বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন ছায়াসঙ্গী। তিনি বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে বঙ্গবন্ধুকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন ও প্রেরণা দিয়েছেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনে রেখে গেছেন অনন্য ভূমিকা। একই পরিবারে বড় হয়ে উঠা দুই জনের একসঙ্গে পথচলা জীবনের শুরু থেকেই। বঙ্গমাতা একেবারে কৈশোর বয়সে শেখ মুজিবের সহধর্মিণী হয়েছিলেন। বেশি লেখাপড়া না করা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের যোগ্য সহধর্মিণী এবং সহযোদ্ধা। কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধুর পড়াশোনা করা এবং তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই বঙ্গমাতার ছিল সহযোগিতা ও সমর্থন। তিনি শুধু স্বামী, সন্তান, সংসার ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনই করেননি। তিনি একদিকে যেমন সাধারণ একজন বাঙালি নারীর মতো স্বামী-সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে সর্বক্ষণের সহযোগী ও অনুপ্রেরণাদাত্রী হয়ে নিভৃতে কাজ করে গেছেন। জীবনের শুরু থেকেই যে সংসারের মধ্যে নিজের জীবনের পূর্ণতা খঁুজে পেয়েছিলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন দক্ষ নাবিকের মতো।

দেশ বিভাগের আগে ১৯৪৬ সালে দাঙ্গার সময় বঙ্গমাতা নিজে অসুস্থ থাকা অবস্থায়ও স্বামীকে দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় কাজ করতে উৎসাহ দিয়েছেন। চিঠি লিখে দেশের কাজে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছেন এইভাবে, ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হবার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্য জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর ওপর আমার ভার ছেড়ে দিন।’ কারণ তার চিন্তায়-চেতনায় লালিত ছিল বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও আদর্শ। স্বভাবতই নিজের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থ তার কাছে অধিক গুরুত্ব পায়। দেশের স্বাধিকার এবং মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধুকে জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় কারাগার যাতনা সহ্য করতে হয়েছে। কারাবন্দি অবস্থায় অনশন ধর্মঘট করার কারণে মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়তেন। বঙ্গবন্ধুকে সব দুঃখ ও নির্যাতন বরণের শক্তি, সাহস, ধৈর্য, সহ্য ও প্রেরণা দিয়েছেন এই সংগ্রামী নারী। ‘কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী,/প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষ্মী নারী’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার এই দুটি লাইন বঙ্গমাতার জন্য শতভাগ প্রযোজ্য।

বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালীন বঙ্গমাতা ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও ছাত্র নেতাদের পরম নির্ভরতার শেষ আশ্রয়স্থল। বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনাও নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছে দিতেন। যার ফলে আন্দোলন ও সংগ্রামে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতেন। তিনি দলকে সংগঠিত করা এবং সঠিক সময়ে সঠিক ও কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণে দার্শনিকের ন্যায় ভূমিকা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে নতুনরূপে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অনেক সভায় অংশগ্রহণ ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিতেন। সেজন্য প্রায়ই গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বাড়িতে আসত ও আগত অতিথিদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখত। এ সময় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটির নির্মাণকাজ চলমান ছিল। বঙ্গমাতা বাড়ি নির্মাণের কাজ তদারক করতেন এবং প্রায়শ নিজে বাড়ির নির্মাণকাজে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতেন। আজকের ৩২ নম্বরের বাড়ির সঙ্গে বঙ্গমাতার অসংখ্য স্মৃতি ও মূল্যবান শ্রম জড়িয়ে আছে। বিশেষ করে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামে বঙ্গমাতার বিভিন্ন অবদানকে বঙ্গবন্ধুও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেছেন, ‘আমার সংগ্রামী রেণু সেই কোন ছোটবেলা থেকে আমার সঙ্গে সঙ্গে সংগ্রাম করে চলেছে। সে আজ মিশে গেছে জনতার সঙ্গে। এভাবে মিশে যাওয়ার জন্যই তো রেণু তার সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছে। রেণু তো আজ মাত্র পাঁচটি সন্তানের জননী নয়, রেণু আজ বাংলাদেশের লাখ লাখ সন্তানের জননী’ (আনোয়ারা সৈয়দ হক, আমার রেণু, পৃষ্ঠা- ১৬৮)।

বঙ্গমাতা জাতির পিতা, একজন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি অতিসাধারণ জীবন যাপন করতেন। এমনকি ফার্স্ট লেডির পদ গ্রহণ বা ভূমিকা রাখেননি। ভোগ-বিলাসী জীবন কখনো তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। দলকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালে মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধু ইচ্ছা করলেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। অন্য কোনো স্ত্রী হলে স্বামীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করত। কিন্তু বঙ্গমাতা দ্বিমত পোষণ করেননি । কারণ লোভ-লালসা, বিলাসিতা, ভোগবাদিতা ও ক্ষমতা তার বিবেকের কাছে ছিল অবনত। দুই ছেলের বিয়েতে দামি অলংকারের পরিবর্তে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেন। স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সন্তানদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। জাতিকে শেখ হাসিনার মতো বিশ্বমানের রাজনীতিবিদ উপহার দেন। আমি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কাজে প্রায়ই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতাম। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিজীবনে তিনি যে কতটা সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তা আমি নিজ চোখে দেখেছি। তিনি নিজে তরকারি কাটা, রান্না করা, নেতাকর্মীদের চা পরিবেশন করতেন। এক প্যাঁচে সাধারণ শাড়ি পরতেন।

বঙ্গমাতা সামাজিক কাজেও আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি নিজের স্বামী, সন্তান, সংসার, শ্বশুর-শাশুড়ি ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত ও আত্মত্যাগী নারীদের পুনর্বাসনের জন্য নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। তাতে বঙ্গমাতার ছিল অসাধারণ ভূমিকা। তিনি নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে দক্ষতা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কুটিরশিল্পসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বঙ্গমাতার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এবছরই ঢাকাস্থ নীলক্ষেত কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের নামকরণ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল করা হয়েছে এবং কর্মজীবী নারীদের নিরাপদ আবাসন-সুবিধা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ১০ তলাবিশিষ্ট নবনির্মিত ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালে এ উপমহাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক নারী সংগঠন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মহিলা আওয়ামী লীগ গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন যা বর্তমানে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বজ্যেষ্ঠ সহযোগী সংগঠন। আমি সৌভাগ্যবান যে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। আত্মীয়স্বজন ও সংগঠনের কর্মীদের প্রতি তার খুব দরদ ছিল বিধায় গণভবনে না থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতেই থাকতেন। বহু রাজনৈতিক কর্মী তার স্নেহ ও মমতা লাভ করেছেন। আমিও তার স্নেহ ও মমতা থেকে বঞ্চিত হইনি।

আগস্ট মাস শোকের মাস। স্বজন হারানোর মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডে নিহত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শহিদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, শেখ রাসেলসহ সব শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এবং তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার সময় ছোট শিশুপুত্র রাসেলসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকেও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।

এ বছরের ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মায়ের অনুপ্রেরণা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সবসময় আমি এটা অনুভব করি যে আমার মা, আমার বাবা সবসময় তাদের দোয়া আমার ওপরে রেখেছেন। তাদের আশীর্বাদের হাত আমার মাথায় আছে। তা নইলে আমার মতো একটা সাধারণ মানুষ যে অতি সাধারণ বাঙালি মেয়ে, এত কাজ করতে আমি পারতাম না যদি আমার বাবা-মায়ের দোয়া, আশীর্বাদের হাত আমার ওপর না থাকত’। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘মহীয়সী বঙ্গমাতার চেতনা, অদম্য বাংলাদেশের প্রেরণা’ যা যথার্থ এবং সময়োপযোগী। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে যেমন মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস লেখা যায় না, তেমনই বঙ্গমাতাকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

সরকার ২০২১ সাল থেকে বঙ্গমাতার অবদান চিরস্মরণীয় করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পাঁচ জন বিশিষ্ট নারীকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক প্রদান করছে। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব যে সততা, মহানুভবতা, উদারতা ও আদর্শের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা যুগে যুগে বাঙালি নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। ৯২তম শুভ জন্মদিনে তার স্মৃতির প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমি একই সঙ্গে প্রস্তাব করছি, বঙ্গমাতার গৌরবময় কর্মজীবন পাঠ্যপুস্তকে অন্তভু‌র্ক্ত করা এবং গবেষণার মাধ্যমে তার বর্ণাঢ্য জীবনের অজানা দিকগুলো নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হোক। আমি দাবি করছি, অবিলম্বে দণ্ডপ্রাপ্ত ১৫ আগস্টের পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করা এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পিছনে ইন্ধনদাতা ও কুশীলবদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।

লেখক : প্রতিমন্ত্রী, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গবেষক ও রাজনীতিবিদ



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews