দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে। তাই সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত, আবাসিক খাতে আর পাইপলাইনে গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়া হবে না। এক দশকের বেশি সময় ধরে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ। এ সময়ে মানুষের আয় বেড়েছে, জীবনযাত্রায়ও এসেছে পরিবর্তন। তাতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি)। জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশে এখন সম্ভাবনাময় খাত এলপি গ্যাস। গ্রামাঞ্চলেও আয় বৃদ্ধির ফলে অনেক পরিবার এখন খড়ি-লাকড়ির চুলার পরিবর্তে গ্যাসের চুলায় রান্না করছে, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে সিলিন্ডারের গ্যাস। বর্তমানে গ্রাম কিংবা শহরে পাল্লা দিয়ে রান্নার কাজে বাড়ছে এলপিজির ব্যবহার।

দেশে এলপি গ্যাসের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। প্রথম বাণিজ্যিকভাবে এলপি গ্যাস বাজারে আনে বসুন্ধরা গ্রুপ। বেক্সিমকো, ওমেরা, সেনা, যমুনা, টোটাল, ওরিয়ন, জি-গ্যাস, নাভানাসহ বিভিন্ন কম্পানি এলপি গ্যাস বাজারে এনেছে। ২৫ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে শীর্ষে বসুন্ধরা এলপি গ্যাস। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ওমেরা। বাংলাদেশে ১২ কেজি, ৩০ কেজি, ৪৫ কেজিসহ বিভিন্ন মাপের সিলিন্ডারে এলপি গ্যাস বিক্রি হয়। তবে বাসাবাড়িতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ১২ কেজি সিলিন্ডার। ৩০-৪৫ কেজির সিলিন্ডার বাসাবাড়ি, হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হয়।

বিশ্ববাজারে এলপিজির দাম বাড়তে থাকায় দেশের বাজারে এর প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়ে। গত জুন মাসে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ছিল ৮৪২ টাকা, গত মাসে (নভেম্বর) এলপিজি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম বেড়ে হয়েছিল এক হাজার ৩১৩ টাকা। চলতি মাসে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ৮৫ টাকা কমে এক হাজার ২২৮ টাকা হয়েছে।

গত সোমবার সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সিলিন্ডার বিক্রয়কারী দোকানে গিয়ে দেখা যায়, টানা পাঁচ মাস বাড়তে থাকা এলপিজির দাম চলতি মাসে কমানো হলেও খুচরা বাজারে এখনো কমেনি। ২ ডিসেম্বর বিইআরসি ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম এক হাজার ৩১৩ টাকা থেকে কমিয়ে এক হাজার ২২৮ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও খুচরা পর্যায়ে এখনো দাম কমাননি ব্যবসায়ীরা। তাঁরা আগের মূল্যেই বেশি দামে বিক্রি করছেন। এদিকে নতুন ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে বর্তমানে একটি ১২ কেজি সিলিন্ডার কিনতে হচ্ছে দুই হাজার ৪০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকায়। আর ফের গ্যাস ভরতে বা রিফিল করতে লাগে কমবেশি এক হাজার ২৫০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা।

রাজধানীর দক্ষিণ কুড়িল এলাকায় রহিম এন্টারপ্রাইজে গিয়ে দেখা যায়, ১২ কেজির যেকোনো ব্র্যান্ডের একটি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৩০০ টাকায়। এই মাসের জন্য সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে এক হাজার ২২৮ টাকা, তাহলে এত বেশি কেন? জানতে চাইলে এই দোকানের বিক্রয়কর্মী আমির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দাম তো আমরাও কমিয়েছি, গত মাসে ১২ কেজি সিলিন্ডার বিক্রি করেছি এক হাজার ৩৫০ টাকা, এখন ৫০ টাকা কমিয়ে এক হাজার ৩০০ টাকা করেছি।’

দাম বাড়ার কারণে এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবহার কমেছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দাম বাড়লেও আমাদের কাস্টমার কমেনি। যারা সিলিন্ডার ব্যবহার করছে, দাম বাড়লেও তাদের ব্যবহার করতেই হবে, কারণ আর বিকল্প ব্যবস্থা নেই। আমাদের যারা স্থায়ী কাস্টমার আছে দাম বাড়লে বা কমলে তাদের মোবাইলে জানিয়ে দিই আমরা।’

গুলশানের নদ্দা সেলিম এন্টারপ্রাইজে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ২৮০ টাকায়। এই দোকানের ব্যবসায়ী মো. জহির বলেন, ‘গত মাসে ১২ কেজি সিলিন্ডার বিক্রি করেছি এক হাজার ৩৫০ টাকা। এই মাসে সরকার কমিয়েছে তাই আমরাও কমিয়ে এক হাজার ২৮০ টাকা করেছি।’ সরকার নির্ধারিত দামে খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করলে ব্যবসা চলবে না বলেও তিনি জানান।

এলপিজি ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছোট একটি পরিবারে (তিন-চারজনের) রান্নার জন্য মাসে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার লাগে। এ জন্য তাদের বর্তমান সময়ে গুনতে হচ্ছে প্রায় এক হাজার ৩০০ টাকা। মাঝারি একটি পরিবারে (পাঁচ-ছয়জনের) ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডার প্রয়োজন হয় দুটি। তাদের গুনতে হয় প্রায় দুই হাজার ৬০০ টাকা।

রাজধানীর নদ্দা সরকারবাড়ী এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন কাপড় ব্যবসায়ী সোহেল রানা। বাসায় পাইপলাইনের গ্যাস না থাকায় এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হচ্ছে তাঁকে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার দুটি ছেলে ও স্ত্রীসহ চারজনের পরিবারে মাসে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডারে হয়ে যায়। আগে এক হাজার টাকায় ১২ কেজি সিলিন্ডার আনতে পারলেও পাঁচ-ছয় মাসে সিলিন্ডারের দাম বাড়ায় এখন লাগছে এক হাজার ৩০০ টাকা।’

বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে প্রায় এক কোটিরও বেশি পরিবার এলপিজি ব্যবহারকারী। দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রান্নার কাজের পাশাপাশি শিল্প, বাণিজ্য ও যানবাহন খাতেও এলপি গ্যাসের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে।

এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) তথ্য মতে, দেশে মোট ৫৬টি কম্পানি এলপিজি ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নিয়েছে। ২৯টি কম্পানি বর্তমানে বাজারে সক্রিয়। এর মধ্যে ২০টি কম্পানি সরাসরি আমদানি করে। এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। গত বছর ১২ লাখ টন এলপিজি সরবরাহ করা হয় বাজারে। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে বেসরকারি খাত।

বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের হেড অব সেলস প্রকৌশলী জাকারিয়া জালাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০১৩-১৭ সাল পর্যন্ত এলপিজির বাজারে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৫০-১০০ শতাংশ পর্যন্ত হয়। কিন্তু ২০১৮ সালের পর থেকে প্রতিযোগী বেড়ে যায় অনেক। সিলিন্ডারও সহজলভ্য হয়ে যায়। ফলে বর্তমানে এলপিজির বাজারে প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৫ শতাংশ। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময়, তাই বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু কম সময়ের মধ্যে বিনিয়োগ বেশি হয়েছে। দেশে এলপিজির বাজারে বর্তমানে চাহিদা আছে ১৪ লাখ মেট্রিক টন; কিন্তু বাজারে সক্ষমতা আছে প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টনের। আগামী পাঁচবছরের মধ্যে ১৪ লাখ টনের মার্কেটটি ৩০ লাখ টনে চলে যাবে।’



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews