জাতীয় বাজেট হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকা-ের আয়-ব্যয়ের একটি বিশদ পরিকল্পনা ও আর্থিক বিবরণী। অনেক সময়ই কাগজের বিবরণী আর বাস্তব বিবরণীর বড় রকমের গড়মিল লক্ষ করা যায়। এ গড়মিলে ভারসাম্য আনার দায়িত্ব সরকারের বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের। সমন্বিত কর্মপ্রচেষ্টায় তা গণমুখী হয়ে উঠতে পারে। অন্যথায় তা জনকল্যাণ না হয়ে জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়ে উঠবে। একটি বাজেটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সম্পদের পুনর্বণ্টন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আয় বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। এ লক্ষ্য পূরণে প্রতি অর্থবছরে বাজেটের আয়তন বাড়ছে। বরাবরই বাজেটে সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্বের পরিমাণ বাড়ানো। সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন এবং প্রতিযোগিতাও আছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কোনভাবেই উচ্চাভিলাসী বাজেটের ভাবনায় তাড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। আগামী বাজেটের ধরন, আকার, প্রকার, গুরুত্ব এবং সর্বোপরি বাজেটে কী প্রাধান্য পাবে আর কী পাবে না ইত্যকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে কার্যক্রম চলমান আছে। সংযোজন, বিয়োজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন শেষে বাজেট সরকারিভাবে অনুমোদনের জন্য চূড়ান্তভাবে পেশ করা হবে। বাজেট ঘোষণা হওয়ার পরপরই শুরু হয় বাজেট নিয়ে আলোচনা সমালোচনা। বাজেট সংশ্লিষ্ট মন্তব্য ও মতামতসমূহ যেমন, ঘাটতি বাজেট কীভাবে মোকাবেলা হবে, উন্নয়ন কর্মসূচি কেন উপেক্ষিত হলো? বাজেট কি উচ্চাভিলাসী অথবা বাজেট কি ধনীর স্বার্থ রক্ষা করছে, বাজেটে গরিবরা কেন উপেক্ষিত। এছাড়া বাজেটের রাজস্ব আয়ের চরিত্র চিত্রায়ন কী হবে, এতদ বিষয়ে চলতে থাকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। সরকার অর্থবহ সমলোচনা ও বিশ্লেষণকে বিবেচনায় নিয়ে নিরেপক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার মাপকাঠিতে রাষ্ট্রীয় সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণে বাজেটকে চূড়ান্তরূপ দেয়া হয়ে থাকে।

আগামী বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ভাতার পরিমাণ ও সুবিধাভোগী বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতাসহ প্রায় ১০টি ভাতা বাড়ানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে সরকারের। হিজড়া, বেদে, চা শ্রমিক ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভাতা দিচ্ছে সরকার। তাদের ভাতাও বাড়তে পারে। একই সঙ্গে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (ভিজিডি) কর্মসূচি ও ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে পেশকৃত প্রস্তাবের আলোকে যথাযথ ব্যবস্থা গৃহীত হবে। তবে সঠিক তথ্য ও পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তির জন্য অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না এবং উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। আশা করা যায়, এবারের তালিকা রাজনৈতিক প্রভাব ও চাপমুক্ত হবে।

চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি ২১ হাজার কোটি থেকে বাড়িয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। আগামী বাজেটেও এ খাতে বাড়তি বরাদ্দ অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। একই সঙ্গে খাদ্য ভর্তুকি বাবদ চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ৮ হাজার ৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মূলত ওএমএস, টিসিবি, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি সারা বছর চলমান রাখার লক্ষ্যে বর্ধিত হারে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী বাজেটে এসব খাতে বাড়তি বরাদ্দ রাখা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সার্বিকভাবে কর্মসংস্থানে ধীরগতি রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আগামী বাজেটে কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিষয়ে থাকছে বিশেষ নজর। বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের ভাষ্য, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা ৮ লাখ কোটি টাকার নিচে বাজেট দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিষয়টি মাথায় নিয়ে বাজেটের আকার কিছুটা বড় করা হচ্ছে। কারণ, সরকারি ব্যয় বেশি সংকুচিত করে ফেললে কর্মসংস্থান বাড়বে না। একই সঙ্গে সরকার ব্যয় মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ কম নেওয়া হবে, যাতে করে উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে কোনো সমস্যা না হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রাথমিকভাবে ৮ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ পরিকল্পনার ভিত্তি হিসেবে সরকার ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য ও পরিসংখ্যানগত এক হিসাব প্রতিবেদন ও বাজেট চাহিদা পেয়েছ। প্রাক্কলিত এই হিসাব বিবরণী ও প্রতিবেদন থেকেই বাজেটের ব্যয় পরিকল্পনা প্রস্তুত হয়ে থাকে। গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার এক সাক্ষাতকারে বলেন যে, অগ্রাধিকার ভিত্তিক কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার নতুন বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে হবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় ক্ষেত্রেই সংস্কার প্রয়োজন। উচ্চ শুল্কের কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না, রপ্তানি পণ্যেও বৈচিত্র্য হয় না। তিনি আরও বলেন, এনবিআর এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার সংস্কার না করলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি থমকে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত আড়াই বছরেরও বেশি সময় দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ। গত বছরের জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। আগামী অর্থবছর (২০২৫-২৬) শেষে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশ নামিয়ে আনতে চায় সরকার। তাই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি ব্যয়ে সাশ্রয়ী পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো ধরনের প্রকল্প নেওয়া হবে না। বাজেট তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এমন আলোচনা হয়েছে যে, খুব প্রয়োজন না পড়লে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া বন্ধ রাখা হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে শুল্ক-কর হ্রাস অব্যাহত রাখা হবে। একই সঙ্গে পণ্য সরবরাহ চেইনের সকল স্তরের প্রতিবন্ধকতা দূর করা হবে। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নির্ধারণে অর্থ বিভাগের সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগ গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গবেষণায় পাওয়া ফলাফলের ভিত্তিতে কিছু উদ্যোগ আগামী বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে বাজেট ও জীবনযাত্রার সম্পর্ক অতি নিবিড় এবং বাস্তব। একটি পরিবার কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায় তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে চলে অর্ধাহার, অনাহার এবং পারিবারিক অশান্তিতে। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া। অন্যদিকে মুনাফাখোরী, কালোবাজারীদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাজার ও বাজেট বাস্তবায়নের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান জরুরি। অন্যথায় আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থা যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তাতে মনে হয়, আগামী বাজেট বাস্তবায়ন খুবই চ্যালেঞ্জ হবে। দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও ক্ষুদ্র ব্যবসার উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা ছাড়া মানুষের জীবন মানের কোনো পরিবর্তন আসবে না, বরং বেঁচে থাকাই একটি চ্যালেঞ্জের বিষয় হবে। তবে বাজেট যেভাবেই প্রণীত হোক না কেন তাকে গণমুখী করা তথা সমাজের সকল শ্রেণী ও মানুষের স্বার্থে আঘাতহানীকর প্রকল্পসমূহের ব্যয় নির্বাহে আমাদের খুবই সজাগ থাকতে হবে। প্রয়োজনে এ জাতীয় প্রকল্পকে বাদ দিয়ে হলেও সাধারণ স্বার্থের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে বাজেট ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিকে খুবই নজরে আনতে হবে। বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি, বাজার নিয়ন্ত্রণসহ সকল স্টেক হোল্ডারগণের নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থায় অবতীর্ণ হতে হবে।
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যদি যথাযথ কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে নজরদারি জারি রাখে। মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফাখোরী মানসিকতা বদলাতে হবে। তাদের মুনাফাবাজির তৎপরতায় উৎসাহ দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। দাম চড়িয়ে দিলে ভোক্তাদেরও সচেতন হয়ে ভোগের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। উৎপাদন, আমদানি ও বাজারে সরবরাহে সমন্বয় ঘটাতে হবে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর বিষয়টি আজ নতুন নয়। এতে জনজীবন যে বিপর্যস্ত হয়, কেউ বুঝতে চায় না। অসৎ ব্যবসায়ী, কালোবাজারি ও মুনাফালোভীদের কারণে এসব ঘটে। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছা ও মনিটরিং ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে সারা বছর। পণ্য বাজারে সরকারের নজরদারি ও সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। নিয়মিত মনিটর করতে হবে এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। বাজেট ও বাজার পরিস্থিতির ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ছাড়া আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আশা করি, নতুন বাজেট ঘোষণা নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরবে। তাছাড়া, বাজেট প্রণয়নের চেয়ে বাজেট বাস্তবায়নকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews