বাংলাদেশে ‘ভোট’ শব্দটি এখনো মূলত ব্যালটপেপারকেন্দ্রিক। কিন্তু গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট নয় এবং ভোটও কেবল ব্যালটেই সীমাবদ্ধ নয়।

বাংলাদেশে ‘ভোট’ শব্দটি এখনো মূলত ব্যালটপেপারকেন্দ্রিক। কিন্তু গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট নয় এবং ভোটও কেবল ব্যালটেই সীমাবদ্ধ নয়।

‘নির্বাচন’ শব্দটি আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হলেও, বর্তমান বাংলাদেশে এটি যেন এক বিভাজনরেখা, যা রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে নয়, বরং বিপরীত মেরুতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তৃতায় নির্বাচনের একটি সময়রেখা পেলেও রাজনৈতিক সংকট কমার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আস্থা-বিশ্বাসের সংকট, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এবং গুজব-অপতথ্যের বিস্তার নির্বাচন তথা রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে আরও ঘোলাটে করে তুলছে বলে মনে হওয়ার কারণ দেখা যাচ্ছে।

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনার কথা বললেন। সেটি একদিকে নির্ধারিত সময়সীমার স্বস্তি দিলেও, অন্যদিকে এক বড় রাজনৈতিক দল—বিএনপি ও তার শরিকদের কাছে তা অগ্রহণযোগ্য বলেই প্রতীয়মান হলো। তাদের যুক্তি—ঈদ, গ্রীষ্মকাল, রমজান, তাপদাহ—সব মিলিয়ে এপ্রিল নির্বাচনের উপযুক্ত সময় নয়।

সরকার বলছে, তারা সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন—এই তিনটি ‘ম্যান্ডেট’ নিয়ে এসেছে। বিএনপি বলছে, এই সরকার একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ব্যবস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং একটি দল বা গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে।

এখানে দ্বন্দ্বটা সময়ের নয়, আস্থার। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে জামায়াতসহ কিছু ইসলামপন্থী দল স্বাগত জানালেও, বিএনপিসহ আরও কিছু দল সরকারের অভিপ্রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ বলেই মনে করছে। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) যে শর্তসাপেক্ষ প্রতিক্রিয়া দিয়েছে, তা প্রশ্নটিকে আরও গভীর করেছে।

এই অবিশ্বাস কেবল নির্বাচনকাল নির্ধারণে নয়, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতি গঠনে সরকারের আন্তরিকতা ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলে।

প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে ‘জুলাই সনদ’ নামে এক নতুন দিকনির্দেশনার কথা বলেছেন, যার মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পথ রচিত হবে বলে তার প্রত্যাশা। কিন্তু এই সনদে কারা থাকবে? সেই পথে চলতে হবে যাদের, তারা কি এতে আস্থাবান? শুধু ঘোষণায় নয়, এর বাস্তব কাঠামো, স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে।

জাতীয় ঐকমত্য কথাটাই এখন বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠেছে। কারণ যারা এর পক্ষেই ছিল, তারাই এখন এর প্রণয়ন পদ্ধতি ও উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান। আবার যাদের বরাবরই দ্বিমত ছিল, তারা এখন একে নিজেদের মতাদর্শের বিজয় হিসেবে তুলে ধরছে।

ড. ইউনূস তার ভাষণে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য করিডোর এবং বিদেশিদের চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার ব্যাপারে কিছু বক্তব্য দিয়েছেন, যা রাজনৈতিক মহলে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। গুজব ছড়ানোর দায় রাজনৈতিক দলের ওপরে চাপানো হলেও, সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন নিজেই মানবিক করিডোরের কথা প্রথম সাংবাদিকদের বলেছিলেন।

রাজনীতিতে গুজব তখনই বিস্তার লাভ করে, যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা থাকে না, পক্ষপাতের আশঙ্কা থাকে এবং আলোচনা অনুপস্থিত থাকে। সরকার যাকে ‘চিলে কান নিয়েছে’ বলে হেসে উড়িয়ে দেয়, মানুষ সেটাকেই বাস্তব ধরে নেয় কারণ তাদের কাছে তথ্য নেই, ব্যাখ্যা নেই।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে আদালত কর্তৃক নির্বাচিত ঘোষিত ইশরাক হোসেনের ‘বিপ্লবী কাউন্সিল’ গঠনের ঘোষণা যেমন প্রতীকী এক চ্যালেঞ্জ, তেমনি তা রাষ্ট্রের শাসন কাঠামো ও ব্যর্থ যোগাযোগ ব্যবস্থার এক নগ্ন উদাহরণ। এই অচলাবস্থা কেবল একটি সিটি করপোরেশনের সেবা ব্যাহত করছে না, বরং জনগণের মনে একটি আতঙ্ক সৃষ্টি করছে— আমরা কি একটি ‘দ্বৈত শাসন’ পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছি?

সরকার যেটিকে ‘রাজনৈতিক নাটক’ বলে এড়িয়ে যাচ্ছে, সেটি কিন্তু মূলত তাদেরই ব্যর্থতা: রাজনৈতিক বিরোধকে সময়মতো সমাধানে না নিয়ে এসে এটিকে সামাজিক অস্থিরতায় পরিণত করা।

২.

গুজব কেবল কারো মুখে রটিয়ে দেওয়া কোনো কাল্পনিক তথ্য নয়। গুজবের জন্য দরকার ‘তথ্যের শূন্যতা’, ‘বিশ্বাসের ভাঙন’ এবং ‘চরিত্রহীন মিডিয়া’। এই তিন উপাদান যখন সমাজে সক্রিয় থাকে, তখন যে কোনো অর্ধসত্যই দ্রুত বিশ্বাসযোগ্য রূপ নেয়।

যেমন – সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া নিয়ে যে গুজব ছড়িয়েছে, তা সরকার অস্বীকার করলেও, জনগণের বড় অংশ সেটা বিশ্বাস করছে। কেন? কারণ জনগণ কখনো সত্যটি চোখে দেখেনি, কেউ ব্যাখ্যাও দেয়নি। একইভাবে সেনাবাহিনী ও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিরোধের গুজব রাতারাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, কারণ রাষ্ট্র নিজেই ব্যর্থ হচ্ছে যথাসময়ে স্বচ্ছ ব্যাখ্যা দানে।

বাংলাদেশে আজকের মিডিয়া দুটি ছকে বাঁধা—প্রথমত, সরকারপন্থী প্রচারণামূলক মিডিয়া, দ্বিতীয়ত, বিরোধীপন্থী চরম প্রতিপক্ষ সৃষ্টিকারী মিডিয়া। সত্য, সংযম ও নিরপেক্ষতার জায়গা এখন ফাঁকা।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলা টেলিভিশনগুলো যেন ‘উন্নয়ন প্রচার দফতর’। আর ইউটিউবভিত্তিক কিছু কথিত ‘নিরপেক্ষ’ বিশ্লেষক আসলে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডার হাতিয়ার হয়ে উঠছেন। অনলাইন পোর্টালগুলো ‘হেডলাইন অর্থনীতি’তে চলে—কীভাবে পাঁচ মিনিটে ক্লিক পাওয়া যায়, সত্য সে বিষয়ে দ্বিতীয় ভাবনা। ফলে জনগণের কাছে একটিই মাত্র উপায় থাকে—সন্দেহ করা। সন্দেহই এখন সচেতনতা।

আজকের রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দান ফেইসবুক, টিকটক, ইউটিউব ও মেসেঞ্জার গ্রুপ। এখানে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেই, আবার নিরপেক্ষতার দায়িত্বও কেউ নেয় না। দুটি প্রধান পন্থা চোখে পড়ে:

এক পক্ষ প্রতিপক্ষের নেতাকে ইসলামবিরোধী, ভারতপন্থী, মার্কিন এজেন্ট বা স্বার্থপর হিসেবে উপস্থাপন করছে। আরেক পক্ষ সরকারকে দুর্নীতিগ্রস্ত, বিদেশ-অনুগত এবং গণবিরোধী আখ্যা দিচ্ছে।

এই ‘মিম-রাজনীতি’ বা ‘ফেক লাইক-পোস্ট-শেয়ার’-এর যুগে জনগণের চিন্তা করার সময় নেই—ওই ২০ সেকেন্ডের ভিডিওতেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছে।

যখন রাষ্ট্রের নিজস্ব প্রচার-ব্যবস্থা অবিশ্বাসযোগ্য হয়ে পড়ে এবং রাজনৈতিক দলগুলো কেবল নিজেদের স্বার্থে কথা বলে, তখন জনসাধারণও রাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। এটাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গা।

যখন সরকার বলে, ‘সব ঠিকঠাক চলছে’, আর জনগণ দেখে বাজারে চাল-ডালের দাম অস্থির—তখন গুজব নয়, বাস্তব হয়ে ওঠে অবিশ্বাস। যখন সরকার বলে ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক’, আর মানুষ দেখে ঢাকায় মারামারি, মামলা, বিক্ষোভ—তখন মিডিয়ার রিপোর্ট নয়, নিজের অভিজ্ঞতাই সত্য হয়ে ওঠে ।

এই জায়গায় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আত্মসমালোচনা, তথ্যের স্বচ্ছতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা জরুরি ছিল। কিন্তু এখনো আমরা তা পাইনি।

আবার এ প্রশ্নও জরুরি, আমরা কি কেবল সরকারের দিকেই তাকিয়ে থাকব? না কি নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক, শিক্ষিত শ্রেণী, বিশ্ববিদ্যালয়—এদেরও দায়িত্ব রয়েছে?

একটা জাতির গণতান্ত্রিক সক্ষমতা নির্ভর করে এই প্রশ্নে—তারা কাকে বিশ্বাস করে? যদি জনগণ কেবল ফেসবুকের পোস্ট আর হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ডকে বিশ্বাস করে, তবে রাষ্ট্র তো গণতান্ত্রিক হবে না, গুজবতান্ত্রিক হয়ে উঠবে।

গুজব কেবল তথ্যের বিকৃতি নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক সংকট, রাজনৈতিক অবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। আজকে মিডিয়া যে বিভক্ত, জনগণ যে বিভ্রান্ত, রাষ্ট্র যে নিঃসাড়—তার পেছনে দায় কেবল একটি পক্ষের নয়। সরকার, রাজনৈতিক দল, মিডিয়া এবং সচেতন নাগরিক—সবাই মিলে গুজবের মোকাবিলা করতে না পারলে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নয়, বরং রাজনৈতিক অরাজকতা নতুন রূপে ফিরে আসতে পারে ।

৩.

বাংলাদেশে ‘ভোট’ শব্দটি এখনো মূলত ব্যালটপেপারকেন্দ্রিক। কিন্তু গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট নয় এবং ভোটও কেবল ব্যালটেই সীমাবদ্ধ নয়। একটি রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ভারসাম্য কীভাবে তৈরি হয়, বিরোধী দল কীভাবে কার্যকর হয় এবং রাষ্ট্রশক্তি কেমনভাবে বিকেন্দ্রীভূত হয়—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না থাকলে শুধু ব্যালটবাক্স ভর্তি করেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না।

তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখন আমাদের জন্য জরুরি :

১. বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কেন উপেক্ষিত থাকে?

২. সংসদের বাইরে বিরোধী দল থাকলে গণতন্ত্র কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়?

৩. ভবিষ্যতের জন্য কী ধরনের নতুন রাজনৈতিক রূপরেখা প্রয়োজন?

একটি কার্যকর গণতন্ত্রে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর। কারণ নাগরিকের সমস্যার সমাধান শুরু হয় স্থানীয় পর্যায়েই। অথচ বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি।

জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ—এই স্তরগুলোকে কাগজে কলমে ক্ষমতা দেওয়া হলেও বাস্তবে সবকিছু চলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের হাত ধরে। বাজেট বরাদ্দ, প্রকল্প বাস্তবায়ন, এমনকি বিদ্যালয় পরিচালনাও আজ ঢাকার দপ্তর থেকে নিয়ন্ত্রিত। এতে স্থানীয় প্রতিনিধি হতে পারলেই জনগণের সেবা নিশ্চিত করা যায় না, কারণ তার হাতে নেই কোনো বাস্তবিক কর্তৃত্ব।

এমন একটি পরিস্থিতিতে স্থানীয় নির্বাচন যতই স্বচ্ছ হোক, জনগণের ভোটে যদি ফলপ্রসূ কিছু না আসে, তাহলে ভোটের প্রতি আস্থাও কমে যায়।

সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিই হলো ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের ভারসাম্য। কিন্তু বাংলাদেশের শুরু থেকেই কার্যত সংসদে কার্যকর বিরোধী দল অনুপস্থিত। বিরোধী দল সংসদে না থাকলে যে প্রধান বিপদটি ঘটে সেটি হলো ক্ষমতা প্রশ্নহীন হয়ে ওঠে, যা এক সময় স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয়।

একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক বিরোধিতা অপরিহার্য এবং তার সাংবিধানিক প্ল্যাটফর্ম হলো সংসদ। সেটিই বাংলাদেশে প্রায় সব শাসনে প্রায় অকার্যকর। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীন হলেও বাস্তবে তার ভূমিকা সবসময় বিতর্কিত। ফলে প্রশ্ন উঠছে, সংবিধানে যে ‘নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা’র উল্লেখ আছে, তা কি শুধু লিপসার্ভিস? যদি কমিশন নিজে শক্ত অবস্থান না নিতে পারে, তবে ভোটার কাকে বিশ্বাস করবে?

আজকের রাজনৈতিক অচলাবস্থার সবচেয়ে গভীর সংকট হলো—নতুন কিছু ভাবার লোক কমে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিকে ঘৃণা করে, অথবা এড়িয়ে চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি এখন সন্ত্রাস ও সুবিধাবাদে পরিণত। বুদ্ধিজীবী সমাজও বিভক্ত—কেউ সত্য বললে তার রাজনৈতিক রং খোঁজা হয়।

বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত দু-তিনটি দল ছাড়া আর কিছু গড়ে উঠতে পারেনি। এর জন্য শুধু রাজনৈতিক দমননীতি নয়—চিন্তার দারিদ্র্যও দায়ী। ‘ভোট’ একটি প্রক্রিয়া, কিন্তু ‘গণতন্ত্র’ একটি সংস্কৃতি। শুধু ভোটগ্রহণ আর ফলাফল ঘোষণা দিয়ে সেই সংস্কৃতি তৈরি হয় না, যদি না তার সঙ্গে থাকে—বিকেন্দ্রীকৃত ক্ষমতা, কার্যকর বিরোধী দল, শক্তিশালী স্বশাসিত নির্বাচন কমিশন এবং নতুন রাজনৈতিক ধারার আবির্ভাব।

এই কাঠামোগত রূপান্তর ছাড়া সামনে যত নির্বাচনই হোক না কেন, গণতন্ত্র কাগজে থাকবে, বাস্তবে নয়।

৪.

গণতন্ত্র তখনই ফলপ্রসূ হয়, যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিরপেক্ষ থাকে এবং রাজনৈতিক দলগুলো আইনের শাসনের ভেতর থেকে ক্ষমতা প্রয়োগ করে। কিন্তু বাংলাদেশে বিগত সময়কালের অভিজ্ঞতা বলছে, রাষ্ট্র নিজেই যেন এখন গণতন্ত্রের পথে প্রধান অন্তরায়। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন, জনপ্রশাসন, পুলিশ—প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই দলীয় আনুগত্য আজ পেশাগত নিরপেক্ষতার চেয়ে বড় যোগ্যতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাষ্ট্র এখানে শুধুই নিয়ন্ত্রক নয়, একটি গোপন কারখানা, যেখানে সমালোচনা, তথ্য ফাঁস ও বিকল্প মত সবই ‘প্রতিরোধযোগ্য হুমকি’ হয়ে বিবেচিত হয়।

গণতন্ত্র কেবল একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়—এটি একটি বিশ্বাসের জায়গা। যদি জনগণ বিশ্বাস করে যে, প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় নয় বরং রাষ্ট্রীয়—তবেই তারা ভোটে আস্থা রাখে, রাজনীতিতে অংশ নেয়, সমাজে স্বাধীনতা চর্চা করে।

কিন্তু রাষ্ট্র যদি নিজেই তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়, মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে, বিচার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানায়—তাহলে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আর আলাদা কোনো ‘শত্রু’ দরকার হয় না। রাষ্ট্র নিজেই হয়ে ওঠে গণতন্ত্রের প্রধান শত্রু।

৫.

আজকাল অনেকের মনেই প্রশ্ন, বাংলাদেশ কি আর কখনও সত্যিকারের গণতন্ত্রে ফিরতে পারবে? যদি পারেও—কোন পথে? এই প্রশ্নটি যতটা রাজনৈতিক, ততটাই নৈতিক এবং সামাজিকও। এ প্রশ্নের উত্তর শুধু রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে নয়, বরং নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক—সবাইকে একযোগে খুঁজতে হবে।

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে—এটি একপক্ষের জন্য সুবিধাজনক হলেও গণতন্ত্রের জন্য তা মারাত্মক ক্ষতিকর। আমি পাঁচটি বাস্তব ও প্রাসঙ্গিক কৌশল বা দিক তুলে ধরব, যার মধ্য দিয়ে আগামী দশকে গণতন্ত্রের সম্ভাব্য একটি নতুন পথ নির্মাণ করা যেতে পারে।

এখানে দরকার:

১. স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সচেতনতা বিষয়ক পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত করা।

২. নন-পার্টিজান স্টুডেন্ট পার্লামেন্ট বা মুক্ত বিতর্ক চর্চা বৃদ্ধি করা।

৩. তরুণদের জন্য একটি বিকল্প গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা, যেখানে তারা দলীয় আনুগত্য ছাড়াই রাজনীতি করতে পারে।

৪. সামাজিক মাধ্যমে রাজনৈতিক সংলাপের পরিবেশ তৈরি করা।

৫. বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে আরও একটি নৈতিক, কার্যকর শক্তির দরকার।

এই শক্তি হতে হবে— ব্যক্তিনির্ভর নয়, নীতি ও আদর্শনির্ভর, যুবকেন্দ্রিক, নারীরসমান অংশীদারত্বে বিশ্বাসী, জাতীয়তাবাদের অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবিক মূল্যবোধে দৃঢ়, অরাজনৈতিক নয়, বরং অবিকল্প রাজনীতির বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশকারী।

গণতন্ত্রের রূপরেখা শুধু নির্বাচন দিয়ে হয় না—প্রয়োজন হয় দক্ষ, গ্রহণযোগ্য আইন ও সেগুলোর প্রয়োগ।

প্রস্তাবিত কিছু পদক্ষেপ হতে পারে, নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে নিরপেক্ষ বাছাই কমিটি, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে, তথ্য অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিশ্চিত করার আইন প্রণয়ন।

একই সঙ্গে দেশের গণমাধ্যমগুলোকে শুধু সংবাদ পরিবেশক নয়, গণতন্ত্রের পাহারাদার হয়ে উঠতে হবে। সেজন্য যা যা করা দরকার: তদন্ত সাংবাদিকতা ও পাবলিক ইন্টারেস্ট রিপোর্টিং-এর পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো, স্বাধীন মতামত ও বিশ্লেষণ প্রকাশের জায়গা তৈরি করা, সুশীল সমাজ, নাগরিক সংগঠন ও অ্যাকটিভিস্টদের জন্য নিরাপদ পরিসর সৃষ্টি করা, নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় সিটিজেন অবজারভার প্ল্যাটফর্ম গঠন।

বাংলাদেশে আন্দোলনের ঐতিহ্য দীর্ঘ, কিন্তু প্রায়ই তা নেতিবাচক বা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে। এখন দরকার: আন্দোলনকে শুধু বিক্ষোভের মাধ্যমে নয়, বিকল্প প্রস্তাবের মাধ্যমে শক্তিশালী করা, একক দাবির বাইরে নীতিনির্ভর সামাজিক চেতনা তৈরি, শ্রমিক, কৃষক, নারীবাদী, পরিবেশবাদী—সব সংগ্রামকে গণতন্ত্রের বৃহৎ ছাতার নিচে আনা ।

গণতন্ত্র কোনো একক নির্বাচনের ফল নয়। এটি একটি দীর্ঘ, ক্লান্তিকর, কিন্তু অপরিহার্য যাত্রা। সে যাত্রা কখনও রাষ্ট্রের ভেতর দিয়ে যায়, কখনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশের ইতিহাস বলে—আমরা বারবার আশাহত হয়েছি, কিন্তু বারবারই ঘুরে দাঁড়িয়েছি। ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ এবং ২০২৪ - আমাদের শেখায়: গণতন্ত্র কখনও একেবারে মরে না, সে ঘুমায়, এবং জাগে জনগণের ইচ্ছায়।

তাই আমাদের করণীয়: প্রশ্ন করা, জবাব চাওয়া, সংগঠিত হওয়া এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—ভয় না পাওয়া। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পথ এখনো রুদ্ধ হয়নি। কেবল আমরা সিদ্ধান্ত নিইনি, সেই পথে হাঁটব কি না।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews