জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি সমাগত। জুলাই শহীদদের স্মরণে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা ও স্মরণ সভায় সাবেক প্রধানমনন্ত্রি ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সব দলের ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার ঢাকার বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলনকেন্দ্রে বিএনপি আয়োজিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূতির অনুষ্ঠানে ভার্চুয়াল বক্তৃতায় বেগম জিয়া এ আহ্বান জানান। গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের টাইমলাইন নিয়ে অনিশ্চয়তা অনেকটা কেটে গেলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুতে জুলাই আন্দোলনের অংশীদার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরণের বিভেদ-বৈরিতার সুরও দেখা যাচ্ছে। বিশেষত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এজেন্ডা অনুসারে জুলাই সনদ চুড়ান্তকরণ, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনী ফর্মূলা নিয়ে বিএনপির সাথে জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে এক ধরণের বিপ্রতীপ অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় জুলাই শহীদদের বর্ষপূর্তিকে সামনে রেখে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। ভার্চুয়াল উদ্বোধনী বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন প্রশ্নে দেশে ঐক্যের বদলে সমাজে বিভক্তি, অস্থিরতা সৃষ্টির পাশাপাশি ফ্যাসিস্ট শক্তির পুনর্বাসনের পথ সুগম করবে বলে মন্তব্য করেছেন। জাতির এই ক্রান্তিকালে সংকট ও সম্ভাবনার দোলাচলে এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফ্যাসিবাদী শক্তির পতনের মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে একটি স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা কাজে লাগাতে বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাঙ্খারই প্রতিফলন ঘটেছে।

গত বছর জুলাইয়ের শুরু থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ক্রমে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে রূপ নেয়ার প্রাক্কালে দেশের সব ডানপন্থী, বামপন্থী, জামায়াতসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিকদলের প্রতি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিল বিএনপি। মূলত সেই জাতীয় ঐক্যের স্পিরিটকে ধারণ করেই জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে দেশের ছাত্র-জনতা দলমত ভুলে রাজপথে নেমে এসে নিষ্ঠুরতম স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত করেছিল। প্রায় দেড় হাজার শহীদের জীবন এবং তিরিশ হাজারের বেশি আহত জুলাই যোদ্ধার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন স্বাধীনতা যেন দলগুলোর গৌণ মতপার্থক্য ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভোটের রাজনীতির বিভেদের কারণে ব্যর্থ হয়ে না যায়, সেদিকে সবারই সচেতন থাকতে হবে। ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বেগম খালেদা জিয়া,‘ বীরের এ রক্ত¯্রােত, মায়ের অশ্রুধারা যেন বৃথা না যায়, তা’ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে শহীদ জিয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। একদিকে পতিত স্বৈরাচারের সাথে সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশি কুশীলবদের নানামুখী ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে আগামী নির্বাচনে ভোটের রাজনীতিকে ঘিরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অংশীদারদের মধ্যকার মতভিন্নতা দেশে মিশ্র এক অনিশ্চিত বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। কোনো বিষয়ে নিশ্চিত ও নি:শঙ্ক হওয়া যাচ্ছে না। এহেন বাস্তবতায় দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জনভিত্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা বাস্তবায়নের সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। একই সময়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মাসব্যাপী সরকারি কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে আর যেন কোনো স্বৈরাচারের পুনরুত্থান না ঘটতে পারে সে বিষয়ে দেশবাসিকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

লন্ডনে তারেক রহমানের সাথে ড.ইউনূসের বৈঠকে নির্বাচনের যে সম্ভাব্য ডেটলাইনের কথা বলা হয়েছিল, গত সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও প্রধান উপদেষ্টাকে ফোন করলে তাঁকেও তিনি আগামী বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচনের তথ্য জানিয়েছেন। তবে কিছু অমীমাংশিত ইস্যুর কারণে নির্বাচন নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তার জন্ম হতে দেখা যাচ্ছে। পিআর পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মতপার্থক্য ছাড়াও জুলাই সনদ নিয়ে মতভিন্নতা, রাষ্ট্র সংস্কার ও পতিত স্বৈরাচারের বিচারের অগ্রগতি দৃশ্যমান না হওয়ার বাস্তবতায় অনিশ্চয়তা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। গতানুগতিক রাজনৈতিক মেরুকণের বাইরে গিয়েও এহেন বাস্তবতা নিয়ে মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূতিতে মাসাধিককালব্যাপী অনুষ্ঠানমালার শুরুতে রংপুরের পীরগঞ্জে শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করে জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির(এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই আন্দোলনের লক্ষ্য শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, এর মূল লক্ষ্য ছিল নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। এ কথা ঠিক যে, ৫৪ বছর বা ১৬ বছরে ভেঙ্গে পড়া রাষ্ট্রকাঠামো এবং রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সংস্কার এক-দেড় বছরেই নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এটি একটি চলমান ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। রাষ্ট্র সংস্কার ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে ন্যুনতম জাতীয় ঐক্য বজার রাখার মধ্য দিয়েই পর্যায়ক্রমে তা অর্জন করা সম্ভব। পতিত স্বৈরাচারের বেশিরভাগ দোসর এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা এখনো বিদেশে বসে সরকার এবং জুলাই যোদ্ধাদের হুমকিসহ উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে কিছু মতভেদ সত্ত্বেও বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার ঐক্য অটুট রাখতে হবে। পিআর পদ্ধতির নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তা যেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার ঐক্যে ফাঁটলের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। ভোটের প্রস্তুতি, জাতীয় ঐক্য এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আলোকে সংস্কার তথা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের রূপরেখা একই সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখাই ফ্যাসিবাদের প্রত্যাবর্তন রোধের সবেচেয়ে কার্যকর পন্থা।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews