বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে যতটা মূল্যায়ন করা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ঠিক ততটাই অবমূল্যায়ন করা হয়। ২০১০ সালের আগে পর্যন্ত এদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের স্বচ্ছ কোনো ধারণা ছিল না। নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম প্রতিষ্ঠিত হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ যথেষ্ট ভালো ও এটিকে কাঠামোগত আনার প্রয়োজনীয়তা থেকে ১৯৯২ সালে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া “বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৯২” প্রণয়ন করেন।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পরে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বয়স ৩৪ বছরের কম। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের যে গৌরবোজ্জ্বল অতীত (ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান), সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা না থাকাটাই স্বাভাবিক, যেহেতু তখন দেশে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। তবে দেশের যেকোনো প্রয়োজনে কিংবা অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১৫ সালের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান অতীতের সব ছাপিয়ে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে দেশের সবচেয়ে নিগৃহীত এই ছাত্রসমাজকে।
’২৪-এর জুলাইতে রাজপথে শুধু শিক্ষার্থীদের পা চলেনি—হেঁটে এসেছিল এক প্রজন্মের সাহস, ক্ষোভ আর মমত্ববোধ। জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে ভূমিকা রেখেছেন, তা শুধু সাহসিকতার নয়—একটি জনপদের বিবেক হয়ে ওঠার গল্পও বটে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চিন্তাও করে না যে সে সরকারি চাকরিতে যোগ দেবে। এখানকার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বিদেশমুখী এবং বেসরকারি চাকরি করতে কিংবা উদ্যোক্তা হতেই বেশি আগ্রহী। সরকারি চাকরি কিংবা কোটা নিয়ে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা তেমন কনসার্ন না হয়েও শুধুমাত্র “আমি শিক্ষার্থী, আহত শিক্ষার্থী আমার ভাই”, জাতীয় সমস্যার কথা চিন্তা করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হাতে হাত মিলে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। তবে গল্পের শুরুটা হয়েছিল গত বছরের ৩ জুলাই হাইকোর্টের রায়ে “৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল” থেকে। ১৪ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামার ঘোষণা দেয় এবং ১৫ জুলাই থেকে তারা রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক গেট এলাকায় তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে। ১৫, ১৬ ও ১৭ জুলাই ঢাকার উত্তরা, প্রগতি সরণি, নতুনবাজার-ভাটারা, রামপুরায় বিক্ষোভ কর্মসূচি ও প্রতিবাদ-রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
১৬ জুলাই রাতে ইউজিসি থেকে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার পর ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের হল ফাঁকা করার লক্ষ্যে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ অভিযানের নামে প্রতিটি ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালায়। এরপর ১৮ জুলাই থেকে যখন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের হল ফাঁকা হয়ে যায়, ঠিক তখনই ফিনিক্স পাখির মতো আন্দোলনের নাটকীয় মোড় আসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাত ধরে।
১৮ জুলাই সকাল ১১টায় রাজধানীর বনানীতে প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স এর শিক্ষার্থীরা, মধ্যবাড্ডায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, নতুনবাজারে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা, যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি এবং জসীমউদ্দীন রোড থেকে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং পর্যন্ত নর্দান ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন টেকনোলজি, আইইউবিএটি-সহ আশেপাশের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয় এবং সড়ক অবরোধ করে। এর কিছু সময় পর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের উপর অতর্কিতভাবে হামলা চালায় পুলিশ-র্যাব-বিজিবির সদস্যরা। এরপর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সাথে যোগ দেয় আশেপাশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইউনিভার্সিটি, ইউরোপীয়ান ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। এর কিছুক্ষণ পর নতুনবাজারে আন্দোলনরত ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ করা হয়। বনানীতে প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের ভিতরে ঢুকে চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। দুপুর ১২টা থেকে উত্তরায় দফায় দফায় শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এতে ওই দিন প্রথমবারের মতো প্রায় ১০০ জনের মতো প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
জুলাই ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলও অতীতের ন্যায় বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সংগঠিত, সুপরিকল্পিত এবং প্রতিকূলতা জয় করে একটি বলিষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলনের আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়। ব্র্যাক, নর্থ সাউথ, ইস্ট ওয়েস্ট, ড্যাফোডিল, ইউআইইউ, এআইইউবি, স্টেট ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি, সাউথইস্ট, ইউল্যাব-সহ প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের পক্ষ থেকে সেল গঠন করা হয় এবং সংগঠিত প্রচারণা চালানো হয়। তারা একদিকে গণবিক্ষোভ, বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণ করে, অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্যাতনের চিত্র, সরকারের দমননীতি এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বার্তা ছড়িয়ে দেয়। উল্লেখযোগ্যভাবে, ২৩-২৮ জুলাইয়ের মধ্যে নর্থ সাউথ ও ব্র্যাকে একাধিক বিক্ষোভে ছাত্রদল সক্রিয় নেতৃত্ব দেয় এবং গণমাধ্যমে এদের উপস্থিতি নজর কাড়ে।
অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে Private University Students' Alliance of Bangladesh (PUSAB)—পুসাব-এর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। আন্দোলনের শুরু থেকে ১৮ জুলাই বিকেলে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট হওয়ার আগ পর্যন্ত আন্দোলনের প্রতিটি তথ্য, ছবি-সহ আপডেট দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাঙ্গা রাখার মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট হওয়ার পর বিদেশে অবস্থানরত তাদের ফেসবুকের অ্যাডমিনরা সঠিক তথ্য এবং বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা দেশের বাইরের মানুষের মাঝে পৌঁছে দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করলেও ‘ইতিহাস’ নিজেই যদি মূল্যায়নে বিচারকের ভূমিকায় থাকে, তাহলে ইতিহাসের পাতা থেকে শত চেষ্টা করেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান মুছে ফেলা যাবে না। ১৮ জুলাইকে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
লেখক,
ইঞ্জিনিয়ার সুজাউর রহমান
সিনিয়র যুগ্ন মহাসচিব, জিয়া সাইবার ফোর্স-জেডসিএফ