ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ ইসলামি সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, “ইরান এখন পরমাণু শিল্পের এক পরিপূর্ণ স্তরে পৌঁছেছে এবং পরমাণু জ্বালানি চক্রের প্রয়োজনীয় পূর্ণ সক্ষমতা অর্জন করেছে। এ চক্রের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদান ইরানের হাতে রয়েছে।” তিনি একে একটি পরমাণু শিল্প গঠনের ভিত্তি হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।

এই ঘোষণার অর্থ, ইরান এখন পরমাণু প্রযুক্তির এমন এক স্তরে পৌঁছে গেছে, যেখানে তারা বিদেশি কোনো সাহায্য ছাড়া নিজেরাই জ্বালানি তৈরি, প্রক্রিয়াকরণ এবং প্রয়োগ করতে পারবে। বিশ্বে এ সক্ষমতা অর্জনকারী অষ্টম দেশের মর্যাদা লাভ করল ইরান। পাশাপাশি মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ইরানিই প্রথম এমন সক্ষমতা অর্জন করে সম্পূর্ণ পরমাণু জ্বালানি চক্রের সক্ষমতা অর্জনের ইতিহাস গড়ল।

পরমাণু জ্বালানি চক্র বা নিউক্লিয়ার ফুয়েল সাইকেল বলতে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম উত্তোলন থেকে শুরু করে, তা পরিশোধন, সমৃদ্ধকরণ, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারে সক্ষম করে তোলাকে বোঝান হয়। ব্যবহৃত জ্বালানির পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ বা সংরক্ষণ করাও এই চক্রেরই অংশ।

পরমাণু জ্বালানি চক্রের ধাপগুলো যথাক্রমে, ইউরেনিয়াম উত্তোলন ও পরিশোধন অর্থাৎ ইয়েলোকেক উৎপাদন,ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইড বা ইউএফ৬ তৈরির মাধ্যমে গ্যাসে রূপান্তর, এই গ্যাসকে সেন্ট্রিফিউজের মাধ্যমে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ইউ-২৩৫কে আলাদা করা, জ্বালানি দণ্ড বা ফুয়েল রড সংযোজন, পরমাণু চুল্লিতে ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি তৈরি, পরমাণু চুল্লিতে জ্বালানির ব্যবহার এবং ব্যবহৃত জ্বালানির পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ বা নিরাপদ সংরক্ষণ।

জ্বালানি চক্রে দক্ষতা অর্জন মানেই, একটি দেশ পুরোপুরি স্বনির্ভর হয়ে নিজস্ব পরমাণু চুল্লি চালাতে সক্ষম হয়ে ওঠা। এরই দৌলতে, ভবিষ্যতে চাইলেই পারমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতাও খুব কম সময়ের মধ্যেই অর্জন করতে পারবে। ইরানে রাহবার হিসেবে পরিচিত সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী পরমাণু অস্ত্র তৈরি ও মজুদ রাখাকে সরাসরি হারাম হিসেবে ফতোয়া দিয়েছেন। ইরানও তার পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ বলে বারবার ঘোষণা করছে।

ইরানের মেহের নিউজ জানায়, দেশটির পরমাণু সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ ইসলামি সম্প্রতি ওফোগ বা দিগন্ত নেটওয়ার্কের ‘মর্দে ইরান’ নামের অনুষ্ঠানে আরো বলেন, পরমাণু প্রযুক্তি এমন একটি কৌশলগত ক্ষেত্র, যার বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার ও প্রযুক্তি উন্নয়নে বিশাল প্রভাব রয়েছে। তিনি একে শক্তি-সৃষ্টিকারী ও কর্তৃত্ব-নির্মাণকারী প্রযুক্তি হিসেবে তুলে ধরে বলেন, এই কারণে পাশ্চাত্য, বিশেষ করে আমেরিকা, পরমাণু প্রযুক্তিকে ওপর নিজেদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে বজায় রাখতে চায়।

তিনি আরো বলেন, পশ্চিমার চায় না ইরানের নিজস্ব চুল্লি থাকুক। তারা বলে, তোমরা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে পারো, কিন্তু এ জন্য জ্বালানি আমদানি করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমার এ অবস্থানে অনঢ় রয়েছে। এ বাবদ কিন্তু ইরানের উত্তর স্পষ্ট।

দ্বিমুখী নীতির জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে ইসলামি বলেন, তারা সন্ত্রাসী হামলা, নাশকতা—সবকিছুই করেছে ইরানকে পরমাণু অর্জনের পথ থেকে থামাতে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ করে আমেরকার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দখলদারিত্ব ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গেও কথা বলেন ইসলামি।

তিনি বলেন, আমেরিকার রাজনৈতিক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবাহ রয়েছে, যেটি ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত। এই গোষ্ঠীই ইরানকে সর্বোচ্চ চাপ দিয়ে ধ্বংস করতে চায়। পাশাপাশি তিনি বলেন, আমেরিকায় এমন একটি পক্ষও আছে যারা চায় ইরানকে বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিয়ে আলোচনায় আসতে চায়। কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বর পশ্চিমা মিডিয়ায় ওপর ক্ষমতাহীন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ইসলামির দাবি অনুযায়ী ইরানে পরমাণু সক্ষমতা ৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

তিনি বলেন, ইরান এখন এমন স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে তেহরানের রয়েছে নিজস্ব পরমাণু জ্বালানি তৈরির পুরো সক্ষমতা এবং পরমাণু চুল্লির নকশা তৈরি এবং নির্মাণের সক্ষমতা। ইরানের পরমাণ কার্যক্রম এবং সক্ষমতা আগের তুলনায় ছয় গুণ বেড়েছে বলে ঘোষণা করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, ২০ শতাংশ সমৃদ্ধ পরমাণু জ্বালানি গবেষণা চুল্লির জন্য প্রয়োজন। তেহরানের পরমাণু চুল্লি আমেরিকার তৈরি। আমেরিকা এবং কানাডা নিজেরা ৯০ শতাংশ ইউরেনিয়াম দিয়ে কাজ করে। অথচ আমাদের ২০ শতাংশ জ্বালানি নিয়েও কাজ করতে আপত্তি তোলে!

একতরফা সহযোগিতার ক্ষেত্রেও ইরান নজির স্থাপন করেছে। ইসলামি জানান,আমেরিকা এককভাবে জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন বা সংক্ষেপে জেসিপিও নামের সমঝোতা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরও ইরান একতরফাভাবে দেড় বছর ধরে জিসিপিও সমঝোতা বাস্তবায়ন করেছে। এ কাজটি করেছে শুধু আস্থা তৈরি করতে। কিন্তু পশ্চিমারা সত্যকে অস্বীকার করছে বলে অভিযোগ তুলেন তিনি।

ইরানের পরমাণু জ্বালানি চক্রে সক্ষমতা অর্জনের ঘোষণা শুধু বৈজ্ঞানিক বা কারিগরি দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্য একটি বড় বার্তা বহন করছে। এর মাধ্যমে ইঙ্গিত দেওয়া হলো যে, মুসলিম বিশ্বে প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত নেতৃত্বে ইরান আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল। এই ঘোষণা পাশ্চাত্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্যে এটি নতুন উত্তেজনা ও মেরুকরণ সৃষ্টি করতে পারে। মোহাম্মদ ইসলামির কথায় উঠে এসেছে, প্রকৃত সত্য পশ্চিমারা যেভাবে বলে তা নয়। তারা মনে করে, উন্নয়ন কেবল তাদের পতাকার নিচেই সম্ভব।

আমেরিকার সাথে চলমান পরোক্ষ পরমাণু আলোচনার সময় এ ঘোষণা দেয়া হলো। ষষ্ঠ দফা আলোচনায় বসার আয়োজন যখন ঠিক হয়ে গেছে তখনই অনেকের জন্য পিলে চমকানো ঘোষণাটি দিল ইরান।

সূত্র: মেহের নিউজ, ইরান।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews