বর্তমান পৃথিবী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখে দাঁড়িয়ে, যাকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থাও বলা যায়। সত্যি যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, তা অতীতের যে কোনো যুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি আতঙ্কের, অনেক ভয়াবহ পরিণতির কারণ হবে। কেননা, এতে আছে পারমাণবিক যুদ্ধে রূপান্তরের বৈশ্বিক ভয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল, তা যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণের জন্য নয়, কেবলমাত্র তাদের নতুন মারণাস্ত্রটি পরীক্ষা করার জন্য। এক্ষেত্রে জাপানের শহর দুটি হামলাকারী শক্তির কাছে নয়া মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষাগার ছিল মাত্র!

কিন্তু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রের একপক্ষীয় ব্যবহারের আশঙ্কা ক্ষীণ। আর পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হওয়ার মানে হবে বিশ্বজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ যা কারো জন্যই বিজয়সূচক হবে না। এ যুদ্ধে বিজয় হবে পরাজয়ের গ্লানির চেয়েও গ্লানিময়। তৃতীয় যুদ্ধ যে এতকাল না ঘটে ঠান্ডা যুদ্ধের বাক্সে আটকা পড়েছিল তার একটা কারণও এই পারস্পরিক ধ্বংসসাধনের ভয়। কিন্তু ঠান্ডা যুদ্ধের যুগ শেষ হওয়ার পরপরই পৃথিবী এককেন্দ্রিক ও তাই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, যার ফলে যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্র-পরিচালিত হামলা ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে।

আফগানিস্তান, ইরাক, মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া, ফিলিস্তিন হয়ে মার্কিন-ইসরায়েলি যৌথ হামলা এখন ইরানকে ছুঁইছুঁই করছে। অন্যদিকে কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বময় সম্পর্কও যুদ্ধাবস্থার রূপ নেয়। এশিয়ায় চীনের উত্থান রুখতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত নানা ধরনের বাণিজ্যিক ও সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে যা বিরাট যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। ইউক্রেইনে রুশ হামলা চলমান। অন্যদিকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার পর বর্তমানে ফিলিস্তিনে চলছে ইসরায়েল পরিচালিত ইতিহাসের সবচেয়ে নির্লজ্জ প্রকাশ্য গণহত্যা। আরও বহু স্থানে যুদ্ধের দামামা বেজেই চলেছে বিরতিহীন। অতীত কালের পৃথিবীতে সংঘটিত যুদ্ধের সঙ্গে এটি এক মৌলিক পার্থক্য। এই পার্থক্যের নাম যুদ্ধ অর্থনীতি।

মানুষ কর্তৃক মানুষের হত্যা ইতিহাসে সুপ্রাচীন। কিন্তু সেটি একটি ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্পে রূপ নিতে দীর্ঘ সময় লেগেছে– এটি পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। কার্ল মার্কস একে বলেছেন ‘হিউম্যান স্লটার ইন্ডাস্ট্রি’ বা মানুষ হত্যার শিল্প। ১৯৪০-এর দশকে যুদ্ধ অর্থনীতির প্রসঙ্গটি প্রথম উত্থাপন করেন যুক্তরাষ্ট্র সরকারে কর্মরত মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ এডওয়ার্ড সার্ড। ১৯৪৪-এ ওয়ালটার জে. ওকস ছদ্মনামে তিনি প্রকাশ করেন তার প্রবন্ধ: টুওয়ার্ডস এ পারমানেন্ট ওয়ার ইকোনোমি।

যদিও যুদ্ধকে বৈশি^ক পর্যায়ে মানুষ দেখতে পায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে এর গুণগত পরিবর্তন ঘটে। এ সময় ১৯৩৯ ও ১৯৪৪-এর মাঝে অস্ত্রের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় জার্মানিতে ৫ গুণ, জাপানে ১০ গুণ, ব্রিটেনে ২৫ গুণ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ গুণ। (পারসপেকটিভস অব দ্য পারমানেন্ট ওয়ার ইকোনোমি, টনি ক্লিফ, মে ১৯৫৭, অনলাইন) এভাবে এটি রূপান্তরিত হয়ে যায় সার্ড-কথিত পারমানেন্ট ওয়ার ইকোনোমি বা স্থায়ী যুদ্ধ অর্থনীতিতে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধ অর্থনীতিতে উত্তরণের কথা বলেছিলেন দেশটির ৩৪তম প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার ১৯৬১ সালে তার বিদায়ী ভাষণে। এই ভাষণে তিনিই প্রথম ‘সামরিক শিল্প কমপ্লেক্স’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেন এবং তার উৎপত্তিকাল ও বিপজ্জনক ভূমিকারও ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেছিলেন, “সাম্প্রতিক কালের বৈশি^ক সংঘর্ষের পূর্ব পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র কারখানা ছিল না। আমেরিকার লাঙ্গল প্রস্তুতকারকরাই প্রয়োজনের সময় তরবারি তৈরি করত। কিন্তু এখন আর আমরা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এই জরুরি সমাধানের ওপর নির্ভর করতে পারি না। আমরা বাধ্য হয়েছি বিশাল আকৃতির অস্ত্রের কারখানা তৈরি করতে। এর সঙ্গে ৩৫ লাখ মানুষ এখন নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নিয়োজিত রয়েছে। বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্পকারখানা থেকে যা আয় হয় আমরা তারচেয়ে বেশি ব্যয় করি নিরাপত্তা খাতে।”

তিনি সামরিক স্থাপনা ও শিল্পকারখানার এই মিলনকে আশঙ্কার দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। সতর্ক করেছিলেন যে, এ দুয়ের মিলন সমাজকাঠামোকেও বদলে দিতে পারে। ওই ভাষণে তিনি আরও বলেছিলেন, “সরকারের সংস্থাগুলোয় আমাদেরকে সতর্ক প্রহরায় থাকতে হবে এই সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সের জানা ও অজানা অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাবের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে অযাচিত ভ্রান্ত ক্ষমতার বিপজ্জনক সম্ভাবনা রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।”

স্পষ্টতই তরবারি তৈরির আর মিসাইল তৈরির অর্থনীতিতে আকাশ-পাতালের ফারাক বিদ্যমান। বর্তমানে বিকশিত পুঁজিবাদী দেশের এই যুদ্ধ অর্থনীতি কেবল অযাচিত ভ্রান্ত ক্ষমতায় নয়, এক জীবন্ত দানবে রূপান্তরিত হয়েছে। যাকে নিশ্চিহ্ন করা একটি অতি প্রয়োজনীয় ও অতি দুরূহ কাজ। অথচ যুদ্ধ অর্থনীতিকে রক্তশূন্য করার মধ্যেই মানবজাতির সমস্ত আশাভরসা নিহিত। একে বাঁচিয়ে রাখা ও আর বিকশিত হতে দেয়া হচ্ছে মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করার দলিলে স্বাক্ষর দেয়া। এ এমনই এক মায়াময় শক্তিশালী দানব যে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়Ñ যুদ্ধ অর্থনীতির এ দানবকে রুখতে হলে আরও বড় যুদ্ধ প্রয়োজন। আর সেটাই হলো যুদ্ধ অর্থনীতির ফাঁদে পা দেয়া।

যুদ্ধবাজরা এই ফাঁদই তৈরি করে। এ বছর মার্চে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ঘোষণা করেন যে, ফ্রান্স তার জিডিপির ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করবে এবং তিনি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে আহ্বান করেন সধারণ প্রতিরক্ষা খাতে ২০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের জন্য। অনেক দিন ধরেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপে একটি যুদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা বলছিলেন তিনি। সামাজিক কল্যাণমূলক খাতগুলো থেকে অর্থ কেটে সামরিক খাতে ব্যয়ের মহাপরিকল্পনা করছেন তারা।

একই সময়ে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন ঘোষণা করেন যে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ‘নতুন অস্ত্রসজ্জার যুগে’ ঢুকেছে এবং সদস্য রাষ্ট্রসমূহে সামরিক বিনিয়োগের জন্য ১৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণের আশ্বাস দেন তিনি। বলেন, “আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়ঙ্কর এক সময়ে বাস করছি। আমরা যে হুমকির মুখে বাস করছি সে প্রকৃতি ও তা বাস্তবায়িত হলে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হবে তা বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই।” সামরিক খাতে এই ব্যয় ইউরোপের জন্য আরও ৮০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। (ফ্রান্সে’স ‘ওয়ার ইকোনোমি’ ইজ এ প্রিলুড টু কাটিং দ্য ওয়েলফেয়ার স্টেট, মার্লোন এটিঙ্গার, জ্যাকোবিন, ১০ মার্চ ২০২৫)

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভূত দোরগোড়ায়, তাই সবাইকে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এই অজুহাতে কমবেশি যুদ্ধের দামামা বাজছে সর্বত্র। এ প্রতিযোগিতায় আমাদের প্রতিবেশীরাও নেমে পড়েছেন। আর প্রতিবেশীদের ঘরে আগুন লাগলে আমরাও যে বসে থাকতে পারব না তা কে-ই বা না জানে। সবাই কমবেশি শক্তিপরীক্ষার আনন্দে মশগুল!

তো এই যে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তনের একটা খণ্ড যুদ্ধ হয়ে গেলÑ তাতে কার লাভ আর কার লোকসান হয়েছে? কাশ্মীরই এই সংঘর্ষের মূলে, সেখানকার জনগণের স্বাধীনতার প্রশ্নটির কিছুমাত্র সুরাহা হয়েছে? ভারত-পাকিস্তানের সংঘর্ষের ফলাফল বিশ্লেষণে লক্ষণীয় তাদের সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠত্বের তুলনা। ভারত কাদের অস্ত্র ব্যবহার করে পাকিস্তানে আক্রমণ করল আর পাকিস্তান কাদের অস্ত্র ব্যবহার করে সেই আক্রমণ ঠেকালÑ এইসব চুলচেরা বিশ্লেষণে কাশ্মীরের জনগণের স্বাধীনতার প্রশ্নটি কই? শেষ পর্যন্ত ফ্রান্স না চীন জিতলÑ এই নিয়ে তর্কবিতর্ক। ভারত ও পাকিস্তানের কেউ জিতল কি? আর কাশ্মীর গেল কোথায়? ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নটিও যেন গাজায় ট্রাম্পের আনন্দশালা তৈরির পরিকল্পনার নিচে ঢাকা পড়ে না যায়!

যুদ্ধ ঠেকাতে আরও যুদ্ধ, অস্ত্র রুখতে আরও অস্ত্রÑ যুক্তির এই দুষ্টজাল থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রত্যেক দেশে শ্রমজীবী মানুষের সচেতনতা ও যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক শক্তিকে রক্তশূন্য করে দেয়ার বৃহৎ বৈশ্বিক পরিকল্পনাই কেবল যুদ্ধদানবকে সঠিকভাবে রুখতে পারে। কোনো জাতি, ধর্ম, ভাষা ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নয়, যুদ্ধের বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী ঘৃণাই কেবল রক্ষা করতে পারে যুদ্ধবাজদের হাতে জিম্মি বর্তমান মানবতাকে। যুদ্ধের আফিম থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করাই আজ সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews