স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদ উদযাপিত হয় ১৯৭২ সালের ২৭ জানুয়ারি। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ঈদুল আজহার ওই দিনটি ছিল এক দিকে আনন্দের, অন্য দিকে বেদনার। যুদ্ধে যাদের পরিবারের লোকজন হতাহত হন এবং যাদের পরিবারের সদস্যরা তখনো নিখোঁজ ছিলেন তাদের কাছে ওই ঈদ মোটেও কোনো আনন্দ বয়ে আনেনি। আবার যাদের বাড়িঘর পুড়েছিল, ধ্বংস হয়েছিল, সহায়-সম্পদ লুট হয়েছিল, তাদের কাছেও ওই ঈদ ছিল নিরানন্দের। অন্য দিকে যুদ্ধে যাদের পরিবারের কোনো সদস্য হতাহত হয়নি অথবা সহায়-সম্পদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি তাদের কাছে ঈদটি ছিল স্বাভাবিকভাবেই আনন্দের। কারণ তারা একটি সদ্য স্বাধীন দেশে ভয়ভীতিহীন পরিবেশে ঈদ উদযাপনের সুযোগ পেয়েছিল।

এর আগে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর। সে সেময় দেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল। শহরাঞ্চল ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আর গ্রামাঞ্চলে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ। শহর ও গ্রাম সব জায়গাতে জামাতে ঈদের নামাজ আদায় করা হলেও মানুষের মধ্যে ঈদের আনন্দ ছিল না। একটা ভয়ভীতি কাজ করছিল। অনেক জায়গাতেই তখন মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লড়াই হয়েছিল। ঈদ উপলক্ষে একদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে বাণী প্রদান করেন, অন্য দিকে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদও জাতির উদ্দেশে বাণী দেন।

ঈদুল ফিতরে আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি বেড়ানো হয়নি, ঈদুল আজহায় বেড়াতে যাওয়া যাবে সে কারণে আমরা অর্থাৎ আমি এবং আমার ছোট ভাইবোনেরা বেজায় খুশি ছিলাম। আমরা তখন ঈদুল ফিতরকে বলতাম রোজার ঈদ আর ঈদুল আজহাকে বলতাম বকরি ঈদ। এখন মনে হয়, ছোটরা আর বকরি ঈদ বলে না। তারা বলে কোরবানির ঈদ।

আমরা কেন বকরি ঈদ বলতাম সেটি আগে কখনো চিন্তা করে দেখিনি। কারো কারো ধারণা আরবি বাকারা শব্দ থেকে বাংলা বকরি শব্দের উৎপত্তি। বাকারা শব্দের অর্থ হচ্ছে গাভী। আবার কারো কারো ধারণা, হিন্দুস্তানি ভাষায়, বকরি শব্দের অর্থ হচ্ছে- ছাগল। ব্রিটিশ ভারতে যখন জমিদারি প্রথা চালু করা হয়, তখন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই ব্রিটিশদের কাছ থেকে জমিদারি লাভ করেন। জমিদারি লাভের পর তাদের বেশির ভাগই মুসলমান প্রজাদের ওপর জলুম-নির্যাতন ও নিপীড়ন শুরু করেন এবং তারই অংশ হিসেবে তাদের জমিদারিতে গরু হত্যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এ কারণে মুসলমানরা গরুর পরিবর্তে ছাগল বা খাসি জবাই করতে বাধ্য হন। সময়ের পরিক্রমায় মুসলমানরা গরু কোরবানির বিষয়টি বিস্মৃত হয়ে কোরবানির ঈদকেই বকরি ঈদ বানিয়ে ফেলেন।

বাহাত্তর সালের প্রথম দিকে আমরা কাকরাইলে আমার সেজ মামার বাসায় থাকতাম। ঈদুল আজহার দিনে ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে হঠাৎ লক্ষ করলাম বড়দের মধ্যে একটি বিষয় নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। বিষয়টি হচ্ছে, ভারতীয় সেনাবাহিনী কি প্রকাশ্যে কোরবানি করতে দেবে? ছাগল-ভেড়া কোরবানি করতে দিলেও গরু কি কোরবানি করা যাবে? আসলে সেই সময় একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে কোরবানি করতে দেবে না; গরু তো নয়ই। ঈদের দুয়েক দিন আগের ঘটনা। সন্ধ্যার পর একতলা বাসার সামনের বারন্দায় খেলছিলাম (যেহেতু স্কুল বন্ধ এবং পড়াশোনাও নেই)। আব্বাও মাগরিবের নামাজ পড়ে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছিলেন। আব্বার গায়ে পাঞ্জাবি ও মাথায় টুপি।

আব্বা ত্রিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তাবলিগ জামাতের সংস্পর্শে এসে সিগারেট খাওয়া ছাড়েন এবং দাড়ি রখেন। বাসায় লুঙ্গির সাথে পাঞ্জাবি পরার শুরু তখন থেকেই। হঠাৎ দেখি ভারতীয় সেনাবাহিনীর জলপাই রঙের পোশাক পরা কয়েকজন সশস্ত্র ব্যক্তি বাসার দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়েছিলাম।

তারা গেটের কাছে এসে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইল। আব্বা গেট খুলে তাদেরকে ভেতরে ঢোকালেন। তারা হিন্দিতে কথা বলতে শুরু করলে আব্বা তাদেরকে উর্দুতে জবাব দেন। আব্বা সরকারি চাকরি করতেন বিধায় উর্দু ভালোই জানতেন। এখানে বলে রাখা ভালো, উর্দু ও হিন্দির মধ্যে খুব বেশি একটা পার্থক্য নেই। সৈন্যদের মধ্য থেকে যিনি কথা বলছিলেন তিনি ছিলেন একজন অফিসার। প্রাথমিক কুশলাদি বিনিময়ের পর তিনি জানালেন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ভারতীয় সেনাবাহিনীর দায়িত্ব। যেহেতু তারা এখনো বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। মানুষ যাতে নিশ্চিন্তে ঈদ উদযাপন করতে পারে সেদিক তারা সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। যে যার পছন্দমতো কোরবানির পশু কুরবানি দেবেন, সেখানে কেউ বাধা দিতে পারবে না। কেউ যদি ঝামেলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে তাহলে যেন ভারতীয় সেনাবাহিনীকে খবর দেয়া হয়।

আব্বা তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলে তারা ফিরে যেতে শুরু করে। গ্রুপটি কয়েক পা এগিয়ে যাওয়ার পর অফিসারটি পেছন ফিরে দ্রুত পায়ে আব্বার দিকে এগিয়ে আসেন এবং তার মুসলিম পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘ভাইসাব এক বাত ইয়াদ রাখ না। ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হর কারবালা কি বাদ।’ (ভাইসাব একটি কথা মনে রাখবেন, প্রতিটি কারবালার পরই ইসলাম জিন্দা হয়ে ওঠে)। এই বাক্যটি প্রখ্যাত ভারতীয় মুসলিম নেতা মাওলানা মোহাম্মদ আলী জাওহারের একটি অসাধারণ উক্তি, যা তিনি করেছিলেন কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার স্মরণে।

মাওলানা মোহাম্মদ আলী জাওহার সম্পর্কে দু’-একটি কথা না বললেই নয়। তিনি এক দিকে ছিলেন মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, অন্য দিকে ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি। ওসমানীয় খেলাফত উৎখাতের বিরুদ্ধে ভারতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তিনি ছিলেন তার পুরোধা। ১৯৩০ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে তিনি মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ভারতের স্বাধীনতা দাবি করে বলেছিলেন, ভারতকে স্বাধীনতা না দেয়া হলে তিনি আর পরাধীন ভারতে ফিরে যাবেন না। বাস্তবেও তিনি আর পরাধীন ভারতে ফিরে আসেননি। ১৯৩১ সালের জানুয়ারিতে তিনি লন্ডনে ইন্তেকাল করেন এবং তার লাশ জেরুসালেমের কুব্বাতুস সাখারার পাশে দাফন করা হয়।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews