এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় বোধনের মাধ্যমে শুরু হয় ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার ঘুম ভাঙানোর পালা। তবে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এবারের দুর্গোৎসবে স্বাভাবিকভাবেই উৎসবের সেই রঙ অনুপস্থিত।
বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, দয়াগঞ্জের জাতীয় শিববাড়ি মন্দির, রমনা কালী মন্দির, আফতাবনগরের রাধাকৃষ্ন মন্দির, মুগদা সার্বজনীন মণ্ডপ, উলনের গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মন্দির ঘুরে ভক্তদের দেখা মিলেছে খুব কম।
ঢাকা মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কিশোর রঞ্জন মণ্ডল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মহামারীর কারণে আমরা মন্দিরে প্রতিমা দেখার সময় এমনিতেই কমিয়ে দিয়েছি। বলেছি, এবার কোনো উৎসব হবে না, হবে কেবল আনুষ্ঠানিকতা। সেই আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতেই আজ বিকালের দিকে ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণ খুলে দিলাম ভক্তদের জন্য। পূজা শেষ করেই তারা চলে যাবেন।
করোনাভাইরাসের কারণে ভক্তদের মন্দিরে আসতে নিরুৎসাহিত করার কথা জানিয়ে কিশোর রঞ্জন বলেন, “কাল থেকে সপ্তমী, কাল থেকেই নবমী পর্যন্ত টানা তিন দিন অঞ্জলী পর্ব আছে। আমরা অনলাইনের মাধ্যমে সে পর্বটা লাইভ করব। ভক্তরা ঘরে বসেই হাত জোড় করে মায়ের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাবেন। জনসমাগমের মাধ্যমে করোনাভাইরাস যেন না ছড়ায়, সে বার্তা আমরা প্রতিটি মণ্ডপে মণ্ডপে দিয়ে রেখেছি।”
জাতীয় শিববাড়ি মন্দির পূজা কমিটির সভাপতি রমেশ চন্দ্র পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে কোনো মন্দিরেই তো প্রাণ নেই। পুরোহিত এসেছেন। তার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন যারা, কেবল তাদেরই আসতে বলেছি। দর্শনার্থী যেন একেবারেই কম থাকে, আমরা সে ব্যাপারে নজর রাখছি। সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি আমরা মেনে চলার চেষ্টা করেছি।”
রমনা কালী মন্দিরে পূজার অর্ঘ্য দিতে এসেছিলেন প্রীতিলতা নন্দী। তার প্রশ্ন- এবার কী পূজা আদৌ হচ্ছে?
“এত শুধু বিধিনিষেধ, আর মণ্ডপে ঢোকামাত্র দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার তাগিদ! এভাবে পূজা হয় না। করোনাভাইরাস মহামারী সব আনন্দ মাটি করে দিয়েছে।”
মেরুল বাড্ডার শিব মন্দির পূজা কমিটির সভাপতি মাখন চন্দ্র দাস বলেন, স্বাস্থ্যবিধিকেই এবার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।
“এবার উৎসব মন্দিরে নয়, হবে গৃহে গৃহে। নিজে সুস্থ থেকে, অন্যকে সুস্থ রেখে আমরা মায়ের কাছে প্রার্থনা কর,ব যেন এই মহামারী কাল দ্রুত কেটে যায়। যেন আমরা সবাই আবার প্রাণের উৎসবগুলোতে সামিল হতে পারি।”
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রঞ্জিত চক্রবর্তী জানান, নিয়ম মাফিক ষোড়শ উপচারে দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আবাহন করেছেন তারা। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে ষষ্ঠ্যাদি কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজার মাধ্যমে শুরু হয় ষষ্ঠী পূজার মূল আচার।
“বিল্ববৃক্ষ (বেলগাছ) মহাদেবের ভীষণ প্রিয়, পদ্মযোনী ব্রহ্মাও বিল্ববৃক্ষে দেবীকে প্রথম দর্শন করেন। তাই আমরা দেবীকে বিল্ববৃক্ষ তলেই আবাহন করছি। আজ সন্ধ্যায় বিল্ববৃক্ষ তলে দেবী আবাহনের মধ্যে সংকল্প করেছি, দশমী পর্বন্ত যথাবিধ উপায়ে আমরা মায়ের পূজা করব।”
দেবীপক্ষের শুরু হয় যে অমাবস্যায়, সেদিন হয় মহালয়া; সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মহালয়ার প্রাক সন্ধ্যায় ‘কাত্যায়নী মুনির কন্যা’ রূপে মহিষাসুর বধের জন্য দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে।
কিন্তু পঞ্জিকার হিসাবে এবার আশ্বিন মাস ‘মল মাস’, মানে অশুভ মাস। সে কারণে ১৭ সেপ্টেম্বর মহালয়া হলেও দেবীর পূজা এবার হচ্ছে কার্তিক মাসে। দেবী দুর্গা ‘মর্ত্যে পৌঁছেছেন’ মহালয়ার ৩৫ দিন পরে।
দেবীপক্ষের সমাপ্তি হয় কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপূজার মধ্যে দিয়ে। এর মাঝে ষষ্ঠ দিন, অর্থাৎ ষষ্ঠীতে বোধন। আর দশম দিন, অর্থাৎ দশমীতে বিসর্জন। দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা এই পাঁচদিনই চলে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, তিন অবতারের আবির্ভাবকাল ত্রেতাযুগে ভগবান রাম তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করতে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন। ব্রহ্মার নির্দেশ অনুযায়ী দুর্গার সাহায্যে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন তিনি। দেবীর সেই আগমণের সময়ই দুর্গোৎসব।
রাম শরৎকালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন বলে এ পূজা শারদীয় দুর্গাপূজা নামেও পরিচিত। আর মর্ত্যলোকে আসতে দেবীর সেই ঘুম ভাঙানোকে বলা বলা হয় অকাল বোধন।
পুরোহিতরা বলছেন, দুর্গা দেবীর প্রকৃত আগমনের সময় চৈত্র মাস। অর্থাৎ বসন্ত কাল। চৈত্র মাসে যে দুর্গাপূজা হয় তাকে বলা হয় বাসন্তী পূজা। তবে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে শারদীয় পূজাই সবচেয়ে বড় উৎসব।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। এই ১৫টি দিন মর্ত্যলোকে উৎসব।
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে, সোমবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের দুর্গোৎসবের। একটি বছরের জন্য ‘দুর্গতিনাশিনী’ দেবী ফিরে যাবেন কৈলাসে দেবালয়ে।
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে শনিবার অষ্টমী তিথিতে এবার দেশের রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠে কুমারী পূজা হবে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ। প্রসাদ বিতরণ ও বিজয়া দশমীর শোভাযাত্রাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ বছর সারাদেশে তিন হাজার ২১৩টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। গতবারের তুলনায় এবার এক হাজার ১৮৫টি কম। এছাড়া ঢাকা মহানগরে এবার মণ্ডপের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩২টি, যা গত বছর ছিল ২৩৮টি।
এবার সপ্তমী শুক্রবার হওয়ায় হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী দুর্গা এবার আসবেন দোলায় চেপে। আর সোমবার দশমীতে কৈলাসে দেবালয়ে ফিরবেন হাতির পিঠে চড়ে।
দোলায় আগমন নিয়ে শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘দোলায়াং মরকং ভবেৎ’; অর্থাৎ মহামারী, ভূমিকম্প, যুদ্ধ, মন্বন্তর, খরার প্রভাবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু তো ঘটাবেই, আবার সেই সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতিও হবে।
এ বিষয়ে হিন্দু শাস্ত্র বলছে, ‘দোলায়াং মরকং ভবেৎ’। অর্থাৎ, দেবী পালকিকে চড়ে মর্ত্যে এলে তার ফল হয় বহু মৄত্যু ৷ তা হতে পারে মহামারী, ভূমিকম্প, যুদ্ধ, মন্বন্তর, খরার প্রভাবে।
আর হাতিতে চড়ে দেবী বিদায়ের ফল হয়- ‘গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা’ ৷ অর্থাৎ তাতে পৃথিবীতে জলের সমতা বজায় থাকে এবং শস্য ফলন ভালো হয় ৷ সুখ সমৄদ্ধিতে পরিপূর্ণ হয় মর্ত্যভূমি ৷
আরও পড়ুন
চট্টগ্রামে পুজোর আকাশে মেঘের ঘনঘটা
ঢাকায় এবার কুমারী পূজা হচ্ছে না
মহামারীর দিনে দুর্গোৎসবে ২৬ দফা নির্দেশনা