শাগুফতা বশির

গত দশকে সশস্ত্র সঙ্ঘাত এবং এর ফলে মৃত্যুর সংখ্যা উভয় ব্যাপক হারে বেড়েছে। শুধু ২০২২ সালে যুদ্ধে দুই লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। যেটি ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা গণহত্যার পর থেকে সর্বোচ্চ বার্ষিক মৃত্যুর সংখ্যা। ওই একই বছরে বিশ্বজুড়ে ৫৬টি যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতের ঘটনা ঘটে। তখন কমপক্ষে একটি দেশ সক্রিয়ভাবে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল।

ক্রমবর্ধমানভাবে একটি ধারণা হচ্ছে যে, এসব যুদ্ধের অনেকগুলো কেবল ধ্বংসাত্মক নয়; বরং অজেয়। ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ এবং গাজার গণহত্যা এ ধরনের দু’টি উদাহরণ তুলে ধরেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ইউক্রেন যুদ্ধে প্রতি মাসে দুই সহস্রাধিক মানুষ নিহত হচ্ছেন বলে দাবি করা হয়। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে জানানো হয়, কমপক্ষে ৫৩ হাজার ৫৭৩ ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং এক লাখ ২১ হাজার ফিলিস্তিনিকে গুরুতর আহত করা হয়েছে। যদিও সরকারি মিডিয়া অফিস নিহতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে উল্লেখ করেছে। তাদের মতে, এই সংখ্যা ৬১ হাজার সাত শতাধিক। এদের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপাপড়ে মৃত্যুবরণ করেছে বলে ধারণা করা হয়। ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসন পুরোপুরি একটি মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সেখানে খাদ্য ও পানি সরবরাহ প্রায় বন্ধ করে দেয়ায় দুর্ভিক্ষের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বিশ্বশান্তি বর্তমানে সরু এক সুতায় ঝুলছে। জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড-১৯ মহামারীতে সৃষ্ট স্থবিরতা, অর্থনৈতিক মন্দা, জ্বালানি সঙ্কট এবং ক্রমাগত যুদ্ধে বিশ্ব সঙ্কটে জর্জরিত। সম্প্রতি পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন প্রতিবেশী পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার উত্তেজনা পাঁচ দিনের সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে রূপ নেয়।

এখন উত্তেজনা প্রশমিত হলেও ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, তাদের পরস্পরের সম্পর্কে কতটা অস্থিরতা এবং অনাকাক্সিক্ষত অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। এসব হুমকির মধ্যেও একটি সঙ্কট নৈতিক অধঃপতনের এক প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। গাজায় অবিরাম বোমাবর্ষণে গোটা এলাকা সমতল হয়ে গেছে। সব পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তাদের চিহ্নও সম্পূর্ণরূপে মুছে দেয়া হয়েছে। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে কয়েক প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হচ্ছে। গাজা এখন শুধু একটি স্থান নয়- এটি বিশ্বের ভগ্ন বিবেকের প্রতিফলনকারী একটি আয়না।

গাজার শিশুরা এখন স্কুল বা খেলার স্বপ্ন দেখে না- তারা কেবল বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। অনেকে আরেকটি সকাল দেখার জন্য বেঁচে থাকবে না। যারা বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখবে তাদের ধ্বংসের ছায়ায় বেড়ে উঠতে হবে। কেন বিশ্ব তাদের জীবনকে এত কম মূল্য দিয়েছে- এ প্রশ্ন নিয়ে বড় হতে হবে।

এটি কোনো যুদ্ধ নয়, এটি একটি গণহত্যা। বেসামরিক নাগরিক, হাসপাতাল, ঘরবাড়ি এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। মৃতের সংখ্যা কেবল একটি সংখ্যা নয়, এটি স্বপ্ন নিভে যাওয়া, ভবিষ্যৎ চুরি হয়ে যাওয়া, জীবন মুছে ফেলার প্রতিনিধিত্ব করে। তবু বিশ্ব মুখ ফিরিয়ে নেয়, মিডিয়া ভয়াবহতা হালকা করে তুলে ধরে। ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নীরব- সেগুলো যেন অচল। এগুলোর নীরবতা নিরপেক্ষ নয়। এসব সংস্থা গণহত্যাকারীদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

বিশ্বসম্প্রদায় আজ কোথায়? অন্যত্র স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষায় দ্রুত সাড়া দিলেও গাজার ব্যাপারে নীরব ও নিষ্ক্রিয় কেন? নিষেধাজ্ঞা, জরুরি সিদ্ধান্ত, ন্যায়বিচারের জরুরি আহ্বান আজ কোথায়? বরং এ ঘটনাকে সমান দু’টি পক্ষের মধ্যে সঙ্ঘাত হিসেবে দেখিয়ে গণহত্যাকে ঢেকে ফেলার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে- গাজা আজ অবরুদ্ধ, অরক্ষিত, বিশ্বের অন্যতম সামরিক বাহিনীর নৃশংস বোমা হামলায় ক্ষতবিক্ষত। এটিকে যুদ্ধ বলা মানে বাস্তবতাকে উপহাস করা। ফিলিস্তিনিদের রক্তকে কেন কম পবিত্র বলে গণ্য করা হচ্ছে? ফিলিস্তিনিদের নির্মমভাবে হত্যা করার পরও কেন তা নিয়ে নিন্দার ঝড় ওঠে না? তাদের জীবনকে কেন এত সস্তা বানানো হয়েছে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে কয়েক দশক ধরে চলা অমানবিকীকরণের মধ্যে, যা বিশ্বকে দখলদারিত্ব, স্থানচ্যুতি এবং সহিংসতার অজুহাত দিতে সাহায্য করেছে; কিন্তু এখন উদ্দেশ্য, লক্ষ্য বিশ্লেষণের সময় নয়, এখন পদক্ষেপ নেয়ার সময়।

গাজার অধিবাসীরা ইতিহাসের বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন না। তারা ক্ষমতাধর দেশগুলোর বিবেক জাগ্রত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন না। তাদের আর্তনাদ সাধারণ মানুষের দ্বারা প্রতিধ্বনিত হওয়া উচিত- যারা এখনো বিশ্বাস করেন যে, প্রত্যেক মানুষের জীবনের মূল্য রয়েছে।

আমাদের অবশ্যই প্রতিবাদ করতে হবে। লিখতে হবে। কথা বলতে হবে। দান করতে হবে। অবশ্যই একটি যুদ্ধবিরতির, জবাবদিহির এবং ন্যায়বিচারের দাবি জানাতে হবে আমাদের। কারণ নীরবতার প্রতিটি মুহূর্ত নিষ্ঠুরতার হাতকে শক্তিশালী করে। সেই সাথে প্রতিটি উচ্চকিত কণ্ঠস্বর অন্ধকারে আলোর দিশা দিতে পারে।

গাজার গণহত্যার বিষয়ে প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে বিশ্বকে বিচার করা হবে- নীতিগত বিবৃতি দ্বারা নয়; বরং আমরা সহযোগিতার চেয়ে সহানুভূতি বেছে নিয়েছি কি না তা ইতিহাস মনে রাখবে। আমরা নিরপরাধদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম নাকি তাদের কবর দেয়ার সময় চুপ ছিলাম, ইতিহাস স্মরণ করবে। গাজা রক্তাক্ত। বিশ্ব তা দেখছে। আমরা কি অবশেষে কথা বলব? নাকি মানবতা সত্যিই মারা গেছে?

সবচেয়ে মানবিক সঙ্কটের মুখে আমাদের সময়, নীরবতা আমাদের বধির করে দিচ্ছে। ন্যায়বিচারের কণ্ঠস্বর আজ কোথায়? ঈমানদার মুসলিম জাতিগুলো কি তাদের ফিলিস্তিনি ভাইবোনদের ব্যাপারে ব্যর্থ? আমরা সবসময় কি ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের অপেক্ষায় থাকব? অথচ মানুষের হাতগুলো অলস পড়ে আছে- সেগুলোর কোনো তৎপরতা আজ দেখা যাচ্ছে না।

সন্তানদের কবর দেয়া মায়েদের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার জন্য, স্বপ্নগুলো শুরু হওয়ার আগেই ভেঙে যাওয়ার জন্য কে কথা বলবে? নাকি আমাদের বিবেক অসাড় হয়ে গেছে? যেমন একবার গালিবকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তুমি কোন মুখ নিয়ে কাবায় যাবে? গালিব তবু কি তোমার লজ্জা নেই?

আমাদের নীরবতা ইতিহাসের লজ্জায় পরিণত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত হবে না। আমাদের সেই প্রজন্ম হিসেবে স্মরণ করা উচিত হবে না, যারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। বিশ্বের আর দর্শকের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন সেসব কণ্ঠস্বর যারা সাহস, দরদি মন ও দৃঢ়তার সাথে কথা বলতে পারবে।

শান্তি বিরাজ করুক। মানবতা জেগে উঠুক। খুব বেশি দেরি করা যাবে না। এটা মানবতার আর্তনাদ। অন্যায় অবিচারের দিকে তাকাও, আর চোখ ফিরিয়ে নিও না।

প্রতিটি প্রাণ হারানো এক অপূরণীয় ট্র্যাজেডি। এ অন্ধকার দিনগুলো অতিক্রান্ত হবে; কিন্তু যদি আমরা কাজ করতে, কথা বলতে এবং ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে ব্যর্থ হই; তবে তা আমাদের চিরকাল তাড়া করবে। আজ যখন ফিলিস্তিনের মানুষ অকল্পনীয় শোক সহ্য করছেন, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে, একজন মায়ের বেদনা সর্বজনীন। মানুষ হোক বা পশু, একজন মায়ের দুঃখের কোনো সীমা নেই। যেকোনো মূল্যে গণহত্যা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

যেখানে অস্ত্র কেবল ধ্বংস ডেকে আনে, সেখানে সংলাপকে নেতৃত্ব দিতে দিন। যেখানে যুদ্ধ ব্যর্থ সেখানে শান্তি জেগে উঠুক। ন্যায়বিচার, মানবতা এবং শান্তির জন্য বিশ্বকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আসুন আমরা যুদ্ধ, গণহত্যা এবং সবধরনের সহিংসতা বর্জন করি- যাতে জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারেন।

দ্য নেশন থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews