সকালে ঘুম থেকে জেগে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস বহুদিনের। ছাপা কাগজের সঙ্গে আজকাল যুক্ত হয়েছে অনলাইন। সমকালসহ গোটা তিনেক ছাপা কাগজে চোখ বুলিয়ে আবার অনলাইনে চোখ রাখি। তাই পত্রিকা পড়তে পড়তেই সকালের রোদ চড়া হতে থাকে।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে। অভ্যাসমতো সকালে পত্রিকা হাতে নিয়ে জানতে পারি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যা কমিয়ে আনতে সম্মত হয়েছে দুই দেশ। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে- সীমান্ত হত্যা শূন্যে কমিয়ে আনতে দুই দেশ একত্রে কাজ করতে সম্মত হয়েছে।

সীমান্ত হত্যা কমিয়ে আনার বিষয়ে খবর স্বাভাবিকভাবেই আশাবাদী করে তুলল। কিন্তু আশাহত হতেও বেশি সময় লাগল না। ছাপা পত্রিকা হাত থেকে নামিয়ে অনলাইনে চোখ রাখতেই জানা গেল- দিনাজপুরের দাইনুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে মিনহাজ (১৯) নামে এক বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় আরও দুই বাংলাদেশি নিখোঁজ রয়েছেন। সমকালের অনলাইনে প্রকাশিত খবরে আরও বলা হয়েছে-নিহত মিনহাজ সদর উপজেলার ৯ নং আস্করপুর ইউনিয়নের ভিতরপাড়া এলাকার জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে। নিখোঁজ দুই ব্যক্তি হলেন- একই ইউনিয়নের খানপুর এলাকার লতিফুল ইসলামের ছেলে এমদাদুল (২৮) ও সালমানের ছেলে সাগর (২০)। এই ঘটনা ঘটেছে বুধবার। তার মানে, এই সীমান্ত হত্যার ঘটনা এমন সময়ে ঘটল, যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এখনও ভারতে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যেখানে সীমান্তে হত্যা কমিয়ে আনার বিষয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন মাত্র একদিন আগে; সেখানে মিনহাজের মৃত্যু শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিপরীত চিত্রই প্রকাশ করে।

বাংলাদেশ-ভারত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশটি বাংলাদেশের জনসাধারণকে আশ্রয়, প্রশিক্ষণ, যুদ্ধ সহায়তা দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ৩ হাজার ৯০০ সেনা নিহত হয়েছেন। প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রটির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের কৃতজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে বন্ধুরাষ্ট্রটি এখন কেমন মুখ আমাদের সামনে হাজির করবে- এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান এখনও দ্বিধাবিভক্ত। যুদ্ধাবস্থা ব্যতিরেকে কোনো স্বাধীন দুই দেশের সীমান্তে এমন হত্যার নজির বিশ্বে বিরল।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে আছে ফেলানী। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ফেলানী মারা যায়। ফেলানীর লাশ অন্তত পাঁচ ঘণ্টা কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকে। কাঁটাতারে ঝুলে থাকা কিশোরী ফেলানীর লাশ দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছিল। তখন দাবি তোলা হয়েছিল- ফেলানী যেন সীমান্তে শেষ হত্যার ঘটনা হয়। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার চিত্র বুঝতে কয়েকটি তথ্য সামনে আনা যেতে পারে : মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের ১১ বছরে ৫২২ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে বা নির্যাতনে মারা গেছেন। এই হিসাব ২০০০ সাল থেকে ধরলে দেখা যায়, ২০০০ থেকে ২০২০- এই ২০ বছরে ১ হাজার ১৮৫ জন বাংলাদেশির বিএসএফের হাতে মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে বিএসএফ আট বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এর মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ছয়জনকে। এই সময়ে আহত হয়েছেন চারজন। সাতজনকে অপহরণ করা হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে হত্যা করা হয় মোট ১৯ জন বাংলাদেশিকে। এর মধ্যে ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালে হত্যা করা হয় ৪৯ জনকে। তাঁদের মধ্যে গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ৪২ জন।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবি জানালেও তা বারবার উপেক্ষিত হয়েছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে (১৭-২১ জুলাই) সীমান্ত সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন বিএসএফের মহাপরিচালক পঙ্কজ কুমার সিং। তিনি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, 'সীমান্ত এলাকায় সব গুলির ঘটনাই রাতে ঘটে এবং যেসব হতাহতের ঘটনা ঘটে, তারা সবাই অপরাধী।' আশা করি, বিএসএফ প্রধান ভুলে যাননি, এই সীমান্তেই মারা গিয়েছিল কিশোরী ফেলানী। ফেলানী অপরাধী ছিল- এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ এখনও আমরা জানি না। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, বিএসএফ প্রধানের ওই বৈঠকের পরেও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দুই বাংলাদেশি নিহত হয়েছিলেন। ২৪ আগস্ট পঞ্চগড়ের অমরখানা সীমান্তে আবদুস সালাম নামে এক বাংলাদেশিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ৩১ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিংনগর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ভেদু নামে আরেকজন নিহত হন।

ভারতের সঙ্গে চীনেরও সীমানা রয়েছে। সেখানে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলেও গুলি ছোড়ার অনুমতি নেই। আবার পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সীমানা বিরোধে দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু সেখানে বেসামরিক মানুষকে গুলি করে মারার ঘটনা নেই। ইউরোপের অনেক দেশের প্রতিবেশীর সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। একমাত্র বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তেই এভাবে বেসামরিক মানুষকে অকাতরে মৃত্যুর ভাগ্য মেনে নিতে হয়। প্রতিবেশী দেশের গুলিতে বিনাযুদ্ধে এভাবে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকলে এই অঞ্চলে যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও নিরাপত্তা বলয়ের কথা দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে, তা ব্যাহত হবে। তাই সবার আগে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে উদ্যোগী হতে হবে। আর এই উদ্যোগ প্রতিবেশী ভারতের পক্ষ থেকেই আসতে হবে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews