থামছে না ডেঙ্গি সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি। ক্রমইে বাড়ছে। জুলাইয়ের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণের ঘরে পৌঁছে গেছে। গত ১৬ দিনেই এ রোগীর সংখ্যা প্রায় ৫ হাজারের কাছাকাছি।

করোনার প্রকোপ কিছুটা কমে এলেও ডেঙ্গি এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়াচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞ ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, আতঙ্কিত না হয়ে সময়মতো ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

জ্বর হওয়ার শুরুতেই প্রয়োজনীয় পরীক্ষা- নিরীক্ষা করতে হবে। এডিশ মশার বিস্তার প্রতিরোধে ঘরের আশপাশ আঙ্গিনা ছাড়াও খুলে দেওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর বেশি নজর দিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী জুন থেকে দেশে ডেঙ্গি রোগী শনাক্ত হয়। ওই মাসে ২৭২ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। জুলাইয়ে ডেঙ্গি আক্রান্ত হয় ২ হাজার ২৮৬ জন। আর আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৬৯৮।

চলতি মাসে ১৬ দিনেই ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৭০৯ জন। সব মিলিয়ে জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সাড়ে ৮ মাসে ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৬৫ জনে। শনাক্তের পাশাপাশি বাড়ছে মৃত্যুও। চলতি বছর এ পর্যন্ত ৫৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এরমধ্যে আগস্টেই মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাইতে ১২ এবং চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে আরও ২৩৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

এরমধ্যে রাজধানীতে ১৮২ ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ৫২ জন। বর্তমানে সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে ১ হাজার ২৪৭ জন রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে রাজধানীতেই ১ হাজার ৪৭ জন।

এর আগে ২০১৯ সালে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক ডেঙ্গি রোগী শনাক্ত হয়। ওই বছর ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৩০০ লোক প্রাণ হারান। যদিও সরকারি হিসাবে সংখ্যাটি ছিল ১৭৯।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে সে সময় সারা দেশে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। ২০২০ সালে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১ হাজার ৪০৫। কিন্তু এ বছর ফের বাড়ে ডেঙ্গির প্রকোপ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার যুগান্তরকে বলেন, সরকারি হিসাবে প্রতিদিন ডেঙ্গি আক্রান্তের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে বাস্তবে এটা আরও বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শুধু নির্দিষ্ট হাসপাতালের তথ্যই গণমাধ্যমে প্রকাশ করছে। কিন্তু এর বাইরে অনেকে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন, যা সরকারি হিসাবে আসছে না। দেশে করোনা মহামারি এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। কমছে মৃত্যুর মিছিল। শনাক্তের হারও ৬ শতাংশের নিচে।

রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর প্রায় ৭৫ শতাংশ শয্যাই ফাঁকা। আগের মতো একটি শয্যার জন্য রোগীর স্বজনদের এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে চলার দৃশ্যও চোখে পড়ে না। এতে সাধারণ মানুষের মনে কিছুটা হলেও ফিরে আসছে স্বস্তি।

কিন্তু নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ডেঙ্গি। দিন দিন তা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামে। করোনা রোগী কমলেও হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গি রোগীর চাপ।

সরকারি হিসাবের চেয়ে বাস্তবে ডেঙ্গি আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এরফলে সবার মধ্যে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেঙ্গির এ ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, এ বছর বেশিরভাগই ‘ডেনভি-৩’ ধরন দ্বারা আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনটি সবচেয়ে মারাত্মক। দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। মৃত্যুর ঝুঁকিও বেশি।

চলতি বছর আক্রান্তদের বেশিরভাগই শিশু ও কিশোর। সম্প্রতি খুলে দেওয়া হয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানে এডিস মশার লার্ভা থাকার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও খোলার আগে এসব প্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও আতঙ্কে আছেন অভিভাবকরা।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নির্দিষ্ট সময় নয়, মশা নিধনে সারা বছর কর্মসূচি চলমান থাকা উচিত। কিন্তু আমরা সেটা দেখছি না। ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব শুরু হলেই সিটি করপোরেশনকে নড়েচড়ে বসতে দেখা যায়। তবে এডিশ মশা নিয়ন্ত্রণে শুধু সিটি করপোরেশনকে দায়ী করা উচিত হবে না।

এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। কারণ, ডেঙ্গির উৎপত্তিস্থল বসতবাড়ি ও আঙ্গিনায় জমে থাকা পানি থেকেই বেশি হচ্ছে।

ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গি রোগী ভর্তি ও মৃত্যুর তালিকা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এতে দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গি রোগীর চাপ বেশি।

বুধবার সারা দেশে ৩০৭ জন ডেঙ্গি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন ২৪৪ জন। এরমধ্যে ঢাকার ১৩টি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৮৮ জনের মধ্যে মিটফোর্ডেই ৪৬ জন। বৃহস্পতিবারও এ হাসপাতালে ২২ জন ভর্তি হয়েছেন।

চলতি বছর রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে মোট মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের। এরমধ্য মিটফোর্ডেই ১৩ জন। ভর্তি রোগী ও মৃত্যুর দিক থেকে মিটফোর্ডের পরেই রয়েছে শিশু হাসপাতাল। এখানে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৯ জন।

রোগীর স্বজন ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার ডেঙ্গি আক্রান্ত হওয়ার পর তীব্র জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা ও বমির উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। আর শিশুদের পেটব্যথা এমনকি পাতলা পায়খানাও হচ্ছে। ভাইরাসটির ধরন পরিবর্তনের কারণে এবার জ্বর ভালো হওয়ার পরও শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। একটু অসচেতন হলেই রোগীর জীবন পড়ে যাচ্ছে হুমকির মুখে। আক্রান্ত যেসব শিশু মারা গেছে তাদের বেশিরভাগই ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে মারা যায়।

১৫ বছরে মেয়ে অনুমৃতা আলম প্রজ্ঞা। ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে ১২ সেপ্টেম্বর ভর্তি হয়েছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালে। প্রজ্ঞার বাবা মাহবুব আলম লাবলু যুগান্তরকে বলেন, জ্বর আসার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গি পরীক্ষা করাই। মেয়ের ডেঙ্গি শনাক্ত হওয়ার পরপরই হাসপাতালে নিয়ে আসি।

হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। শুরুতে প্রচণ্ড পেটে ব্যথা, পাতলা পায়খানাসহ প্লাটিলেটও কমে যায়। বর্তমানে কিছুটা উন্নতির দিকে। মেয়ের এ অবস্থায় পরিবারের সবাই খুব উদ্বিগ্ন। এর আগে তিনি নিজেও ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।

তিনি বলেন, এবার ডেঙ্গি আক্রান্তদের নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিচ্ছে। দ্রুত সময়ে রোগী দুর্বল হয়ে পড়ছে। কমে যাচ্ছে প্লাটিলেট। শিশুদের ডেঙ্গি থেকে রক্ষা পেতে প্রত্যেকটি পরিবারকে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার যুগান্তরকে বলেন, চলতি বছর ডেঙ্গির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে এপ্রিল ও মে মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি ছিল।

তাছাড়া দেশে ডেঙ্গি রোগের বাহক এডিস মশার বংশবৃদ্ধির উপযোগী তাপমাত্রা ছিল। তাছাড়া এডিস মশা নিধনে কার্যকর উদ্যোগও ছিল না। মশার প্রকোপ বাড়ার পর সিটি করপোরেশনকে তা নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। তাছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবও লক্ষ্য করা যায়।

কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর একার পক্ষে সচেতন হলে ডেঙ্গির প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তাতে এ মাসজুড়েই বাড়তে পারে ডেঙ্গির প্রকোপ। তাই ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ব্যবস্থা জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই। জনগণকেও এ কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। কমপক্ষে সপ্তাহে একদিন প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার পাশাপাশি মশার ওষুধ ছিটাতে হবে।

ডেঙ্গি আক্রান্তরা দ্রুত শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে কবিরুল বাশার বলেন, এ সময়ে সাধারণ জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের করোনা ও ডেঙ্গি পরীক্ষা করা উচিত। কিন্তু করোনার কারণে অনেকেই হাসপাতালে যেতে চান না। তাই জ্বর হওয়ার কয়েকদিন পরে তারা পরীক্ষা করান।

কিন্তু ডেঙ্গি আক্রান্ত হওয়ার ৫ দিনের মধ্যে তার শারীরিক জটিলতা শুরু হয়। দেরি করে পরীক্ষা ও হাসপাতালে যাওয়ার কারণে অনেক রোগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি মারাও যান। তাই জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনা ও ডেঙ্গি পরীক্ষা অবশ্যই করাতে হবে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews