১৮০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বইপত্র থেকে প্রকৃতিসংক্রান্ত শব্দগুলোও ধীরে ধীরে হারিয়েছে। ছবি: ফ্রিপিক

১৮০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বইপত্র থেকে প্রকৃতিসংক্রান্ত শব্দগুলোও ধীরে ধীরে হারিয়েছে। ছবি: ফ্রিপিক

১৮০০ সাল থেকে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ৬০ শতাংশেরও বেশি কমেছে এবং বইগুলো থেকেও নদী ও ফুল ফোটার মতো প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদানের শব্দ প্রায় একই অনুপাতে কম লেখা হচ্ছে বলে উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।

কম্পিউটার মডেলিংয়ের মাধ্যমে উঠে এসেছে, নীতিগত ও সামাজিকভাবে যদি বড় ধরনের পরিবর্তন আনা না যায় তবে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আরও কমে যাবে।

এ প্রবণতা থামাতে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হচ্ছে শিশুদের ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত করা ও বিভিন্ন শহরকে আরও বেশি সবুজ ও প্রকৃতিবান্ধব করে তোলা বলে প্রতিবেদনে লিখেছে ব্রিটিশ দৈনিক পত্রিকা গার্ডিয়ান।

গত ২২০ বছরে মানুষের জীবনে প্রকৃতির উপস্থিতি কীভাবে কমেছে তা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে ‘ইউনিভার্সিটি অফ ডার্বি’র প্রকৃতি সংযোগ বিভাগের অধ্যাপক মাইলস রিচার্ডসনের এক গবেষণায়।

এ বিশ্লেষণে শহরায়ণ, আশপাশের এলাকায় বন্যপ্রাণীর কমে যাওয়া ও মা-বাবারা এখন তাদের সন্তানদের প্রকৃতির সান্নিধ্যে আনার চেষ্টা করছেন কি না– এসব তথ্য ব্যবহার করে গবেষণাটি করেছেন রিচার্ডসন।

গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘আর্থ’-এ।

এ গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ১৮০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বইপত্র থেকে প্রকৃতিসংক্রান্ত শব্দগুলোও ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি কমেছে ১৯৯০ সালের দিকে, প্রায় ৬০.৬ শতাংশে নেমে গিয়েছিল।

কম্পিউটার মডেলিং অনুসারে, ভবিষ্যতেও এই ‘অভিজ্ঞতার বিলুপ্তি’ চলতেই থাকবে, যেখানে নতুন প্রজন্ম ধীরে ধীরে প্রকৃতি সম্পর্কে আগ্রহ হারাবে। কারণ তারা এমন জায়গায় বড় হচ্ছে, যেখানে আশপাশে প্রায় কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশ নেই। একইসঙ্গে মা-বাবারাও এখন আর সন্তানদের মধ্যে প্রকৃতির প্রতি আগ্রহ তৈরি করছেন না।

আগের অন্যান্য গবেষণায় দেখা মিলেছে, একজন শিশুর প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে তার মা-বাবাদের প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগের ওপর। শিশুদের প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা শেখানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যম মা-বাবারাই।

গবেষক রিচার্ডসন বলেছেন, “প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হারিয়ে যাওয়াই আজকের পরিবেশ সংকটের মূল কারণ। প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ কেবল পরিবেশের জন্যই নয়, বরং আমাদের মন ও মানসিক শান্তির জন্যও জরুরি। প্রকৃতি ও মানুষের মঙ্গল একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। সমাজের প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হলে আমাদের বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে।”

বিভিন্ন নীতি ও শহরের পরিবেশগত পরিবর্তন মডেলে পরীক্ষা করে রিচার্ডসন দেখেছেন, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের হারানো সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে যতটা বড় মাত্রার পরিবর্তন প্রয়োজন, যা তার ধারণার চেয়েও অনেক বেশি।

কোনো শহরে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সবুজ জায়গা বাড়ানো হয়ত অনেকের চোখে বন্যপ্রাণী ও মানুষের জন্য বড় ইতিবাচক অগ্রগতি বলে মনে হতে পারে। তবে রিচার্ডসনের গবেষণা বলছে, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগ ফিরিয়ে আনতে শহরটিকে ১০ গুণ বেশি সবুজ ও প্রকৃতিবান্ধব করতে হতে পারে।

গবেষণায় উঠে এসেছে, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগ ঘটাতে যেসব উদ্যোগ সচরাচর নেওয়া হয় সেগুলো দীর্ঘমেয়াদে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগ হারানো রোধ করতে খুব বেশি কার্যকর নয়।

রিচার্ডসন বলছেন, বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার প্রকৃতিনির্ভর কর্মসূচি, যেমন ‘ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট’-এর #30DaysWild কর্মসূচি মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ হলেও কম্পিউটার মডেল বলছে, এগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ হারানোর প্রবণতা থামাতে পারবে না।

গবেষণা অনুসারে, আরও কার্যকর উপায় হচ্ছে শিশু ও তাদের পরিবারদের মধ্যে প্রকৃতির প্রতি সচেতনতা ও সম্পর্ক গড়ে তোলা। যেমন গাছপালার মধ্যে খেলা, শেখা বা সময় কাটানো। এতে শিশুরা প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শেখে, যা ভবিষ্যতেও টিকে থাকে।

কম্পিউউটার মডেলিংয়ে ইঙ্গিত মিলেছে, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা ও শহরের পরিবেশ পরিবর্তনের নীতি আগামী ২৫ বছরের মধ্যে কার্যকর করতে হবে। এসব পদক্ষেপ নেওয়া হলে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগ বাড়বে ও তা নিজে থেকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে।

রিচার্ডসন বলেছেন, মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক এখন অনেক কমে গিয়েছে। আবার তা ফিরিয়ে আনার জন্য বড় পরিবর্তন প্রয়োজন হলেও তা বেশি কঠিন নয়। খুবই খারাপ অবস্থান থেকে শুরু করলেও পরিবর্তন আনা সহজ হতে পারে।

আগের এক গবেষণায় উঠে এসেছিল, শেফিল্ড শহরের মানুষ গড়ে প্রতিদিন কেবল চার মিনিট ৩৬ সেকেন্ড প্রকৃতির মধ্যে সময় কাটায়।

রিচার্ডসন বলেছেন, “এ সময়টা যদি দৈনিক ১০ গুণ বাড়িয়ে ৪০ মিনিট করা যায় তবে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে যথেষ্ট সময় কাটাতে পারবে। পরিবার ও মা-বাবার শিশুদের প্রকৃতির সঙ্গে যোগের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। যাতে এই সম্পর্ক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঠিকভাবে পৌঁছায়। এখনও অনেক মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে শিশুদের প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য। তবে আমি বলব, তাদের প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন না। জন্ম নেওয়া একটি শিশুর স্বভাব ১৮০০ সালের শিশুর মতোই। শিশুরা প্রকৃতির প্রতি আগ্রহী। তাই তাদের শৈশব ও শিক্ষাজীবনের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে আমাদের সেই আগ্রহ বজায় রাখা জরুরি। এর সঙ্গে বিভিন্ন শহরকে সবুজ করে তোলাও প্রয়োজন। এরইমধ্যে কিছু নীতি কাজ শুরু করেছে। তবে আমাদের চিন্তা করতে হবে ৩০ শতাংশ নয়, বরং হাজার শতাংশ পরিবর্তন দরকার।”

বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে হয়ত সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু পরিবর্তন আশা করা যেতে পারে। রিচার্ডসন বলেছেন, বইগুলোতে প্রকৃতিনির্ভর শব্দগুলো আবার বাড়ছে, যেখানে ১৮০০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে এসব শব্দের হার ৬০.৬ শতাংশ কমে গিয়েছিল তা এখন ৫২.৪ শতাংশ হয়েছে।

রিচার্ডসন বলেছেন, “তবে বিষয়টি কি সত্যিই পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা? না কি কেবলই ব্রিটিশদের প্রকৃতি সম্পর্কে লেখালেখির প্রবণতা? এ কি আদৌ ‘বাস্তব’ না কি কেবল ডেটার প্রভাব? আমি নিশ্চিত নই। তবে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে, যা হয়ত প্রকৃতির সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপনের প্রতিফলন হতে পারে।”



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews