এমন সব মানুষের কথা ধরা যাক। ভাবা যাক, সেসব মানুষ কোনো এক শহরে থাকে। চেনা শহর, চেনা সময়। সবই তাদের চেনা। অথচ সময় গড়ালে চেনা সবকিছু অচেনাও হয়। আবার মনে হয়, তারা কাউকে নিয়ে অনেক ভাবে, অনেক চিনে ফেলেছে। দিনশেষে আসলেই কি? দেখা যায়, চেনে, বোধ হয় চেনে না। তারা ভালোবাসা দেয় কাউকে। কিন্তু তাতে একটা 'কিন্তু' থেকে যায়। যখন কিছু স্বপ্টম্নাতীত তখন তাদের মনে হয়, অনেক বেশি ভালোবেসেছে সেটা। আসলেই কি? দেখা যায়, ভালো বাসে, আবার বোধহয় বাসে না! সাম্প্রতিককালে জনপ্রিয় একটি বাংলা গানের কথার মূলভাব ধরে রেখে আমি একটু এদিক-সেদিক করে বললাম। গানটির কথা ও সুর সিনা হাসানের। এ-গানের নাম তিনি দিয়েছেন 'কনফিউশন'। বাংলায় বললে 'দ্বিধা'। আমার আলাপ এখানেই। ওপরে উল্লিখিত সব দ্বিধা কার বা কাদের? বুঝতে বাকি থাকে না, মধ্যবিত্তের। সিনার সুবাদে এই গানের মধ্য দিয়ে আমরা মধ্যবিত্তের স্বভাবের পরিচয় পাই। এর বাইরেও এগানের ভিন্ন অর্থ থাকতে পারে কারো কাছে, এমনকি সিনার কাছেও। কিন্তু আমি 'মধ্যবিত্ত'-এর অর্থবোধকতার জায়গা থেকেই গানটিকে দেখেছি। গানটি শুনলে যেকোনো শ্রোতা সেটি উপলব্ধি করতে পারবেন। গানে সিনা আরো গেয়েছেন, 'সবাই ছুটে চলে একলা কিংবা দলে দলে/ ঠিক কিংবা ভুলে/ বইতে বইতে কেমনে কেমনে কেমনে সব এক হয়ে যায়!' মধ্যবিত্ত এমনই। সব অপ্রাপ্তি একসময় অভ্যাসে পরিণত হয় তার। না পেতে পেতে সয়ে যায়। নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। গানের শেষ কথাগুলোও মধ্যবিত্তের স্বভাবকে শনাক্ত করে :
'সুখ-দুখ কষ্টের পাহাড়ের ঝর্ণার মত বয়ে চলা মানুষদের,
আমি ডাকি না আমি ডাকি না আমি ডাকি না, নাকি ডাকি?
আমি চিনি না আমি চিনি না, নাকি চিনি?
কাউকে আমি চিনি না, আবার বোধহয় চিনি!
কাউকে ভালোবাসি না, আবার বোধহয় বাসি!'
এই যা চেনা, একটু পর অচেনা; এই যা ভালোবাসা, একটু পর অভিমান কিংবা ঘৃণা-এইসব নিয়ে মধ্যবিত্ত। গান থেকে এবার একটু সিনেমায় যাই। পঞ্চাশ দশকে মুক্তি পেয়েছিল ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা 'নাগরিক'। এই সিনেমার বিষয়, স্বাধীনতাউত্তর শহর কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণি। একটি পরিবার। পরিবারের প্রধান চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সংসার। অসুখের খরচ মেটাতে গিয়ে নিজের বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়েছে তাকে। পেনশনের যেমন আয়, তেমন ব্যয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছেন কলকাতার সস্তা ভাড়ার ঘিঞ্জি একটা পাড়ায়। ছোট পুরোনো একটা বাড়ি। পরিবারের কন্যাটির বিয়ের 'বয়স' হলেও বিয়ে হয়নি। বয়সের কারণে পাত্রপক্ষের অপছন্দ। ছেলেটি লেখাপড়া শেষে চাকরিপ্রত্যাশী। ইন্টারভিউ দিয়ে স্বপ্টম্ন দেখে, এক মাসের মধ্যেই চাকরিটা হয়ে যাবে, ভাগ্য বদলে যাবে। পুরোনো ঘরের দেয়ালে টাঙানো একটা পুরোনো ক্যালেন্ডার। একটা মাঠ পেরিয়ে একটা লাল টালির বাড়ির ছবি। চাকরি হলে তার প্রেমিকাকে বিয়ে করবে এবং এরকম একটা বাড়িতে সবাই মিলে সুখে-শান্তিতে বাস করবে-এমন স্বপ্টেম্ন আচ্ছন্ন সে। অথচ মাস পেরোলেও হয়ে যাওয়া চাকরিটা আর হয় না। এভাবেই মাসের পর বছর গড়ায়! এই তো আমাদের চেনা মধ্যবিত্ত! এসব বৈশিষ্ট্য না থাকলে কেউ আর মধ্যবিত্ত থাকে না। ফলে এসবের মধ্যেই মধ্যবিত্তকে থাকতে হয়। মধ্যবিত্তের সামনে দুটি পথ খোলা। হয় উচ্চবিত্ত হও, না হয় নিম্নবিত্তের কাতারে যাও। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্ত বিত্ত ভাঙতে ভয় পায়। যা আছে তাই ধরে রাখতে মরিয়া। এদেশের মধ্যবিত্তের নানা সংকট আছে, থাকবে। কিন্তু এই সময়ে দেশের মধ্যবিত্তের সবচেয়ে বড় সংকট দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা পণ্যের দাম। মধ্যবিত্ত নিজের দুর্বলতা প্রকাশে লজ্জা পায়। অথচ অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে, এক মধ্যবিত্তের সঙ্গে আরেক মধ্যবিত্তের দেখা হচ্ছে এখন টিসিবির লাইনে! হয়তো একে-অপরকে দেখে মুখ লুকায়। চোখে চোখ রাখতে পারে না। মধ্যবিত্তের জায়গা থেকে এমন ঘটনার অভিজ্ঞতা ভয়ংকর। আমি ভাবছি, সেই মধ্যবিত্ত দুটি পরিবারের কথা। যে দুটি পরিবারের ছেলে ও মেয়ের মধ্যে পারিবারিকভাবে বিয়ের কথা চলছে। বিয়ের কথা চলতে থাকা একই পাড়ার ছেলের মা ও মেয়ের মায়ের জন্য টিসিবির লাইনে দেখা হয়ে যাওয়াটা কতবড় দুঃসহ! বিয়েটা হয়ে যাওয়ার আগে অন্তত কোনো পক্ষই নিজেকে অন্যপক্ষের সামনে ছোট দেখতে চায় না। নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্তের কাছে এই ঘটনা খুব স্বাভাবিক লাগতে পারে। কিন্তু মধ্যবিত্তই কেবল জানে, এই কৃষ্ণপক্ষের আঁধারের কী রূপ! কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন-'মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।' অবস্থা এমন, 'মানুষ'-এর স্থলে 'মধ্যবিত্ত' শব্দটি চয়ন করলাম। মধ্যবিত্ত বড় কাঁদছে!
দুই.
বিশ-বাইশ বছর আগের কথা। সেই কালচে রঙের চকলেট কেকটির দাম ছিল ছয় টাকা। ফেরিওলা এনেছিল বাড়ির উঠানে। সেই মুহূর্তে ঘরের ভেতর জ্বরাক্রান্ত ছেলের মাথায় পানি ঢালছিলেন এক মা। ফেরিওলার ডাক শুনে কেক খেতে চাইল ছেলেটি। তিন দিন ধরে মুখে রুচি না থাকায় কিছুই খাচ্ছিল না সে। কিছু বলতে ভাত, সাথে এটা-ওটা! ছেলের কেক খাওয়ার আবদারে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন মা। হাতে পয়সা নেই! বাবাও বাড়ি নেই। উপায়? মায়ের মন কি আর মানে! যেখানে উপায় চলে না, সেখানে সন্তানের জন্য উপায় খুঁজে বের করাই তো মায়ের কাজ। কার কাছ থেকে যেন ধার করলেন দশ টাকা। কেক কিনে তুলে দিতে লাগলেন ছেলের মুখে। তিন আঙ্গুলের ডগায় যতটুকু একবারে আঁটে সেই পরিমাণ খাওয়ার পর ছেলেটি জানাল, আর খাবে না। মায়ের খুব রাগ হলো। এত কষ্ট করে ধার করে এনে কেক কিনলেন, এখন ছেলে বলে, খাবে না। এইটুকু খাওয়ার জন্য কেনই বা আবদার করল তবে! রাগ করে কেক ছুঁড়ে ফেললেন মাটিতে। তারপর অপলক তাকিয়ে রইলেন কেকটির দিকে। যেন তার ছয়টি টাকা মাটিতে গেল! সেই ছেলেটি আমি। আমার আম্মার সেই অপলক দৃষ্টি আজও আমি ভুলতে পারিনি। মধ্যবিত্ত পরিবারে এমন চালচিত্রের মধ্যে বেড়ে ওঠা সন্তানরা এইসব স্মৃতি কখনো ভুলতে পারে না। এই স্মৃতিগুলোই তাদের বড় করে তোলে। বড় হওয়ার পর জ্বরের মধ্যে তাদের আর কখনো কেক খেতে ইচ্ছে করে না। তাদের মায়েরা বেঁচে থাকলে অভিমান করার আরো কারণ বের হয়, কিন্তু কেকের কারণে রাগ হয়তো ওই একবারই।
মধ্যবিত্ত মায়ের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত বাবার রূপটিও আমি জানি। সেবার লাকসাম রেল জংশনে আমরা নামলাম উপকূল ট্রেন থেকে, নোয়াখালী থেকে চাঁদপুর ফেরার পথে। প্ল্যাটফর্মে চায়ের দোকানে আমার মা পাউরুটি খেলেন। দাম দেবার সময় অন্যায্যভাবে পাউরুটির দাম কয়েক টাকা বেশি চাইল দোকানি। প্রতিবাদে আব্বা রেগে গেলেন। প্ল্যাটফর্মে ভিড় জমে গেল। আম্মা বার বার বলছিলেন, দুই-এক টাকার জন্য এত রাগারাগির কী দরকার! কিন্তু আব্বা শুনছিলেন না তার কথা। তখন পাশে থেকে আমারও মনে হয়েছিল, যা চায় দিলেই তো হয়ে যায়। কিন্তু এখন বুঝি, একটা রুটির খরচায় কয়েক টাকা বেশি চলে গেলে অন্য হিসাবে হয়তো টান পড়বে, এই উৎকণ্ঠা থেকেই আব্বা সেদিন রেগে গেছিলেন। মধ্যবিত্ত বাবারা এমনই হয়। তাদের মাথায় হিসাব করা থাকে সব। সেই হিসাব করতে খাতা-কলম লাগে না। বাড়ি ভাড়ায় কত টাকা, সন্তানের লেখাপড়ায় কত আর অন্নসংস্থানে কত-এই প্রধান তিন খাতের টাকার খুব একটা এদিক-সেদিক করার সুযোগ থাকে না। ফলে অন্য খাতে বেশি চলে গেলে তাদের দুশ্চিন্তা হয়ই। তাদের ধার করারও জো নেই। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে ধারটা তাদেরই শোধ দিতে হবে। বছরের পর বছর সংসার বড় হয়, আয় বাড়ে না। বেতন তোলার আগেই বিভিন্ন খাতে ভাগ হয়ে যায়। ব্যাংক আর পাওনাদারের মাঝে বাবা নামক মানুষটির উপস্থিতি পৃথিবী রাখে মূলত তার সঞ্চিত দীর্ঘশ্বাসের কোষাগার সমৃদ্ধ করতে।
তিন.
করোনাকালে নিম্নবিত্তের জন্য খাদ্য ও অর্থ সহায়তা ছিল। উচ্চবিত্তের জন্য ছিল শিল্পের প্রণোদনা। কিন্তু মধ্যবিত্তের জন্য? না চাইলে কীভাবে পাবে? সেজন্যই এই শ্রেণিটি মধ্যবিত্ত। হাত পাততে অভ্যস্ত নয়। ফলে অফিস থেকে ছাঁটাই হয়ে শহর থেকে ছিটকে বহু মধ্যবিত্ত পরিবার গ্রামে ফিরে গেছে। তাদের ছাড়াই শহর চলছে। চেনা শহর হয়ে গেছে অচেনা। মধ্যবিত্ত বাবাকে শহর মনে রাখে না। প্রয়োজনে ব্যবহার করে কেবল। মধ্যবিত্ত বাবার সঙ্গে নিম্নবিত্ত বাবার সীমানা ক্রমাগত কমে আসছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। বাংলাদেশেও পড়েছে প্রভাব। কোভিডের পর ইউক্রেন যুদ্ধ। ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে মধ্যবিত্তের জীবন। এইসব সংকটে মধ্যবিত্তের পাশে তার পূর্বের সঞ্চয় ছাড়া কেউ থাকে না। ফলে সেই তহবিলই সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে। সারাজীবন রয়ে-সয়ে খরচ করে শেষ বয়সে দুই-একটি শখ মেটাবার জন্য। হয়তো ভাবে নিজের একটা ফ্ল্যাট থাকবে, গাড়ি থাকবে, সন্তানরা সুখে থাকবে। কিন্তু হঠাৎ রোগ-শোকও এসে যে তাদের সাথে থাকবে, তা কে জানত? ক্যান্সার, কিডনি, লিভার, স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এসব দুরারোগ্য ব্যাধির খরচ বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্ত। আপনজনকে বাঁচাতে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিচ্ছে। ভিটেমাটি বিক্রি করেও বাঁচাতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রিয়জনকে। কজনার সামর্থ্য আছে ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্যে চিকিৎসা নেওয়ার।
চার.
আমার 'রাষ্ট্রপতির অগোচরে' গল্পের বিলকিসের বাবার কথা মনে পড়ে। চরিত্রটি নির্মাণ করেছিলাম, যার একটা হাত নেই। কোল্ডস্টোরে আলু টানার কাজ করত ট্রাকের শ্রমিক হিসেবে। সরু রাস্তায় একবার দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে তার একটা হাত বাদ পড়ে। হঠাৎ হাত চলে যাওয়ায় কী করে খাবে বুঝে উঠতে পারছিল না বিলকিসের বাবা। তারপর এক হাতে যা যা করা যায়, বাম হাতে যা যা করা যায় তা করা শুরু করল। পেট চুক্তি আর সামান্য কিছু টাকায় মরিচের চারা রোপণ করত, ধানের চারা রোপণ করত, এক হাতে যা যা করা যায় সবই করত সে। বাধ্য হয়েই ক্ষেতের নিরানি, আরও যা যা এক হাতের, বলতে গেলে বাম হাতের কাজ পাওয়া যায় তাই জুটিয়ে নিতে থাকল। তবুও বিলকিসের বাবা একহাতে সংসার টানতে গিয়ে কুলাত না। যেখানে যা বদলা দিত, হাটবারে কিছু টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও পেতো না। তাকে সবাই ইচ্ছাকৃত ঘোরাত। ফলে সওদা না নিয়েই ফিরতে হতো। বিশ-বাইশ বছর আগে আটানব্বইয়ের বন্যার পটভূমিতে রচিত গ্রামের গল্পে মধ্যবিত্ত ইচ্ছাকৃতভাবে বঞ্চিত করেছে নিম্নবিত্ত মজুর বিলকিসের বাবাকে। কিন্তু আজ বাস্তবের পরিস্থিতি এমন সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেই আলু, পেঁয়াজ, তেল, আটা, ময়দা, চিনি, মসুর ডাল, লবণ, চালসহ নিত্যপণ্যের দামের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবস্থানের পরিবর্তন ঘটছে। সেই তাদেরই আজ দোকানির কাছে বাকির খাতা খুলতে অনুনয় করতে হচ্ছে। যে হারে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, আয় বাড়ছে না মধ্যবিত্তের। একই হাট-বাজার! চেনা সওদা! তবুও কত অচেনা হয়ে ওঠে মধ্যবিত্তের কাছে। অস্ম্ফুটে বলে ওঠে কেউ কেউ, 'জিনিসপত্রের যা দাম!' তারপর মুখ থেকে আওয়াজ আর বের হয় না। বিড়বিড় করতে থাকে। নিজেই খাবি খায় নিজের অসামর্থ্যের জলে। এই মধ্যবিত্তকে তার দেশ চেনে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চেনে। রাষ্ট্রের চোখে তার মধ্যবিত্ত কখনো অচেনা হয়ে ওঠে না, কিন্তু মধ্যবিত্তের চোখে তার রাষ্ট্র কখনো চেনা, কখনো অচেনা! এমনকি মধ্যবিত্ত নিজেও নিজেকে এই চেনে না, এই আবার চেনে!