আমের ঝুড়িকে ঘিরে এশিয়াতে যত কূটনীতি, রেষারেষি আর রহস্য

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

ঢাকার একটি পাইকারি ফলের বাজারে আমের পসরা

    • Author,

      শুভজ্যোতি ঘোষ

    • Role,

      বিবিসি নিউজ বাংলা, দিল্লি

  • ৪ ঘন্টা আগে

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পাঠানো এক হাজার কেজির হাঁড়িভাঙা আমের বাক্স এ সপ্তাহেই দিল্লিতে সাত নম্বর লোককল্যাণ মার্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঠিকানায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ইদানিংকার 'তিক্ত' দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটু 'মিষ্টতার স্বাদ' আনতেই যে এই আম উপহার, তা নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর অন্তত কোনও সন্দেহই নেই!

আম যে নরেন্দ্র মোদীর প্রিয়তম ফল, এটা অবশ্য কোনও গোপন তথ্য নয়। তিনি আম কেটে খান, না কি আঁটিসুদ্ধু গোটা আম চুষে খেতে পছন্দ করেন – এই প্রশ্নও এক সময় দেশ জুড়ে ভাইরাল হয়েছিল।

বছরকয়েক আগে বলিউড তারকা অক্ষয় কুমার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্নটা করেছিলেন।

সেখানেই মোদী জানান, ছোটবেলায় তাদের দরিদ্র পরিবারে বাজার থেকে আম কিনে খাওয়ার বিলাসিতা ছিল না ঠিকই – কিন্তু গ্রামে গেলেই কৃষকের আমবাগান থেকে পাকা আম পেড়ে খাওয়াটা তার খুব প্রিয় অভ্যেস ছিল!

সে যাই হোক, মোদীর এই আম-প্রীতির খবর ফাঁস হওয়ার কিছুকাল পর থেকেই বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি বছর দিল্লিতে গ্রীষ্মের মৌশুমে আম উপহার পাঠাতে শুরু করেন।

সে সময় দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, "নিরামিষাশী নরেন্দ্র মোদীকে পদ্মার ইলিশ পাঠিয়ে তো কোনও লাভ নেই! কিন্তু আম এমন একটা উপহার, এই পুরো উপমহাদেশে সবাই যেটা পেতে ভীষণ পছন্দ করেন।"

ভারতের মালিহাবাদে দশেরি আমের মরশুমে ফল পাড়ার কাজ চলছে

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

ভারতের মালিহাবাদে দশেরি আমের মরশুমে ফল পাড়ার কাজ চলছে

দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির কাছেই শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরার মতো বাংলাদেশ-লাগোয়া রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের কাছেও এরপর থেকে নিয়মিত পৌঁছে যেতে শুরু করে শেখ হাসিনার পাঠানো রংপুরের হাড়িভাঙা কিংবা রাজশাহীর আম্রপালীর ঝুড়ি!

শুধু ভারতে নয় – পাকিস্তানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকেও আম উপহার পাঠিয়ে অনেককেই চমকে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।

তবে তার পতনের পর ঢাকায় যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, তারাও যে ভারতে শেখ হাসিনার আমলের এই 'আম কূটনীতি'র পরম্পরা অব্যাহত রাখবে, এটা পর্যবেক্ষকদের অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু অবশেষে ঠিক সেটাই ঘটেছে।

ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রিয়জিত দেবসরকারের কথায়, "আমেরিকার দিক থেকে ট্যারিফের চাপ, মধ্যপ্রাচ্যের সংকট, ঘরের পাশে মিয়ানমারের পরিস্থিতি – নানা কারণে বাংলাদেশ প্রবল চাপে আছে বলেই ড: ইউনূসকে ভারতের সঙ্গে এই আম কূটনীতির রাস্তা নিতে হয়েছে বলে আমার ধারণা।"

"দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার কথা এখন তারা প্রকাশ্যেও বলছেন। অত:পর এই হাঁড়িভাঙা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কী অম্লমধুর স্বাদের রেশ রেখে যায় দেখার বিষয় সেটাই", বলছিলেন তিনি।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানে আমকে কেন্দ্র করে কূটনীতি এবং পরস্পরের মধ্যে বাণিজ্য প্রতিযোগিতা অবশ্য নতুন কিছু নয়।

বস্তুত দিল্লি ও ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের সেরা জাতের আম বিশ্বনেতাদের উপহার দিয়ে আসছে।

বাংলাদেশ থেকে চীনে পাঠানোর জন্য আমের চালান বিমানবন্দরে পরীক্ষা করে দেখছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা, সঙ্গে রয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত। ২৮শে মে, ২০২৫

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

বাংলাদেশ থেকে চীনে পাঠানোর জন্য আমের চালান বিমানবন্দরে পরীক্ষা করে দেখছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা, সঙ্গে রয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত। ২৮শে মে, ২০২৫

বিশ্বে যে তিনটে দেশ সবচেয়ে বেশি আম রফতানি করে, সেগুলো হলো যথাক্রমে ভারত, মেক্সিকো আর পাকিস্তান।

বাংলাদেশও এই তালিকায় প্রথম দশের মধ্যেই আছে, আর দুনিয়ায় নতুন নতুন বাজার খোঁজার চেষ্টায় এই দেশগুলোর মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতাও আছে।

পাকিস্তানে সাঁইত্রিশ বছর আগে যে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে সামরিক শাসক তথা প্রেসিডেন্ট জিয়া উল হকের মৃত্যু হয়েছিল, সেই রহস্যময় ঘটনার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কয়েক বাক্স আমের নাম।

ফলে বিশ্বের এই অঞ্চলে আম মানে অতি সুস্বাদু একটি ফলই শুধু নয় – আমের ঝুড়ির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে রহস্য, রাজনীতি, রেষারেষি আর কূটনীতির ঘেরাটোপ - এই প্রতিবেদনে থাকছে যার কিছু সুলুকসন্ধান।

ভারত ও পাকিস্তানে আম কূটনীতির আদ্যোপান্ত

সাতচল্লিশে দেশভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান নামে যে দুটো স্বাধীন দেশের জন্ম, তাদের উভয়েরই 'জাতীয় ফল' হলো আম। দুটো দেশই এই আমকে তাদের গ্লোবাল আউটরিচ বা কূটনীতির বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে।

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পঞ্চাশের দশকে যখনই বিদেশ সফরে যেতেন, উপহার হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যেতেন আমের বাক্স। আবার বিদেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীরা ভারত সফরে এলেও তারা পন্ডিত নেহরুর কাছ থেকে অবধারিতভাবে আম উপহার পেতেন।

জওহরলাল নেহরু ও চৌ এন লাই, ১৯৫৫তে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময়

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

জওহরলাল নেহরু ও চৌ এন লাই, ১৯৫৫তে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময়

১৯৫৫ সালে চীন সফরে গিয়ে পন্ডিত নেহরু চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই-কে দশেরি ও ল্যাংড়া আমের আটটি চারা উপহার দিয়েছিলেন, যেগুলো রোপণ করা হয়েছিল গুয়াংঝৌ পিপলস পার্কে।

আবার সে বছরই যখন সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ভারত সফরে আসেন, তার মস্কোগামী ফিরতি বিমানে সঙ্গে গিয়েছিল উত্তরপ্রদেশের বিখ্যাত মালিহাবাদী আমের অনেকগুলো ঝুড়ি – জওহরলাল নেহরুর উপহার।

পরে নেহরুর দৌহিত্র রাজীব গান্ধী দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৮৬তে যখন ফিলিপাইন সফরে যান, সে দেশের প্রেসিডেন্ট কোরাজন অ্যাকিনোর হাতেও তিনি উপহার হিসেবে আমের বাক্সই তুলে দিয়েছিলেন।

মজার ব্যাপার, ফিলিপাইনের জাতীয় ফলও কিন্তু আম – তবে সে আমের স্বাদ-গন্ধ ও চরিত্র অবশ্যই ভারতের আমের চেয়ে অনেক আলাদা।

আম উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানও পিছিয়ে ছিল না – এবং চীনকে দেওয়া পাকিস্তানের আম তো সে দেশে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকেও পরিণত হয়েছিল।

১৯৬৮র অগাস্ট মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঁয়া আর্শাদ হুসেইন বেইজিং সফরে গিয়ে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং-কে এক বাক্স আম উপহার দেন।

ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট কোরাজন অ্যাকিনো, ১৯৮৬

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট কোরাজন অ্যাকিনো, ১৯৮৬

আম তখনও চীনে অপরিচিত একটি ফল, আর মাও নিজেও এই নতুন ফলটি চেখে দেখতে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না ... ফলে তিনি দেশের বিভিন্ন কারখানা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই আমগুলো বিলি করে দেন।

এরপর চীনের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা কারখানায় চেয়ারম্যানের সেই উপহার নিয়ে যেরকম মাতামাতি শুরু হয়েছিল – আমকে ফর্ম্যালডিহাইডে সংরক্ষণ করে, কাঁচের পাত্রে ও পূজার বেদীতে রেখে শ্রমিক ও ছাত্ররা যেভাবে সম্মান জানাতে শুরু করেন তা আজও ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর চেষ্টাতেও আমকে ব্যবহার করেছে।

১৯৮১তে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়া উল-হক ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এমন এক আমের বাক্স উপহার পাঠান, যে প্রজাতিটি পাকিস্তানে 'আনোয়ার রাতাওল' নামে পরিচিত।

'রাতাওল' নামে ভারতের উত্তরপ্রদেশেও একটি গ্রাম আছে, আর সেই আমের উৎপত্তি আসলে ভারতে না পাকিস্তানে – তখন সেই বিতর্ক ছাপিয়ে গিয়েছিল উপহারের সৌজন্যকে।

২০০৮ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-কে আমের বাক্স উপহার পাঠিয়েছিলেন। তবে তার কিছুদিন পরেই মুম্বাইতে ২৬/১১-র হামলা সেই উষ্ণতায় জল ঢেলে দেয়।

পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়া উল-হক, তিনিও আম উপহার পাঠিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়া উল-হক, তিনিও আম উপহার পাঠিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে

সাত বছর বাদে (২০১৫) পাকিস্তানের তখনকার নেতা নওয়াজ শরিফ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ও বিরোধী নেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে আমের বাক্স পাঠান – কিন্তু দুই দেশের সংঘাত নিরসনে নেই উপহারও খুব একটা কাজে আসেনি!

আমেরিকা আর চীনকে আমে মজানোর চেষ্টা

জার্নাল অব এশিয়ান অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে প্রকাশিত এক নিবন্ধে গবেষক জাহিদ শাহাব আহমেদ ও মহম্মদ জাহানজাইব দাবি করেছেন, আম নিয়ে কূটনীতি আর বাণিজ্যের দৌড়ে পাকিস্তান কিন্তু ভারতকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে।

ভারতে প্রায় ১২০০ জাতের আম উৎপন্ন হয়, সেই জায়গায় পাকিস্তানের আম হয় মোটামুটি চারশো জাতের। ফলনের পরিমাণও ভারতে যথারীতি অনেক বেশি।

তবে আম যেভাবে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান রফতানিমুখী কৃষিপণ্য, ভারতের ক্ষেত্রে সেটা ততটা নয়। কোভিড মহামারির আগের বছরেও পাকিস্তান ১২৭ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের আম রফতানি করেছিল।

ওই দুই গবেষক বলছেন আম রফতানির ক্ষেত্রে পাকিস্তানের একটা সুচিন্তিত স্ট্র্যাটেজি আছে ... বিদেশে নিয়মিত 'আম উৎসব' বা 'আম প্রদর্শনী'র আয়োজন করে, বিদেশের নেতা-মন্ত্রী-নীতিনির্ধারকদের আম খাইয়ে ও উপহার দিয়ে তারা পাকিস্তানি আমের একটা দারুণ বাজার তৈরি করতে পেরেছেন।

আম বেচার জন্য চিরাচরিতভাবে বিশ্বের যে বাজারগুলোতে নজর দিয়ে আসা হয়েছে – তার একটি হল আমেরিকা, অপরটি চীন। পাশাপাশি ইউরোপেও দক্ষিণ এশিয়ার আমের একটা বড় বাজার আছে।

চীনে একটি আমকে সামনে রেখে চেয়ারম্যান মাও-এর প্রশস্তিসূচক পোস্টার, ১৯৬৮

ছবির ক্যাপশান,

চীনে একটি আমকে সামনে রেখে চেয়ারম্যান মাও-এর প্রশস্তিসূচক পোস্টার, ১৯৬৮

চীনে আম রফতানি করতে ভারতের চেষ্টা কিন্তু কখনওই তেমন সফল হয়নি।

২০০৪ সালেই চীন ভারতীয় আমের জন্য তাদের মার্কেট অ্যাকসেস খুলে দেয়, তারপরও ভারতের রফতানিকারকরা সেখানে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি।

২০১৫-১৬ সালে ভারতের ব্যবসায়ীরা সারা বিশ্বে ৩১৭ কোটি রুপিরও বেশি দামের আম রফতানি করেছিলেন, সেখানে চীনে রফতানি হয়েছিল মাত্র ২৪ হাজার রুপির আম।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ভারতের আম রফতানি প্রায় দীর্ঘ দু'দশক ধরে নিষিদ্ধ ছিল। ২০০৬-তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ভারত সফরে এলে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেটাকে তখন 'ম্যাঙ্গো ইনিশিয়েটিভ' বলে বর্ণনা করা হয়েছিল।

বলা হয়ে থাকে, প্রেসিডেন্ট বুশ না কি দিল্লিতে এসে ভারতের আম খেতে খুবই উদগ্রীব ছিলেন – আর তার ব্যক্তিগত আগ্রহেই আম রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

এরপর যখন ২০০৭-র ১৭ই এপ্রিল নিউ ইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্টে ভারতীয় আমের দেড়শো কার্টন এসে নামলো, নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, "ইতিহাসে বোধহয় এটাই সবচেয়ে প্রতীক্ষিত কোনও ফলের ডেলিভারি!"

ওদিকে ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের দূতাবাসও নিয়মিত মার্কিন সেনেটর বা নেতা-মন্ত্রীদের আম উপহার পাঠিয়ে থাকে, তাদের দূতাবাসের লনে 'ম্যাঙ্গো পার্টি'ও হামেশাই হয়ে থাকে।

ইসলামাবাদের একটি ফলমান্ডিতে আমের পসরা নিয়ে বিক্রেতা

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

ইসলামাবাদের একটি ফলমান্ডিতে আমের পসরা নিয়ে বিক্রেতা

রফতানির জন্য পাকিস্তানি আমের চাহিদা কেন তুলনামূলকভাবে বেশি, দিল্লিতে আম বিশেষজ্ঞ প্রতীপ কুমার দাশগুপ্ত তার আবার একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।

মি দাশগুপ্ত বিবিসিকে বলছিলেন, "আসলে যে আমের 'শেলফ লাইফ' যত বেশি – মানে বেশিদিন যে আমটা ভাল থাকে, রফতানির জন্য সেটাই বেশি উপযুক্ত।"

"কারণ ফলের বাগান থেকে লন্ডন-নিউ ইয়র্কের দোকানে পৌঁছতে একটা আমের পাঁচ-সাতদিন লেগেই যায়, আর ততদিন পর্যন্ত সেই আমটায় এতটুকুও পচন ধরা চলবে না।"

অথচ ভারতের কোঙ্কন উপকূল ও মহারাষ্ট্রের আলফানসো ছাড়া বেশির ভাগ প্রজাতির আমেই আঁশ বা ফাইবার বেশি – আর সেগুলোতে পচনও ধরে তাড়াতাড়ি, যদিও স্বাদে-গন্ধে সেগুলো হয়তো কোনও অংশেই কম নয়।

কিন্তু পাকিস্তানের শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে সেখানকার আমে আবার আঁশ খুব কম, 'শেলফ লাইফ'ও বেশি।

"ঠিক এই কারণেই ভারতের আলফানসো ছাড়া অন্য প্রজাতির আম কমই রফতানি হয়, অন্য দিকে পশ্চিমা বাজারে পাকিস্তানের সিন্ধ্রি, চৌসা বা আনোয়ার রাতাওলের এত কদর", বলছিলেন প্রতীপ কুমার দাশগুপ্ত।

পাকিস্তানের উপহার পাঠানো আমের বাক্স হাতে নিয়ে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ডন গ্রেভস, ২০২১

ছবির উৎস, DON GRAVES/X

ছবির ক্যাপশান,

পাকিস্তানের উপহার পাঠানো আমের বাক্স হাতে নিয়ে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ডন গ্রেভস, ২০২১

প্রাণঘাতী বিস্ফোরণ ঘটেছিল যে 'আমের বাক্সে'

১৯৮৮ সালের ১৭ অগাস্ট পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরে একটি সামরিক ট্যাঙ্ক বহরের রুটিন প্যারেড প্রদর্শন করে রাজধানীতে ফেরার জন্য বিমানে চাপেন দেশের প্রেসিডেন্ট তথা সামরিক শাসক জেনারেল মুহাম্মদ জিয়া উল-হক।

প্রেসিডেন্টকে বহনকারী ওই সি-১৩০ হারকিউলিস এয়ারক্র্যাফটটি পরিচিত ছিল 'পাক ওয়ান' নামে, যেমনটা মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিমানের নাম হলো 'এয়ারফোর্স ওয়ান'।

তো সেদিন ফেরার সময় ওই বিমানে প্রেসিডেন্ট ছাড়াও সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ছিলেন, আর ছিলেন পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্নল্ড র‍্যাফেল।

ফিরতি বিমানে বাহাওয়ালপুর থেকে প্রেসিডেন্ট ও অন্য অতিথিদের জন্য উপহার হিসেবে কিছু আমের বাক্সও তুলে দেওয়া হয়েছিল।

মসৃণ টেক-অফের কিছুক্ষণ পরেই 'পাক ওয়ানে'র সঙ্গে কন্ট্রোল টাওয়ারের সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা পরে জানিয়েছেন, বিমানটি ভীষণ এলোমেলোভাবে উড়ছিল, তারপরই সেটাতে প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে ও বিমানটি মুখ থুবড়ে পড়ে।

রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট জিয়া উল-হকের জানাজা

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট জিয়া উল-হকের জানাজা

জেনারেল জিয়া উল-হক ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত-সহ বিমানের মোট ৩১জন যাত্রীই সে দিন নিহত হন।

এই 'দুর্ঘটনা' ঠিক কীভাবে ঘটেছিল, এতে কোনও নাশকতার ছাপ ছিল কি না – সেই রহস্য আজও পুরোপুরি উদ্ঘাটিত হয়নি।

তবে জেনারেল জিয়া উল-হকের এই মৃত্যু নিয়ে যথারীতি অনেকগুলো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা কনস্পিরেসি থিওরি চালু আছে।

এমনই একটা থিওরি হলো – বাহাওয়ালপুর থেকে বিমানে উঠিয়ে দেওয়া আমের বাক্সেই না কি লুকোনো ছিল বোমা আর বিস্ফোরক।

'পাক ওয়ান' ক্র্যাশ করার সেই সত্যি ঘটনার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে জিয়া উল-হকের মৃত্যুর ঠিক বিশ বছর পর একটি উপন্যাস বা আধা-ফিকশন লিখেছিলেন পাকিস্তানি লেখক মোহামেদ হানিফ।

বেস্টসেলার বইটির নাম ছিল 'আ কেস অব এক্সপ্লোডিং ম্যাঙ্গোজ'।

পাকিস্তানে একটি সাহিত্য অনুষ্ঠানে নিজের বইতে পাঠকদের সই দিচ্ছেন মোহামেদ হানিফ

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

পাকিস্তানে একটি সাহিত্য অনুষ্ঠানে নিজের বইতে পাঠকদের সই দিচ্ছেন মোহামেদ হানিফ

মোহামেদ হানিফ নিজে এক সময় ছিলেন পাকিস্তানি এয়ারফোর্সের সদস্য ও ফাইটার জেটের পাইলট – পরে সাংবাদিকতায় এসে তিনি লন্ডনে বিবিসি উর্দু বিভাগের প্রধান হিসেবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন।

লন্ডনে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের একদা আইকনিক সদর দফতর বুশ হাউসে তিনি ছিলেন সহকর্মী।

তো পরে ঘরোয়া আড্ডায় যখনই জানতে চাইতাম সামরিক বাহিনীর একজন 'ইনসাইডার' বা ভেতরের লোক হিসেবে তার নিজের কাছে জেনারেল জিয়া উল-হকের মৃত্যু নিয়ে কী খবর ছিল, মোহামেদ হানিফ সব সময়ই হেসে সে প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতেন।

কখনও হয়তো বা বলতেন, "আমার বইটা আবার ভাল করে পড়ুন, তাহলেই উত্তর পেয়ে যাবেন!"

আমের ঝুড়িকে কেন্দ্র করে রহস্যের জট তাতে যথারীতি খোলেনি – বরং আরও বেড়েছে।

পাশাপাশি সহজবোধ্য কার এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতেও আম কখনওই 'আম' নয় – বরং 'খাস' হিসেবেই চিরকাল নিজের জায়গা করে নিয়েছে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews