আমরা সামনে থেকে যা দেখি, পেছনে তা নাও ঘটতে পারে। মানুষ সবটাই দেখতে পায় না। যতটুকু দেখতে পায় ততটুকুতেও না বুঝার  একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকে যায়। সে প্রশ্নবোধক চিহ্নটার শেকড় কতটা গভীরে সেটাও কল্পনা করা কঠিন। এজন্য আমাদের দৃশ্যমান কপালের নিচের চোখ দিয়ে না দেখে অদৃশ্যমান অন্তর দিয়ে দেখার চেষ্টাটা করে যাওয়া উচিত। তবেই হয়তো অদেখা সত্যটা আমাদের জীবনকে বদলে দিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে শেখাবে। ফরাসি ভাষা থেকে আসা দেজা ভ্যু কথাটা মনকে নাড়া দিলো। কখনই যেটা মানুষ দেখেনি তেমন একটা নতুন কিছু দেখে যদি কারো মনে হয় এটা তো আমি আগেই দেখেছি এমন অবস্থাটাই দেজা ভ্যু। বিস্ময়কর এক রহস্য। গবেষণা করে কেন এমনটা ঘটে সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও এক হতে পারেননি। তাহলে মানুষের দেখাতে একটা সন্দেহের তীর এসে সেটাকে বুলেট বিদ্ধ করলো। পৃথিবীতে এমন লোক কমই আছেন যাদের এই অভিজ্ঞতা হয়নি। 

সাউদার্ন মেথোডিস্ট ইউনিভার্সিটির মনস্তত্ত্ববিদ অ্যালান এস. ব্রাউন ২০০৩ সালে তার গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে বলেছেন - “পৃথিবীর ৭০ ভাগের বেশি মানুষ তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময় এই পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছেন।” কেউ বলছেন এটা স্বপ্নের প্রভাব, কেউ বলছেন এটা অতীত স্মৃতির প্রভাব, আবার কেউ কেউ বলছেন এটা মস্তিষ্কের প্রভাব। এর মানে হচ্ছে বিজ্ঞানও অনেকসময় খুব অসহায় হয়, বিভ্রান্ত হয়। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা তা যাচাই করা বিজ্ঞানের পক্ষেও দুঃসাধ্য একটা বিষয়  হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের ক্ষেত্রেও এটা ঘটছে, ঘটে চলেছে। মন্দকে মানুষ ভালো বলছে আর ভালোকে মানুষ মন্দ বানাচ্ছে। পৃথিবীটা বুঝি এমনই। যেখানে মস্তকবিহীন দেহটা ভাবছে মাথাটা তার ঠিক জায়গায় চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু সেখানে মাথা নেই, মাথা ব্যাথাও নেই। রামায়ণ রচনা প্রসঙ্গে মহর্ষি বাল্মীকিকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতার দুটি লাইন: নারদ কহিল হাসি, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে'। যা ঘটে তা সত্য নয়, যা ঘটেনা সে অদেখা ঘটনাটাই সত্য হয়। যেমন মানুষের অভূতপূর্ব কল্পনা একদিন মানুষের স্বপ্নের হাত ধরে। তারপর সে কল্পনাটা হাটি হাটি পা পা করে একদিন সত্যে পরিণত হয়। মানুষ সামনে থেকে মানুষকে বিচার করে। খুব গভীরের গিয়ে মানুষকে বিচার করতে চায় না। যেমন একটা ঘটনাকে মানুষের সামনে যেভাবে আনা হয় মানুষ সেভাবে ভাবে। কিন্তু কেন এমনটা হলো কিংবা যেটা মানুষের সামনে টেনে এনে মানুষকে বলা হচ্ছে এটা মেনে নাও, সেটা কতটা সত্য কতটা মিথ্যা সে জায়গাটাতে মানুষ কেমন যেন হাত পা ছেড়ে দেয়। মানুষ নিজে ভাবতে পারছে না। মানুষ নিজের পৃথিবী তৈরী করতে পারছে না। অন্যের ভাবনার ভুত মানুষের মাথায় ভর করেছে। প্রতিদিন মানুষ এভাবে মানুষের দাসে পরিণত হচ্ছে। শক্তির অন্তরালের শক্তির প্রভুত্ব মেনে নিচ্ছে। হয়তো সেটা বোঝার মতো বোধশক্তিটাও মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। নিজে ভাবতে না পারলে যে সত্য-মিথ্যা যাচাই করা যায়না সেটা মানুষ যেন ভুলতে বসেছে। একটা বিখ্যাত চিত্রকর্মের ভাবার্থ মনে পড়লো। যেখানে বলা হচ্ছে যেটাকে আমরা সত্য বলে চোখে দেখছি সেটা নাকি সত্য নয়, সত্যের মুখোশ পড়া মিথ্যে। 

এ প্রসঙ্গে ফরাসি একজন চিত্রকর জিনলেওন জেরোমের ১৮৮৬ সালে আঁকা বিখ্যাত একটি ছবি he truth is coming out of the well -এর বিষয়বস্তুকে টেনে আনা যায়। উনিশ শতকের একটি লোককথাকে ভিত্তি করে ছবিটি আঁকা হয়েছিল। গল্পটা ছিল এ রকম : একবার সত্য ও মিথ্যা পরস্পরের সঙ্গে দেখা করল কিছু বিষয় মীমাংসার তাগিদে। হাঁটতে হাঁটতে তারা চলে গেল একটা কুয়োর পাশে। মিথ্যা বলল, দেখ, কী পরিষ্কার পানি। চল গোসল করি। 

বলাবাহুল্য, সত্য বিশ্বাস করেনি মিথ্যার কথা। নিজে পরখ করে দেখল। যখন দেখল কুয়োর জল সত্যিই পরিষ্কার তখন মিথ্যার প্রস্তাবে রাজি হলো। দুজনে পোশাক ছেড়ে নেমে পড়ল কুয়োয়। গোসলের মাঝপথে মিথ্যা কুয়ো থেকে উঠে এসে সত্যের পোশাক পরে পালিয়ে গেল। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর মিথ্যাকে ফিরতে না দেখে সত্য উঠে এলো কুয়ো থেকে। না, মিথ্যা তো কোথাও নেই, পোশাকও নেই। রাগে অন্ধ হয়ে সত্য বের হলো মিথ্যাকে খুঁজতে কিন্তু নগ্ন সত্যকে দেখে ছি ছি করল সভ্য মানুষ। এমনকি তেড়েও এলো অনেকে। সত্য অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের বোঝাতে না পেরে রাগে-দুঃখে অপমানে ফের কুয়োয় নেমে গেল। তারপর থেকে সত্যকে আর কখনো কেউ দেখেনি। যাকে দেখেছে কিংবা দেখছে সে সত্যের পোশাক পরা মিথ্যা। একটা ফটোগ্রাফের কথা মনে পড়লো। ফোটোগ্রাফটাতে দেখানো হয়েছে, দেয়ালের সামনে থেকে পুরো বিষয়টিকে কেউ দেখলে ভাববে একটা মস্তকবিহীন মাথা বসে আছে এবং সেটা একটা দেহবিহীন মানুষের মাথাকে ধরে আছে। দেয়ালের এক জায়গায় মানুষবিহীন একটা হাত নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে। দেয়ালের আরেক জায়গায় মানুষবিহীন দুটো অর্ধেক অবশ হয়ে পড়া পা যেন পড়ে আছে। খুব সাধাসিধা চোখ দিয়ে দেখলে মনে হবে অনেকগুলো মৃত মানুষের অঙ্গপ্রতঙ্গ নিথর হয়ে পড়ে আছে। হয়তো কোনো ঠান্ডা মাথার খুনি এমনটা করেছে। কিন্তু এটা তো একপাশ থেকে দেখা একটা খণ্ডিত অংশ। এ পাশটাতে যা আছে, যা ঘটেছে সেটা তো তা নয়। বরং যেটা ঘটেনি সেটাই মনে হচ্ছে। ঠিক ওপাশটাতে গেলে দেখা যাবে চারজন দুরন্ত কিশোর মনের আনন্দে দেয়ালকে আঁকড়ে ধরে তাদের মতো করে খেলছে। সেখানে মৃত্যু নেই, সেখানে আছে বেঁচে থাকার অপার আনন্দ। আমরাও এমনটা চাই। যেখানে মানুষ একপাশ থেকে মানুষ কিংবা কোনো ঘটনাকে বিচার করবে না বরং মানুষ দুপাশটা দেখেই তার সত্যটা বলবে। একপেশে নীতি মানুষকে নীতিহীন করে। মানুষকে তার সংকীর্ণ জায়গায় জাপটে ধরে রাখে। সে জায়গাটাতে যে অন্ধ চোখ নির্ঘুম থাকে সেটা আলোকিত হোক। সবচেয়ে বড় চোখ মানুষের ভিতরে ঘুমন্ত অবস্থায় চুপচাপ বসে থাকে। অনেকটা ব্যাঙের হইবারনেশন বা শীতনিদ্রায় মতো। সেটা আমরা চাই না। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে মুক্ত চিন্তা চাই, অফুরন্ত আলো চাই। নিবু নিবু বাতিটাতে আগুনের পরশমনি চাই। যেটা পরশ পাথর হয়ে মানুষের অন্তর চক্ষুকে খুলে দিবে। মানুষ নির্ভেজাল মানুষ হয়ে তার নিজের মাথা থেকে বেরিয়ে আসা বিচার ও বিবেচনাশক্তি দিয়ে বলবে কোনটা আসল সোনা, কোনটা নকল সোনা। অনেক মানুষ যেটা বলবে সেটা সত্য নাও হতে পারে। কারণ সেখানে বিবেচনাবোধ থাকেনা, স্বচ্ছতার রং থাকে না। সে অনেক মানুষের ভিতরে একটা মানুষের মধ্যে যদি  বিবেচনাশক্তি দিয়ে দেখার মনটা তখনো বেঁচে থাকে তবে সেটা মানুষকে সত্যের পথ দেখাতে পারে। একটা ছোট গল্পের কথা মনে পড়লো। একদিন গ্রামবাসী মিলে সিদ্ধান্ত নিলো তারা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করবে। সবাই প্রার্থনার জন্য খরতায় মাটি ফেটে চৌচির হওয়া একটা মাঠে সমবেত হলো। কেবল একটা ছেলে ছাতাসহ সেখানে এলো। সবাই ছেলেটাকে দেখে অবাক হলো। অনেকে বললো, আমরা তো বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতে এখানে এসেছি। বৃষ্টিই তো হচ্ছেনা, তুমি কেন আবার ছাতা নিয়ে এসেছো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটা বললো আমি বিশ্বাস করি সবাই প্রার্থনা করলে প্রকৃতিতে বৃষ্টি নেমে আসবে। প্রকৃতির আনন্দে তখন মানুষের মন পুলকিত হবে। তখন তো আমার ছাতা লাগবে। এটাই বিশ্বাস। অদৃশ্যকে দেখার বিস্ময়কর শক্তি যেন এটি। যেটা এখন খুব দরকার। তুমি যদি দৃশ্যমান মানুষকে ভালবাসতে না পার, তবে অদৃশ্য ঈশ্বরকে তুমি কি করে ভালবাসবে-মাদার তেরেসার এমন বোধশক্তিটা আমাদের বোধশক্তিটাকে জাগ্রত করবে বোধ হয়। সন্দেহ থেকে বোধ হয় নয়, বলি নিশ্চয়।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews