ছাত্র সমন্বয়কদের নামে দেশব্যাপী চাঁদাবাজির ভয়াবহ চিত্র এখন ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে। গত ২৬ জুলাই গুলশানের ৮৩ নম্বর বাসায় চাঁদাবাজি করতে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) কয়েকজন নেতা চাঁদাবাজি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। এর নেতৃত্বে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান রিয়াদসহ চারজন। তারা পতিত আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি শাম্মী আহমেদের স্বামী সিদ্দিক আবু জাফরকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। তিনি তাদের ১০ লাখ টাকা দেন। পরবর্তীতে ২৬ জুলাই তারা আবারও তার বাসায় গিয়ে বাকি ৪০ লাখ টাকা দাবি করে। না দিলে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। সিদ্দিক আবু জাফর কৌশলে পুলিশকে ফোন দিলে তারা চাঁদাবাজ সমন্বয়কদের ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনার পর সিদ্দিক আবু জাফর গুলশান থানায় বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ১৭ জুলাই সকাল ১০টার দিকে আসামি রিয়াদ ও অপু গুলশানের ৮৩ নম্বর রোডের বাসায় যায়। সেখানে গিয়ে তারা হুমকি-ধমকি দিয়ে ৫০ লাখ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার দাবি করে। দাবি মেনে না নিলে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে পুলিশের মাধ্যমে গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়। চাপে পড়ে সিদ্দিক আবু জাফর ৫ লাখ টাকা নিজের কাছ থেকে এবং আরও ৫ লাখ টাকা ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে মোট ১০ লাখ টাকা দেন। এজহার থেকে আরও জানা যায়, ২৬ জুলাই বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে রিয়াদের নেতৃত্বে ৪ জন শাম্মী আহমেদের বাসার সামনে হাজির হয় এবং বাকি ৪০ লাখ টাকা না দিলে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। বিষয়টি গুলশান থানায় জানালে পুলিশ তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করে। তবে আসামি কাজী গৌরব অপু পালিয়ে যায়। আরেক আসামি একজন কিশোর। আদালত রিয়াদসহ চারজনকে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এ ঘটনার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করেছে।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনে সমন্বয়কদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্ম সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তাদের নেতৃত্বে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষসহ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা আন্দোলনে নেমে হাসিনার পতন ঘটিয়েছে। এনসিপির বর্তমান কেন্দ্রীয় নেত্রীবৃন্দ ও অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা উপদেষ্টাসহ ছয় সমন্বয়ক ছিলেন সামনের সারিতে। দেশের মানুষ এদেরই চেনে-জানে। পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় দেড় শতাধিক ছাত্র সমন্বয়কের কথা প্ল্যাটফর্ম থেকে জানানো হলেও দেশের মানুষ সামনের সারির সমন্বয়কদের ছাড়া বাকিদের চেনে না। এর ফলে দেশের আনাচে-কানাচে অনেকে নিজেকে সমন্বয়ক দাবি করে চাঁদাবাজি, তদবিরবাজি, অবৈধ দখলসহ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নানা অপকর্ম করা শুরু করেছে। তাদের এই অপকর্মের মূল অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়িছে ‘আওয়ামী দোসর’ আখ্যা দেয়া। সাধারণ মানুষ এই তথাকথিত সমন্বয়কদের ভয়ে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। মাঝে মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব সমন্বয়কের চাঁদাবাজির তথ্য প্রকাশ হলেও অনেকেই চুপ থাকে। গুলশানের এ ঘটনায় সমন্বয়কদের চাঁদাবাজি ও অপকর্মের একটি চিত্র উঠে এসেছে। ভুক্তভোগীদের মতে, বিশাল হিমশৈলীর চূড়ার মতো এটি তথাকথিত সমন্বয়কদের সীমাহীন চাঁদাবাজি ও মাস্তানির একটি মুখ মাত্র। পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ায় তাদের অপকর্মের এক পার্সেন্ট খবরও আসে না। গুলশানের ঘটনা নিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেফতারকৃত আসামিরা সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ দলের সদস্য। তারা দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে ছাত্র সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে অস্ত্র মামলায় আসামি করাসহ বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায় করে। বিভিন্ন সময় অনেকে এসব ঘটনার শিকার হলেও আসামিদের ভয়ে তারা মুখ খুলত না। পুলিশের গুলশান বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে সংগঠনের পদ-পদবি ব্যবহার করে সংঘবদ্ধ একটি চাঁদাবাজ চক্র গুলশান বনানী এলাকায় গড়ে উঠে। তারা ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন ব্যক্তির বাসায় হামলা ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ছিল। এছাড়া মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়, ডোনেশনের নামে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়সহ নানা অপকর্মে জড়িত ছিল। টার্গেট করে তারা বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে চাঁদাবাজি করতো। কাক্সিক্ষত চাঁদা আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা মানুষকে হয়রানি করতো। গত ১১ মাস ধরে তারা কতো মানুষকে হয়রানি করে টাকা আদায় করেছে, তার হিসাব পুলিশের খাতায়ও নেই। গুলশান, বনানী, বাড্ডা, ভাটারাসহ বাকি থানাগুলোতে এদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মৌখিক অভিযোগের পাহাড় জমেছে। বিভিন্ন সময় পুলিশ ভুক্তভোগীদের মামলা করার পরামর্শ দিলেও তারা ভয়ে নীরব ছিল। সমন্বয়ক নামধারী চাঁদাবাজরা আগেই হুমকি-ধমকি দিয়ে রাখতো। কেউ তাদের কথার বাইরে গেলে মব সৃষ্টি করে হেনস্তা করতো। এমনকি, তারা পুলিশের বিরুদ্ধেও মব সৃষ্টি করার হুমকি দিত। গ্রেপ্তারের সময়ও পুলিশ সদস্যদের চাকরি কীভাবে থাকে, এই হুমকি দিয়েছে। থানায় নিয়ে আসার পর বিভিন্ন মহল থেকে তাদের ছেড়ে দেয়ার চাপও সৃষ্টি করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া সমন্বয়কদের অবদান অনস্বীকার্য। তারা আজীবন দেশের ‘হিরো’ হয়ে থাকতে পারত। তাদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকত। অথচ ঘটেছে উল্টো। তাদের গায়ে এখন সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজির ট্যাগ লেগে গেছে। মানুষের কাছে তারা আতংকবাদী হয়ে উঠেছে। তারা শেখ হাসিনার মতোই দেশটা তাদের মনে করে যা খুশি তা করার অপকর্মে নেমে পড়েছে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের গডফাদার ও ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে যেমন সাধারণ মানুষ দেড় দশক ধরে অসহায় ও ভীতিকর জীবনযাপন করেছে, একইভাবে তথাকথিত সমন্বয়করাও গত ১১ মাসে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ভয়ের অপসংস্কৃতি বজায় রেখেছে। সমন্বয়ক নামে গজিয়ে ওঠারা দেশের স্থিতিশীলতার জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। এর দায় নবগঠিত এনসিপি এড়াতে পারে না। কারণ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্ম তার ছাত্র সংগঠন ও সহায়ক শক্তি হিসেবে পরিচিত। অথচ গণঅভ্যুত্থানের পর এই প্ল্যাটফর্মের কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না। সমন্বয়কদের পড়াশোনায় ফিরে যাওয়ার কথা। তা না করে, তারা চাঁদাবাজিসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকে জিম্মি করে ফেলেছে। তারা বিপথে চলে গেছে। তাদেরকে লোভে পেয়ে বসেছে। হাসিনাও ক্ষমতার লোভে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিল। যার পরিণতি কি হয়েছে, তা বলা নিষ্প্রয়োজন। সমন্বয়করা এ থেকে শিক্ষা নিতে পারেনি। এর দায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও এড়াতে পারেন না। তার প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় রয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। কারণ, তিনি আগেই বলেছিলেন, ছাত্ররাই তাকে প্রধান উপদেষ্টা বানিয়েছে। তার এ কথা পুঁজি করে কথিত সমন্বয়করা দুর্বিনীত ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ছাত্র সমন্বয়ক বলতে এখন কিছু নেই। যেটা ছিল, সেটা চলে গেছে। গণঅভ্যুত্থানের পরই তাদের দায়িত্ব শেষ হয়েছে। এখন যারা সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে, তারা সন্ত্রাসী। দেশে তারা অরাজকতা সৃষ্টি করছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘিœত করছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বিএনপির একশ্রেণীর বিপথগামী নেতাকর্মীর চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি নিয়ে সরব। অথচ সমন্বয়কদের নামে যে এন্তার চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা- হচ্ছে, সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে, তা নিয়ে কোনো কথা বলছে না। এটা দ্বিচারিতা ছাড়া কিছু নয়। পর্যবেক্ষকদের মতে, গুলশানে সমন্বয়ক নামধারীদের যে অপকর্ম প্রকাশিত হয়েছে, দেশব্যাপী সমন্বয়কদের বেশুমার অপকর্ম অচিরেই প্রকাশিত হবে। কিছু কিছু প্রকাশ হওয়া শুরু হয়েছে। ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে কোনো কিছুই এখন আর গোপন থাকে না। সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে মাঠে থাকলেও কি করে এসব ঘটনা ঘটছে? এর সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না কেন? সেনাবাহিনীর উচিৎ এ ব্যাপারে আরও সক্রিয় হওয়া। সমন্বয়ক পরিচয়ধারীদের অপকর্মের কথা গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অজানা থাকার কথা নয়। তাদের উচিত হবে, অপরাধী যেই হোক, যতই প্রভাবশালী হোক, কোনো ধরনের অনুকম্পা না দেখিয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া। চুপ করে বসে থাকার সুযোগ নেই। তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews