রাজু আহমেদ, স্টাফ রিপোর্টার: জারি-সারি, পল্লীগান, কবিগান, বাউল গানের দেশ বাংলাদেশ। যে সুর মিশে আছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যে, মাটি ও মানুষের হৃদয়ে। পক্ষান্তরে চর্চা সংকটে দেশীয় নিজস্ব সংস্কৃতির বহু পুরোনো অংশ, বহুল তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী বাউলশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে।
অনাহারে অর্ধাহারে দিনঃপাত করছেন রাজধানীর মিরপুরস্থ হযরত শাহ্ আলী বাগদাদী (রঃ) এর মাজার শরীফ কেন্দ্রীক সহস্রাধিক ছিন্নমূল বাউল ও যন্ত্র সংগীত শিল্পী। ফলে ঐতিহ্য হারাচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানটি।
স্থানীয়রা জানান, মহান তাপসপ্রবর সুলতানুল আউলিয়া হযরত শাহ্ আলী বাগদাদী (রঃ) সুদূর ইরাক হতে এদেশে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে এসে একপর্যায়ে রাজধানীর মিরপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কালের বিবর্তনে তার নামেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসমৃদ্ধ আজকের বিশালাকার এই হযরত শাহ্ আলী (রঃ) মাজার শরীফ কমপ্লেক্স।
দেশ দেশান্তর থেকে নানান শ্রেনী পেশার লাখো লাখো ধর্মভীরু মানুষ প্রতিনিয়ত মাজার শরীফ জেয়ারত করতে এসে এর ভাবগাম্ভীর্যে মুগ্ধ হতেন। সপ্তাহের প্রতি বৃহঃবার বিভিন্ন পীর মাশায়েখগণ তাদের ভক্তবৃন্দ শিষ্যসামন্তসহ দলবদ্ধ হয়ে তরিকতের শিক্ষা গ্রহণ করতেই এখানে সমবেত হতেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে আসা হাজার হাজার জেয়ারতকারীগণের কাফেলায় আবাল, বৃদ্ধ,নারী-শিশুসহ সকল বয়সের বিপুল সংখ্যক মানুষ সমবেত হয়ে বাহারি রকমের আসন পেতে রংবেরঙের মোমবাতি জ্বালিয়ে জিকির-আসকার, মিলাদ মাহফিল,ভক্তিমূলক গানবাজনায় মশগুল হয়ে রাত্রিযাপন করে ভোরবেলা ফিরে যেতেন।
উচ্চ পর্যায়ের অনেক পীর-মাশায়েখ, ফকির, দরবেশ, পাগল, মাস্তান, মজ্জুম, ছালেক, সংসার ত্যাগী সাধূ সন্নাসীর অবস্থান ছিল এই মাজার শরীফে। এখানে অবস্থানকালে তারা আধ্যাত্মিক তত্ব সাধন কার্যের পাশাপাশি আল্লাহ-রাসুলের নিগূঢ় তত্বের বিষয়ে মানুষকে শিক্ষা দিতেন। মনোমুগ্ধকর আসন পেতে দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন ভক্তিমূলক গান পরিবেশনে সুরের মূর্ছনায় মাজার শরীফ প্রাঙ্গন ভারী হয়ে উঠত। বহু কাওয়াল, বাউল শিল্পীদের সমাগম থাকত প্রতিনিয়ত।
স্থানীয় এলাকাবাসী আরো বলেন, বেশ কয়েক বছর হলো সেই সুযোগ এখন আর মাজার শরীফ কমপ্লেক্সটিতে নেই। বাউলদের ঢুকতে দেওয়া হয়না মাজার শরীফ কমপ্লেক্সে। সকল রকম জনসমাগম ও গানবাজনা নিষিদ্ধ হলেও উল্টো ঐতিহ্যবাহী মাজার শরীফ কমপ্লেক্সটি এখন পরিনত হয়েছে বৃহৎ কাঁচাবাজারে। ইতিহাস ঐতিহ্য ও ভাবগাম্ভীর্যকে ভূলুন্ঠিত করে মাজার শরীফ কমপ্লেক্সজুড়ে একটি অর্থলোভী স্বার্থান্বেষী মহল বসিয়েছে বিশাল কাঁচাবাজার।
এ বিষয়ে দেশের প্রখ্যাত প্রবীণ বাউলশিল্পী আব্দুল মালেক সরকার বলেন, প্রতি বৃহস্পতিবারে অনুষ্ঠিত বাউল গানের কথা, ভাবগম্ভীর্য ও সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ হয়ে দর্শনার্থীগণের অনেকেই বাউলদেরকে অর্থ, টাকা-পয়সা উপহার দিতেন। সেই অর্থেই পুরো সপ্তাহ দুমুঠো ডালভাত খেয়ে তাদের সংসার চলতো। যেকারণে আমি নিজেও বাংলাদেশে মালেক সরকার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। এরই ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে মাজার শরীফ কমপ্লেক্সটি বাউল গান চর্চার এক আদর্শ কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করায় দেশের জাতীয় বাউল শিল্পী সমিতির প্রধান কার্যালটিও মাজার শরীফ কেন্দ্রীক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত ও বিখ্যাত বাউল শিল্পীগণ নিয়মিত এই কার্যালয়ে অবস্থান করেন। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত বাউলগানের শিক্ষার্থীগণ বিখ্যাত বাউল শিল্পীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করায় সিংহভাগ বাউল শিল্পী-শিক্ষার্থীগণ মিরপুর ভিত্তিক বসবাস শুরু করেন। দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত বাউল শিল্পীদের যে সকল শিষ্যরা ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠা লাভের আশায় বাউল গান শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে বাউলগান চর্চা করে, তারাই আজ ছিন্নমূল বাউল শিল্পী হিসেবে পরিচিত। বাউল গানের সকল বাদ্যযন্ত্র শিল্পীরাও রয়েছে ছিন্নমূল বাউল শিল্পীদের দলেই।
জাতীয় যন্ত্রসংগীত শিল্পী সমিতির সভাপতি মনির হোসেন বলেন, একই কারনে বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য সমৃদ্ধ সংস্কৃতি সম্ভারের বিরাট এক অংশ দেশের বাউল শিল্পের অস্তিত্ব আজ চরম সংকটাপন্ন। শহরে–শহরতলীতে, গ্রামে-গ্রামান্তরে বসবাসরত দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ ভাগ মানুষই প্রকৃতির অপরূপ রূপবৈচিত্রের সংগে সংগে গুরুভাব-গাম্ভীর্য সম্পন্ন এই শিল্প ও সংস্কৃতিকে হৃদয়ে লালন করে আসছে বহুকাল। এদেশের মাটিতেই মনমোহন দত্ত, হাছন রাজা, জালাল উদ্দীন খাঁ, শাহ্ আবদুল করিম, লালন ফকির, আব্বাস উদ্দীন, আব্দুল আলীম, আব্দুল হালিম বয়াতি, কানাই লাল শীল, বিজয় সরকারের মত বহু জগৎ বিখ্যাত মহৎ ব্যক্তি জন্মগ্রহন ও রচনা করেছেন হাজার হাজার বাউল গান। যা দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় অকৃত্রিম সুরে আজও চর্চা হওয়ায় পৃথিবীর বুকে বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি ও সম্মানকে পৌছে দিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়।
বাংলাদেশ জাতীয় বাউল সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল সরকার বলেন, দেশের মাটিতেই আজ বাউল শিল্পের অনাদর, অবহেলা, অসম্মান, নিয়মিত চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব! প্রযুক্তিনির্ভর পশ্চিমা দেশগুলির অপসংস্কৃতির ভীড়ে জারী-সারি, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, বৈঠকী, কবিগান, পালাগান, মুর্শীদিগান, বাউলগান আজকাল শোনাই যায় না। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমন্ত্রণ সংগীত পরিবেশন করতে গিয়েও শিল্পীরা নানা রকম বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখীন হন।
বিখ্যাত বাউল গানের রচয়িতা গীতিকার মাষ্টার কবির বলেন, এখানে বহুকাল থেকে নিয়মিত বাউল গানের চর্চা ও পরিবেশন হলেও সম্প্রতি মাজার শরীফ কমপ্লেক্স প্রাঙ্গনে বাউল গান চর্চা ও পরিবেশন বন্ধ থাকায় দর্শনার্থীদের সংখ্যা হ্রাসের পাশাপাশি ছিন্নমূল বাউল শিল্পীদের দুঃখ দূর্দশার শেষ নেই। সহস্রাধিক ছিন্নমূল বাউল শিল্পী অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। অনেক প্রতিভাবান বাউলশিল্পীরা জীবিকার তাগিদে আজ বাউলগান ছেড়ে দিয়েছেন। দর্শনার্থীগণ হযরত শাহ্ আলী বাগদাদী (রঃ) মাজার শরীফ বিমুখ হওয়ায় ঐতিহ্যে ভাটা পড়তে শুরু করেছে এই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানটির।
বাংলাদেশ জাতীয় বাউল শিল্পী সমিতির যুগ্ম-সম্পাদক বিশিষ্ট বাউল শিল্পী শাহিন সরকার বলেন, যেহেতু বাউল শিল্প দেশীয় সংস্কৃতির একটি বিরাট ঐতিহ্যবাহী অংশ বিশেষ। সেহেতু এই শিল্পকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একান্ত সহযোগীতার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টদের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণই শিল্পটিকে দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি হতে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
এ বিষয়ে হযরত শাহ্ আলী (রঃ) মাজার শরীফ কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক মোর্শেদ আলম বলেন, বর্তমানে চলমান করোনা পরিস্থিতিতে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই মাজার শরীফ কমপ্লেক্সে বাউল শিল্পীদের গান বাজনা বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।