিকভাবে প্রতিভাত হয়ে ওঠে না। কিন্তু এনবিইআর যে গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তার পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। তারা মূল সড়কের পাশাপাশি শাখা সড়ক ও স্থানীয়ভাবে নির্মিত সড়ককেও গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ফলে এই গবেষণার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। আমি মনে করি, ঢাকার ট্রাফিক-সংক্রান্ত গবেষণাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হলে ঢাকার ৪০০ কিলোমিটার মূল সড়কসহ যে ৩ হাজার কিলোমিটার সড়ক নেটওয়ার্ক আছে, তার সবগুলো অন্তর্ভুক্ত করেই তা করতে হবে। অন্যথায় গবেষণাটি হবে খণ্ডিত ও অপূর্ণাঙ্গ। এনবিইআরের গবেষণায় রাজধানী ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যানজট সৃষ্ট ধীরগতির শহরের মধ্যে ময়মনসিংহ রয়েছে নবম স্থানে। আর চট্টগ্রাম রয়েছে ১২ নম্বরে। গবেষণায় শীর্ষস্থানীয় যে ২০টি শহরের উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের তিনটি শহর রয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর হিসেবে আখ্যায়িত করার জন্য মূলত তিনটি কারণকে দায়ী করেছে। জলাশয় বেশি, জনসংখ্যা বেশি এবং ধমনি সড়ক কম। মূলত এই তিন ইস্যুকেই ঢাকার তীব্র যানজটের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশের শহরগুলো অন্যান্য দরিদ্র দেশের শহর থেকে লক্ষণীয়ভাবে আলাদা এবং ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের, যা শহরগুলোকে ধীরগতির করে তোলে। অন্যান্য দরিদ্র দেশের শহরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, একই আয়তনের অন্যান্য দেশের শহরগুলোর তুলনায় ঢাকা ৪০ শতাংশ বেশি জনবহুল, ১১৬ শতাংশ বেশি জলাশয় শহরের ওপর দিয়ে অতিক্রম করেছে এবং ৪২ শতাংশ কম ধমনি সড়ক বা আর্টারি রোড ধারণ করে। স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে, একটি শহরে জনসংখ্যা বেশি হলেই সেখানে যানজটের সৃষ্টি হবে। চলার গতি মন্থর হবে। বিষয়টি আসলে তা নয়। একটি জনবহুল শহরও অনেকটা যানজটমুক্ত থাকতে পারে। যানজট নির্ভর করে কীভাবে ট্রাফিক ব্যবস্থাকে ম্যানেজ করা হচ্ছে তার ওপর। শহরের ধমনি সড়ক যদি বেশি থাকে, তাহলে সেই শহর তুলনামূলক কম যানজটপূর্ণ হবে। কারণ ধমনি সড়ক বেশি থাকলে সেই শহরে যান চলাচলের গতি বেশি থাকে। প্রকৃতপক্ষে আমার মতে, ঢাকা শহরে একটিও ধমনি সড়ক নেই। কারণ আর্টারি বা ধমনি সড়কের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সড়কের দুপাশের ভূমি ব্যবস্থাপনা সুনিয়ন্ত্রিত হতে হবে। আমরা ঢাকা শহরের যেসব সড়ককে ধমনি সড়ক বলে থাকি, যেমন মিরপুর রোড, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, প্রগতি সরণি—এর কোনোটিতেই সংযোগ সড়ক সুনিয়ন্ত্রিত নয়।

আবার এনবিইআরের গবেষণামতে টপোগ্রাফি (জলাশয়) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাদের গবেষণা মতে, ঢাকার গতি বাড়ানোর পেছনে জলাশয়ের উপস্থিতি একটা বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। কারণ একই আয়তনের অন্যান্য দেশের শহরের তুলনায় ঢাকায় জলাশয় বেশি থাকায় এখানে প্রধান সড়ক বা আর্টারি রোড চাইলেও আর বাড়ানো সম্ভব হবে না। এই প্রতিবন্ধকতাকে আমি কিছুটা ভিন্ন চোখে দেখতে চাই। বিশেষত বাংলাদেশের শহরগুলোতে জলাশয়ের উপস্থিতি সীমাবদ্ধতার পরিবর্তে আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। জলাশয়গুলো কাজে লাগানোর জন্য জল পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে ঢাকার সড়কে যানবাহনের উচ্চ চাপ অনেকাংশে কমানো যেত। কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করা হয়নি, বরং আমাদের অনেক নদী ও খাল দখল ও দূষণের শিকার হয়েছে। আমার ধারণা, গত ৩০ বছরে কমপক্ষে ঢাকার প্রায় ৫০টি খাল বিলীন হয়ে গেছে, যা ঢাকা শহরের টপোগ্রাফি অনেকটাই পরিবর্তন করে দিয়েছে। পাশাপাশি টপোগ্রাফির এই পরিবর্তন শুধু জলাশয়কেন্দ্রিক নয়। মানবসৃষ্ট অপরিকল্পিত অবকাঠামো, ভবন এবং ভূমি ব্যবস্থাপনার পরিবর্তনও অনেকাংশে দায়ী। ঢাকা শহরের অধিকাংশে সড়কের দুপাশে উঁচু উঁচু আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মিত হয়েছে যথাযথ ট্রাফিক ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট ছাড়া। পাশাপাশি পার্শ্ব সড়কগুলো অবৈজ্ঞানিকভাবে কোনো ধরনের মানদণ্ড অনুসারণ না করে প্রধান সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। এখন এই মানবসৃষ্ট টপোগ্রাফি পরিবর্তন করা অনেকটাই অসম্ভব বলে আমি মনে করি। যেহেতু মানসম্মত গণপরিবহনের সংখ্যা কম, পাশাপাশি নৌপথকেও কাজে লাগাতে পারিনি, এসব কারণেই ঢাকা শহরে চলার গতি আমরা বাড়াতে পারছি না। অন্যদিকে ধারাবাহিকভাবে সড়কে বাড়ছে মোটরসাইকেলসহ বৈধ-অবৈধ অসংখ্য ছোট ছোট খুচরা যানবাহন। এগুলো যদি একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার আওতায় এনে নিয়ন্ত্রণ করা যেত, তাহলে শহরের যানজট অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। তাই শুধু অবকাঠামো তৈরি করে যানজট সমস্যার নিরসন হবে না। এখন আমাদের হাতে সবচেয়ে উপযোগী যে পথ আছে, তা হলো ঢাকা শহরের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, যা আমরা প্রশাসনিক বা রাজধানী বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ ইন্দোনোশিয়ার কথা বলা যেতে পারে, যারা অতি সম্প্রতি এ ধরনের পন্থা অবলম্বন করেছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রগুলো বৈচিত্র্যময় করতে ইন্দোনেশিয়ার সরকার তাদের দেশের রাজধানীকে অতিরিক্ত জনসংখ্যার শহর জাকার্তা থেকে বর্নিও দ্বীপে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ বিশেষজ্ঞরা বারবার দিলেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কোনো ধরনের উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি।

মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনবিইআর তাদের গবেষণার কাজে যেসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করেছে, তা তারা পেয়েছে গুগল ম্যাপস থেকে। সেখানে বিভিন্ন দেশের যান চলাচল, যানবাহনের গতি বৈজ্ঞানিকভাবে সিম্যুলেটেড করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি যখন কোনো বিষয়ে এক শহরের সঙ্গে অন্য শহরের তুলনা করেছে, তখন তারা জনসংখ্যা ও শহরের আয়তনকে বিবেচনায় রেখেছে। উল্লেখ্য, তাদের গবেষণায় আফ্রিকান শহর লাগোস দ্বিতীয় ধীরগতির শহরের তালিকায় স্থান পেয়েছে। লাগোসের অবকাঠামোগত বিনিয়োগ নিঃসন্দেহে আমাদের দেশের তুলনায় অনেক কম। বিগত দুই যুগে ঢাকা শহরে যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, তা কতটুকু গণমানুষের জন্য উপযোগী, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। বিশেষত ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অবকাঠামোগত খাতে সাম্প্রতিক সময়ে যে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে, তার সুফল পাচ্ছে মূলত অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্যবান ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারী একশ্রেণির মানুষ। অথচ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের দর্শন হলো, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা করতে হবে সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে। উন্নয়নের সুফল যাতে সবাই ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভোগ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের মোট দেশজ উত্পাদনের ৩০ শতাংশ অবদান রাখছে ঢাকা শহর। অথচ যানজটের কারণে বছরে ঢাকা শহরে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। তাই ঢাকা শহরের পরিবহনব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি সুষ্ঠু ফুটপাত ও গণপরিবহন ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

লেখক: ডিপার্টমেন্ট অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বুয়েট) ও  নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ

অনুলিখন: এম এ খালেক



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews