ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ উপমহাদেশের রাজনৈতিক ভূগোল ও সমীকরণের এক অনিবার্য বাস্তবতা। আদতে কেউই তার চরম পরিনতি থেকে শিক্ষা নেয় না। একটু সুবিধাবোধ করলেই প্রতিপক্ষের উপর ঝাপিয়ে পড়া বা নানা কূটকৌশলে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার অপতৎরতা রাষ্ট্রের আভ্যন্তর থেকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে বিষবাষ্পের উত্তাপ ছড়িয়ে সবকিছু গ্রাস করে দিতে চাইছে। অথচ এ উপমহাদেশে মুসলমান সুলতান ও মোঘলরা ৮০০ বছর ধরে শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধিসহ নিরবচ্ছিন্নভাবে দেশ শাসন করেছে। একের পর এক রাজ্য জয় করে ভারত সা¤্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধির সাথে সাথে মুঘল-সুলতানরা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের উপর ধর্ম চাপিয়ে দেয়ার কোনো চেষ্টা করেননি। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, মুসলমান সুলতান-মোঘলরা যদি জবরদস্তি ধর্ম চাপিয়ে দিতে চাইতেন, ৮০০ বছরে ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্মের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যেত না। হিন্দুরদের মধ্যেই তার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত রয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে মৌর্য্য ও গুপ্ত রাজবংশের পতন এবং পরিকল্পিত নিপীড়নের মাধ্যমে বৌদ্ধদের ভারত থেকে বিতাড়িত করে এখানে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য কায়েম করা হয়েছিল। বর্ণবাদী সমাজে সংখ্যালঘু ব্রাহ্মণদের দ্বারা নি¤œবর্গের হিন্দুদের নিপীড়ন ও দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখার অমানবিক লোকাচার, মাৎস্যন্যায় ও বিশৃঙ্খল সময়ে দিগি¦জয়ী মুসলমানদের সাম্যের বাণী ভারতের সমাজে মুক্তির এক নতুন বার্তা ও সামাজিক-রাজনৈতিক সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল। নবম শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আটশ’ বছরের সময়কাল ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের দীর্ঘতম স্বর্ণযুগ বলে গণ্য হতে পারে। ইউরোপীয় বেনিয়াদের বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় ভারতের নব্য ধনিক শ্রেণীর যোগসাজশ এবং মুসলমান শাসক বর্গের ক্ষমতাকেন্দ্রিক আভ্যন্তরীণ ও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, রেষাঁরেষি ও ষড়যন্ত্রের কারণে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাবের বিশাল বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানী শাসনের ভিত্তি গড়ে ওঠেছিল মুসলমান বিদ্বেষ এবং হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভাজন-বৈরীতার উপলক্ষ্যকে উপজীব্য করে। রোমান, ওলন্দাজ, পুর্তগিজ বা ইংরেজের বেনিয়া মনোবৃত্তি ও রাজ্য শাসনের সাথে মুসলমান সুলতান ও মোঘলদের শাসনের কোনো তুলনা চলে না। সুলতান-মোঘলরা প্রতিবেশী সভ্যতার উন্নততর সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে সকল সম্প্রদায়ের জন্য সাম্য, শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে জনগণের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিল বলেই হাজার বছর ধরে তারা ভারত শাসন করতে সক্ষম হয়েছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু থেকে দুইশ’ বছরের ধারাবাহিক বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল ভারতের মুসলমানরা। ফকির-সন্যাসীদের বিদ্রোহ, তিতুমীর-মজনু শাহ্দের অস্ত্র ধারন থেকে শুরু করে গান্ধী-জিন্নাহদের স্বদেশী আন্দোলনের রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামে মুসলমানদের আত্মদানের ইতিহাস হিন্দুদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সাতচল্লিশের দেশভাগের চারদশক আগে ১৯০৫ সালে পশ্চাদপদ-অবহেলিত পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের জীবনমানের উন্নয়ন, বিচার ও প্রশাসনিক সুবিধাদি নিশ্চিত করতে ঢাকা কেন্দ্রিক নতুন প্রদেশ গঠণের বিরোধিতায় কলকাতার ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ধণুর্ভঙ্গ লড়াইয়ের মাধ্যমে ৫ বছরের মধ্যে বঙ্গভঙ্গ রদ করিয়ে বাঙ্গালী মুসলমানদের অগ্রগতি ঠেকিয়ে দেয়ার বাস্তবতা এ দেশের মুসলমানদের মানসপটে হিন্দুদের কায়েমী স্বার্থবাদিতার দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। যে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের বেদনা-মায়াকান্নায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল, তারাই ১৯৪৬-৪৭ সালে এসে বাংলা ভাগকে অনিবার্য করে তুলেছিলেন। তাদের দ্বিচারিতা এখনো পুরো উপমহাদেশকে হুমকির মুখে রেখেছে।
যেখানে মুসলমান শাসকরা আটশ’ বছর ধরে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য ও সম্প্রীতি অক্ষুণœ রেখে সমৃদ্ধ সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিলেন, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের পরও ভারতের সেক্যুলার সংবিধানের প্রতি আস্থাশীল সংখ্যালঘু মুসলমানদের সাথে সহবস্থান ও নিরাপত্তার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেনি হিন্দুত্ববাদীরা। দেশভাগোত্তর বেশিরভাগ সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের শাসন মন্দের ভালো হিসেবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটা ন্যূনতম ঐক্য ও সমঝোতার কারণে ভারত একটি আঞ্চলিক সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের পরমাণু কার্যক্রম শুরু করে সামরিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গঠনের সব ক্ষেত্রেই মুসলমানদের অবদান কোনো অংশে কম নয়। সবর্শেষ হিন্দুত্ববাদী বিজেপির পাকিস্তান বধের ব্যর্থ যুদ্ধেও ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এক মুসলিম নারী সেনা অফিসার, কর্ণেল সোফিয়া কোরেশি। কোনো রকম তদন্ত বা তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই পেহেলগাঁওয়ে বন্দুক হামলায় ২৬ জন ভারতীয় পর্যটক হত্যার দায় পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে আজাদ কাশ্মিরকে গাজায় পরিনত করা, পাকিস্তান দখল করা ইত্যাদি নানা রকম হাইপ শুনিয়েছেন ভারতের প্রপাগান্ডা মিডিয়াগুলো। যুদ্ধের প্রস্তুতি থেকে শুরু এবং শেষ পর্যন্ত ভারতীয় গণমাধ্যম যেন বাংলাদেশ বিদ্বেষী গলাবাজ ময়ুখরঞ্জন ঘোষের রিপাবলিক বাংলা টিভিতে পরিনত হয়েছিল। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের হিন্দুত্ববাদী অ্যাক্টিভিস্টদের কন্টেন্ট এবং আচরণ বরাবরই অন্ধ উন্মাদনায় ভরপুর। এসব হিংসাত্মক উন্মাদনার মুখে ঝামা ঘঁষে দিয়ে আগ বাড়িয়ে যুদ্ধে নেমে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা চরম পরাজয়ের গ্লানি মেখে ভারতের পরাশক্তি হয়ে ওঠার স্বপ্ন এখন আষাঢ়ে গল্পে পরিনত হয়েছে। ভারতীয় সামরিক হাইপে থাকা প্রতিটি স্তম্ভ পাকিস্তানের সীমিত পরিসরের প্রত্যাঘাতে ধসে গেছে। হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করে কেনা গর্বের ফরাসি রাফালে যুদ্ধ বিমান, ইসরাইলের কামিকাজি ড্রোন, রাশিয়ার এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে চীনা সমরাস্ত্রের চাঁদমারিতে পরিনত করে এসব প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ইজ্জত ও আর্ন্তজাতিক বাজারকে চরম হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে ভারত। ভারতীয় বৈমানিকরা আদৌ সঠিকভাবে রাফালে চালাতে সক্ষম কিনা, তা নিয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন উঠতে দেখা গেছে। যুদ্ধজয়ের জন্য শক্তিশালী সমরাস্ত্রই যথেষ্ট নয়, সেই সাথে প্রয়োজন যুদ্ধের নেপথ্যের কুশীলবদের স্বপক্ষে উপযুক্ত ন্যারেটিভ। যে সৈনিক যুদ্ধের ময়দানে নিজের জীবন দিতে যাবে, তার কাছে একটি নৈতিক ও বৃহত্তর স্বার্থের যৌক্তিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মানদ- থাকতে হয়। যে প্রেক্ষাপটে বিশ্বের সর্বাধুনিক ও শক্তিশালী সামরিক নিরাপত্তা অবকাঠামো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো এক নম্বর পরাশক্তির সর্বাত্মক সহযোগিতা, পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও ইসরাইলের সৈনিকরা যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে অনীহা প্রকাশ করছে, সে দেশের নাগরিকরা লাখে লাখে দেশ ত্যাগ করছে। পক্ষান্তরে দেড় দশক ধরে অবরুদ্ধ এবং পৌনে ২ বছরে হাজার হাজার বোমা বর্ষণে ধ্বংসস্তুপে পরিনত হওয়া গাজার মাটি থেকে হামাস কিংবা ফিলিস্তিনি নাগরিকদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করা যায়নি। উচ্চ মার্গের পরমার্থিক বিশ্বাস ও নৈতিক ভিত্তি ছাড়া এটি সম্ভব নয়। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও একই মানদ- যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছে।
বর্ণবাদ ও আধিপত্যবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। একটি অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত বড় দেশের আধিপত্যবাদী ও আগ্রাসী নীতির কারণে প্রতিবেশি দেশগুলোও অনুরূপ রাজনৈতিক-সামরিক প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক অবস্থানের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতো দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ব্যহত হচ্ছে এবং সামরিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। ভারতীয় বৈমানিক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন রাফায়েল ও এস-৪০০ এর মত বিশ্বের সর্বাধুনিক শক্তিশালী নিরাপত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারছে না, একইভাবে ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকদলের নেতারাও ভারতের বহুত্ববাদী সেক্যুলারিজম ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা থেকে ঐক্যের শক্তি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। শত শত বছর ধরে ঐক্যবদ্ধ ভারত মাত্র দুই দশকের মধ্যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থানের মধ্য দিয়ে চরম পরাজয় ও পরিনতির মুখোমুখী দাঁড়িয়েছে। লাখ লাখ কোটি রুপির সমরাস্ত্র, পারমানবিক যুদ্ধের সক্ষমতা সত্ত্বেও ওরা কোনো প্রতিবেশী দেশের আস্থা ও নিরাপত্তাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারছে না। স্বাধীনতাত্তোর সময় থেকে একমাত্র একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছাড়া প্রতিবেশী চীন-পাকিস্তানের সাথে ভারত আর কোনো যুদ্ধে সাফল্য লাভ করতে পারেনি। একাত্তরের যুদ্ধে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের মাত্র দুই সপ্তাহের অংশগ্রহণ শেষে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমান লুটপাট চালিয়ে ভারতে নিয়ে গেছে, তা কথিত বৈষম্যের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের ২৩ বছরের লুটপাটের চেয়ে বেশি ও ধ্বংসাত্মক ছিল। সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল ভারতীয় লুটপাটের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেফতার ও হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন। ভারতীয় বাহিনীর লুটপাট এবং ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি লিখেছিলেন, ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’ যা পুস্তকাকারেও প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সহাবস্থান, অখ-তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নেপথ্যে কাজ করছে ভারতের হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানসচেতনায় বদ্ধমূল অজ্ঞতা, ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্নতা। এসব কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার মসনদকে একটি ফ্যাসিবাদী আদলে রূপ দিচ্ছে। হাজার বছর আগে ঐতিহাসিক আল বেরুনি ভারত সম্পর্কে বিশ্ববাসীর সামনে যে ধারণা ও বিচার-বিশ্লেষণ তুলে ধরেছিলেন, একবিংশ শতকে এসেও তারা সেসব অদ্ভুত গোঁড়ামি থেকে বের হতে পারেনি। ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসির আওতায় ইংরেজরা তাদের মধ্যে যে মুসলিম বিদ্বেষের বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছিল, তা এখন মহীরূহে পরিনত হয়েছে। বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দিরের গালগল্প ছিল ইংরেজের সৃষ্টি। বাবরি মসজিদ প্রতিষ্ঠার কয়েক দশক পরে তুলসি দাসের শ্রীরামচরিত মানস লেখা হলেও সেখানে রামমন্দিরের স্থলে বাবরি মসজিদ নির্মাণের পক্ষে সরাসরি কিংবা ইঙ্গিতপূর্ণ একটি শব্দও লেখা হয়নি। এর পুরোটাই ইংরেজের আবিষ্কার এবং বৃটিশদের সৃষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা। এখন মুঘল শাসনামলের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপনার নিচে বিজেপি, আরএসএস, বজরংদলের পান্ডারা মন্দির আবিষ্কারের নামে মুসলমান শাসনের স্মৃতি বিজড়িত সবকিছু ধ্বংস করে দেয়ার চক্রান্তে মেতে উঠেছে। ভারতের অন্যতম বিশ্ব ঐতিহ্য ও পর্যটন আকর্ষণ তাজমহলও এমন দাবি থেকে বাদ পড়েনি।
সনাতন ধর্ম একটি বহুত্ববাদী ধর্ম। ‘যত মত, তত পথ’ এই ধর্মের অন্যতম নীতিগত বৈশিষ্ট্য। ধর্মের মৌলিক অনুজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চাপিয়ে দেয়া কায়েমি স্বার্থবাদী অনুশাসন হিন্দুদের বিশ্বের কাছে এক বিচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক সত্ত্বায় পরিনত করেছে। এখন অনেক হিন্দু ধর্মবেত্তাও স্বীকার করছেন, বৈদিক হিন্দু ধর্মের কোনো গ্রন্থেই গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়নি। বরং প্রাচীন ধর্মগুরুরা যাগ-যজ্ঞের মাধ্যমে গরু বলি দিয়ে তার মাংস ভক্ষণের রীতির প্রচল ছিল বলে জানা যায়। সম্প্রতি এ সম্পর্কিত একটি টেলি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক ভিডিওতে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু পুরাণ বিশেষজ্ঞ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ি শ্রীরামচন্দ্রসহ প্রাচীন ব্রাহ্মণদের গোমাংস খাওয়ার তথ্য তুলে ধরেছেন। এর অনেক আগে ইসলামিক বক্তা জাকির নায়েক বেদ-সংহিতাসহ হিন্দু পুরাণের অনেক উদ্ধৃতি তুলে ধরে সনাতন ধর্মে গোমাংস ভক্ষণের সপক্ষে যুক্তি ও উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন। ধর্মের দোহাই দিয়ে গোরক্ষার নামে, গোমাংস খাওয়ার অভিযোগে কিংবা বাড়ির ফ্রিজে গরুর গোশত রাখার অভিযোগ তুলে মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা করে ওরা ধর্ম রক্ষা করছে! অথচ ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় বিফ রফতানিকারক দেশ। ওরা গোমাতার মাংস খায় না, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা দেশগুলোতে গোমাতার মাংস রফতানি করে শত শত কোটি ডলার আয় করে। সে অর্থ দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে অস্ত্র কিনে তারা প্রতিবেশী দেশগুলোতে আগ্রাসন চালিয়ে অখ- ভারত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কী অদ্ভুত, খেলো তাদের নীতি-নৈতিকতা, সভ্যতা ও জাতীয় সংস্কৃতির ভিত্তি! বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠির (প্রায় ২৫ কোটি) ্আবাসভূমি ভারত। জ্বালানি নিরাপত্তা, বৈদেশিক কর্মসংস্থানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে ভারতের বিশাল বাণিজ্যিক অংশীদারিত্বের উপর ভারতের অর্থনীতি বেড়ে উঠলেও হিন্দুত্ববাদীরা এখন জায়নবাদী ইসরাইলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মুসলিম জেনোসাইডের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে লিপ্ত রয়েছে। ওরা উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে গাজার মত ধ্বংসস্তুপে পরিনত করার রণহুঙ্কার দিচ্ছে। মাত্র তিনদিনের যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানের হাতে চরম মার খেয়ে তার কৌশলগত অংশীদার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধরে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করিয়েছে। সিএনএন’র এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ভারত পাকিস্তানে হামলা করার প্রথম কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বিশাল সামরিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। তিনটি রাফায়েলসহ ভারতের ৬টি যুদ্ধবিমান ৫৫৩টি ড্রোন, অন্তত ১১টি বিমানঘাটি ধ্বংস হয়েছে। সেনা হতাহতের সংখ্যাও ভারতের অনেক বেশি। অপারেশন সিঁদুরের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রথম কয়েক ঘন্টার মধ্যে পাকিস্তানের সোহাগ রাত অত:পর শুক্রবার ‘অপারেশন বুনওয়ামিন মারসুস বা সিসাঢালা প্রাচীর’ শুরু হলে ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রায় অচল-অসহায় হয়ে মোদি-জয়শঙ্কররা পাকিস্তানকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দ্বারস্থ হন। ট্রাম্প এ খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ করায় ভারতের মিথ্যা সংবাদের প্রপাগান্ডার ভিত্তি অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। তবে ভারতীয় সেক্যুলার ও মধ্যপন্থী রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, এরপরও আগামী নির্বাচনের আগে বিজেপির অনুগত গোদি মিডিয়াগুলো অসত্য, বানোয়াট তথ্য ও ভিডিও প্রচার করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের গল্প হাজির করবে। পেহেলগাঁও বাইসারণ উপত্যকায় বন্দুকযুদ্ধের পেছনে মূলত কারা জড়িত, তার কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও এ ঘটনায় সাম্প্রদায়িক রং লাগিয়ে মুসলিম বিদ্বেষী ভোটযুদ্ধে বিজেপির ক্ষমতা ধরে রাখতে সম্ভাব্য সবকিছুই করবে মোদি সরকারের ডিপস্টেট। আজাদ কাশ্মিরে মার খেয়ে সে ঝাল স্বাধীন বাংলাদেশে মেটাতে চাওয়ার খায়েশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে বিস্ময়ের কিছু নেই। আড়াই হাজার বছর আগে চৈনিক সমরবিদ সান জ্যু শান্তির সময়ে যুদ্ধ এবং যুদ্ধের সময়ে শান্তির প্রস্তুতি ও প্রস্তাবনার কথা বলেছিলেন। অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মহাম্মদ ইউনূসও বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে অনুরূপ বার্তা দিয়েছেন। উপমহাদেশে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। ভারতের হিন্দুত্ববাদী উস্কানি বাংলাদেশকে সাম্য, মৈত্রী, মানবিক মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক অভিষ্ঠ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।এ ক্ষেত্রে পঞ্চম বাহিনীর ষড়যন্ত্র ও নাশকতার বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই।