উত্তরবঙ্গের রাস্তায় অটোরিকশা চলাচলের একটি বড় সমস্যা হলো, এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীনতা। অধিকাংশ অটোচালক অপ্রশিক্ষিত, বৈধ লাইসেন্স নেই। ‘ট্রেনিং কার’ লিখে যে সব কিশোরের ড্রাইভিং শেখার কথা, তারাই যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় মেতে থাকে। তাদের জন্য রাস্তাঘাটে গতিসীমা, ট্রাফিক সিগন্যাল, একমুখী রাস্তা সবই কাগুজে আইন। গ্রামীণ বা আঞ্চলিক সড়কে এগুলো ৩-চাকার বাইসাইকেল।

জনজীবনে এদের দাপটের প্রভাব ভয়াবহ। চারদিক থেকে প্রতিদিন দুর্ঘটনার খবর আসে তাদের কারণে। যাত্রী আহত, পথচারী নিহত, মোটরসাইকেল বা সাইকেল আরোহী পিষ্ট হওয়ার ঘটনা যেন নিত্যদিনের ঘটনা। অনেক সময় চালকরা নিজেরাও আহত বা নিহত হয়। কারণ, অটোরিকশা ধাক্কা সামলানোর মতো কাঠামোগত নিরাপত্তা বহন করে না। যাত্রী পরিবহনের প্রতিযোগিতা, তাড়াহুড়া, অতিরিক্ত বোঝা, সব মিলিয়ে অটোদানবের ছুটে চলা আসলে মৃত্যুর সঙ্গে দৌড় দেবার নতুন প্রতিযোগিতা।

প্রশাসনের ভূমিকা এখানে সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক জায়গায় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বা প্রভাবশালী মহলের মদদে এই অটোরিকশা বাহিনী অপ্রতিরোধ্য। রাস্তায় অবৈধভাবে চলাচল, রুট পারমিট ছাড়া বহর গঠন, অবৈধ গ্যারেজÑ সবই যেন প্রকাশ্য গোপন সত্য। পুলিশও প্রায়শই তদারকি না করে চোখ বন্ধ রাখে, কারণ রাজনৈতিক চাপ, ঘুষ কিংবা মামা-ভাগ্নে সম্পর্ক। যাত্রীদেরও সচেতনতার ঘাটতি আছে। মাত্র ১০ টাকার ভাড়ায় বাসস্ট্যান্ড থেকে হাট পর্যন্ত পৌঁছে দেয় যে বাহন, তার কাছে নিরাপত্তা নিয়ে দরকষাকষি করার সুযোগ কম। তাছাড়া গ্রামীণ বা অপ্রতুল গণপরিবহনের এলাকায় অটোরিকশা একপ্রকার বাধ্যতামূলক সমাধান। কিন্তু এই সহজ সমাধানই যখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়, তখন সমাজের চুপ করে থাকা বিপজ্জনক।

এ সমস্যার সমাধানে প্রথমত প্রয়োজন নীতিগত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বৈধ রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স ছাড়া কোনো অটোরিকশা যেন রাস্তায় না চলে, তা নিশ্চিত করতে হবে। চালকদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে, কিশোরদের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি পৌরসভা ও উপজেলা প্রশাসনকে নির্দিষ্ট রুট ও স্টপেজ নির্ধারণ করতে হবে এবং অতিরিক্ত যাত্রী তোলা বা দ্রুতগতির প্রতিযোগিতা বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। সর্বোপরি, মানুষকে বুঝতে হবে অটোরিকশা কোনো স্বর্গীয় বাহন নয় যে নবম বেহেস্তের নিশ্চিন্ততা নিয়ে যাত্রা করা যায়। বরং শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা না ফিরলে এই অটোদানবই রাস্তাঘাটে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ করবে। উত্তরবঙ্গের সড়ক যদি জীবনের সড়ক হয়ে থাকতে চায়, তবে এই নিয়ন্ত্রণহীন দৌড়ের লাগাম এখনই টেনে ধরা জরুরি।

উত্তরবঙ্গের রাস্তাঘাট আজকাল এক ধরনের দ্বন্দ্বক্ষেত্র। একটি পক্ষ সোজা পথে বেরোতে চায়, অন্যটি রুট, সিগনাল, ফুটপাত, পার্কিং সবকিছুই দখল করে বসে। সেই অটোদানব অবৈধ, অনিয়ন্ত্রিত অটোরিকশা নিশ্চিতভাবে এখন শুধু ঝামেলা নয়; মৃত্যুর সরাসরি কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজশাহী, চাঁপাইনাবগঞ্জ, নওগাঁ, রংপুর, সৈয়দপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, নাটোরের সাম্প্রতিক সংবাদই এ বাস্তবতার আংশিক প্রতিচ্ছবি। রাজশাহী মহানগরে বেপরোয়া রিকশা ও অটোরিকশার অপ্রশিক্ষিত চালকদের কারণে দুর্ঘটনা ও যানজট বেড়েছে। এজন্য নগরবাসীর দৈনন্দিন চলাচলই কঠিন হয়ে পড়েছে।

দেশের সড়কদুর্ঘটনামূলক মৃত্যুর অনুপাত বছরের পর বছর ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে চলেছে। এজন্য দেশজুড়ে প্রতি বছর হাজার হাজার প্রাণ হারাচ্ছে। এই জাতীয় কর্মক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গও পিছিয়ে নেই; রাস্তায় অটোরিকশা-জড়িত বিভিন্ন লঘু-গুরুতর দুর্ঘটনার খবরে বছরভর সংবাদস্থল ভরা থাকে। যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, কেন অবৈধ অটোরিকশা বিপজ্জনক? কারণ, এর নিরাপত্তার শূন্যতা। অধিকাংশ অবৈধ অটো রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস সার্টিফিকেট বা যথাযথ বোঝাই-নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই চলাচল করে; তাতে কোনো ক্র্যাশ-প্রোটেকশন নেই। অনেক কিশোর চালক বেপরোয়াভাবে অটো চালায়। তাদের চালক-প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। লাইসেন্সহীন বা অনভিজ্ঞ চালক তৎক্ষণাত সিদ্ধান্ত নেয়; ওভারটেকিং, উল্টোদিকে ঢোকার প্রবণতা বেশি। তারা সিগনাল, ওয়াকওয়ে, একমুখী নির্দেশÑ এসব কাগজে থাকলেও বাস্তবে মানা হয় না; ফলে পথচারী ও আরোহীরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। বিশেষ করে গ্রাম থেকে অটোচালকরা একবার ব্যাটারি চার্জ করে গাড়ি নিয়ে সকালে শহরগুলোতে আসে। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে ব্যাটারির চার্জ কমে গলে রাতে লাইট জ্বালায় না। সিগন্যাল লাইটও জ্বলে না। সে অবস্থায় লাইটবিহীন তারা অনেক রাত অবধি ভাড়ায় খাটে। এটা পথচারী ও অন্যান্য গাড়ির জন্য মারাত্মক।

উত্তরবঙ্গের রাস্তায় অটোদানব দমন করতে নীচের ব্যবস্থা জরুরি। এদের নিবন্ধন ও ফিটনেস বাধ্যতামূলক করা উচিত। এজন্য অবৈধ অটোরিকশা দ্রুত চিহ্নিত করে জব্দ-অপারেশন বাড়াতে হবে; নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিটনেস পেতে না পারলে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। চালক-লাইসেন্স ও প্রশিক্ষণ বাধ্যতামক করা দরকার। জেলা স্তরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়মিত ড্রাইভিং-সেফটি ও রোড-এথিক্স কোর্স পারফরম্যান্স ভিত্তিক লাইসেন্স রি-ইস্যু করা দরকার। অর্থায়নে ন্যানো লোন বা ভর্তুকি দিয়ে চালকদের উৎসাহিত করা যেতে পারে।

তাদের জন্য নির্দিষ্ট রুট, স্টপেজ ও সময়সূচি নির্ধারণ করে দিতে হবে। বাজার, স্কুল, হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় অটোরিকশা স্ট্যান্ডের নির্দিষ্ট জোন করে রাতের কোনো নির্দিষ্ট ঘণ্টায় মহাসড়ক পারাপারে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। স্থানীয় পৌরসভা-উপজেলা সমন্বয়ে পূর্ণ-রুট ম্যাপ তৈরি করে বাস্তবায়ন করতে হবে। পুলিশি তদারকি এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা জোরদার করে জরিমানা, আর্থিক দ- নীতি, পুনরাবৃত্ত অপরাধে গাড়ি বাজেয়াপ্ত ও পরবর্তী কোর্ট কার্যক্রম দ্রুততর করা উচিত। এজন্য মাঠ প্রশাসনকে দ-বিধি প্রয়োগে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হতে হবে।

এই সংকট মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয় নীতিই শেষ কথা নয়। স্থানীয় রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী শ্রেণীরও দায় আছে। রুট-আইন লঙ্ঘনে চলমান ছায়া অর্থাৎ কোনো রাতারাতি অভিযান না বরং ধারাবাহিক মনিটরিং ও স্বচ্ছ রিপোর্টিং ব্যবস্থা রাখতে হবে। রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, নাটোরের সীমান্তহীন উদাহরণ দেখিয়ে দেয়, অ্যাকশন না নিলে ক্ষতি সারা উত্তরবঙ্গ জুড়ে ছড়াবে। ঢাকার মতো পঙ্গু করে দেবে দেশের জাতীয় সড়কপথসহ সকল অলিগলি!

অটোরিকশা এলাকায় দ্রুত যাতায়াত ও অর্থনৈতিক সুযোগ এনে দেয়, তা আমরা সবাই মানি। কিন্তু সেই সুবিধা যদি প্রতিদিনের রুটিনকে মৃত্যু বোঝায়, তাহলে সহজ সমাধানই বড় বিপদ। উত্তরবঙ্গের সব রাস্তায় নিয়ন্ত্রণহীন অবৈধ অটোরিকশার দাপট প্রথাগতভাবে সামলানো সম্ভব নয়; প্রয়োজন সমন্বিত, স্থায়ী ও সুশাসনমুখী উদ্যোগ যেখানে আইন, প্রযুক্তি, স্থানীয় অংশগ্রহণ ও জনসচেতনতা একসঙ্গে কাজ করবে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।
E-mail: [email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews