চলমান ঘটনাবলীর মধ্যে দৃশ্যত চাপে থাকা অন্তর্বন্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনার পর ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে চার দলের সঙ্গে বৈঠকের পরদিন বুধবার এই ১২টি রাজনৈতিক দল এবং একটি জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ইউনূস।
আগের দিন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপির সঙ্গে বসেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা।
বুধবার তিনি রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, নাগরিক ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ, এলডিপি, খেলাফত মজলিস, সিপিবি, বাসদ, গণফোরাম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, এবং ১২ দলীয় জোটের নেতাদের ডাকেন।
এভাবে ‘বড় দল’, ‘ছোট দল’ আলাদা করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। অনিবন্ধিত এনসিপি কী করে বিএনপির মত দলের সঙ্গে এক দিনে ডাক পেল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন একজন।
বৈঠকে দলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘দুর্বলতা’ নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে। সরকার কেবল সংকটে পড়লেই তাদের ডাকে—এমন কথাও বলেছেন নেতারা।
একটি দলের প্রতি সরকারের ‘পক্ষপাতমূলক’ আচরণ, বিচার ও নির্বাচন সংস্কারের ‘ধীর গতি’, এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলি যেমন গোপালগঞ্জ ও মাইলস্টোনের ঘটনা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছেন।
দলগুলো জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন, দুর্নীতি দমন, এবং সুশাসন নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছে।
তারা প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়মিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করার, একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা এবং গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
‘বিমাতাসুলভ আচরণ’
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “আমাদের যে জাতীয় ঐক্য হওয়া দরকার ছিল। আমরা যে বিপদের মধ্যে ছিলাম শেখ হাসিনার আমলে, শেখ হাসিনার পতনের পরে আমরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছি। সেই ভাগ হচ্ছে কেউ কেউ এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে নিচ্ছেন এবং সেটাকে একটা প্রিভিলেজ হিসেবে নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ মনে করছেন যে আমাদের মধ্যে একটা অনৈক্য তৈরি হয়েছে। বিভেদ তৈরি হয়েছে।”
এই বিভেদের পেছনে সরকারের দায় আছে বলে মনে করেন মঞ্জু। তিনি বলেন, ''শুরু থেকে আপনারা এই বিভেদটা দূর করতে পারতেন। উনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছেন কিছুটা, তিনি সম্মতি জানিয়েছেন এবং তিনি বলছেন এখন থেকে রেগুলার, আরও ঘন ঘন, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসবেন।''
এবি পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ''আমরা বলেছি, আপনি শুধু বিপদে পড়লে—শুধু একটা ঝামেলা হলেই আপনি আমাদেরকে ডাকেন। এবং আমাদের অনেক কথা থাকে—যে কথাগুলো আমরা আপনার এখানে, বিশেষ করে বলতে পারি না। কারণ অনেকগুলো দল থাকে, আমাদের দুই-চার মিনিট করে কথা বলার সুযোগ হয়।''
তিনি বলেন, ''আমরা বলেছি, দুইটা বিষয়ে ব্যাপক সংশয় আছে। একটা হচ্ছে সংস্কার আসলে ঠিকমত হবে কিনা, আর নির্বাচন ঠিকমত হবে কিনা। এই দুইটা বিষয় (সংশয়) আপনাকে (ইউনূস) দূর করতে হবে।
“দূর করার জন্য যেটা দরকার, অনেক রাজনৈতিক দল সেখানে সমালোচনা করেছেন। সরকারের নানা বিমাতাসুলভ আচরণের কথা বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন যে আপনি কোনো কোনো রাজনৈতিক দলকে প্রটোকল দিচ্ছেন, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল সরকারি সুবিধা পাচ্ছে—আর আমরা অনেক রাজনৈতিক দল আছি, আমরা কোথাও যাচ্ছি, চলছি, ফিরছি—আমাদের কোনো সরকারি প্রোটোকলের কথাও আমরা বলছি না। তো এই বিষয়গুলো এসেছে।''
‘দুর্বল সরকার’
১২ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ''আমাদেরকে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে আলোচনা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে আমরা সরকারের বিভিন্ন দুর্বলতার কথা বলেছি। আমরা বলেছি, অতীতে বারবার আপনাকে (প্রধান উপদেষ্টা) বলা হয়েছে যে আপনি উপদেষ্টা মণ্ডলীতে সংস্কার করুন। যোগ্য এবং দক্ষ উপদেষ্টাদের আপনি আপনার উপদেষ্টা পরিষদে সংযুক্ত করুন।
“আমরা সরকারকে বলেছি, সামনের রাজনীতি এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো দলের প্রতি যেন অনুরাগ অথবা বিরাগের বশবর্তী হয়ে সরকার পরিচালিত না হয়। আমরা এও দেখেছি, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল, যেই প্রটোকল নিয়ে, যেভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে আক্রমণ করে কথা বলছে—এতে করে আমাদের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে বিভেদটা আরও তীব্র হচ্ছে। আমরা এই বিভেদ চাই না।”
তিনি বলেন, “সর্বদলীয়ভাবে বৈঠক করে আপনি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যারা রাজপথে ছিল, সে সমস্ত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আপনি মাঝে মাঝে বসেন, সময়ে সময়ে বসেন, মতবিনিময় করেন। মতবিনিময় করলে অনেক কিছু আপনার সমাধান হয়।”
অনেক রাজনৈতিক দলের প্রধান ব্যক্তিরা সচিবালয়ে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও অনেক উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে পারেন না বলেন হতাশা প্রকাশ করেন শাহাদাত হোসেন সেলিম।
তিনি বলেন, “আপনার অনেক উপদেষ্টা জনবিচ্ছিন্ন। আপনারা দুর্বল সরকার হিসেবে ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছেন। সুতরাং এখনো সময় আছে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন যখন সামনে এগিয়ে আসবে, তখন পতিত স্বৈরাচারের পক্ষ থেকে নানারকম উসকানিমূলক আচরণ করা হবে, নানারকম উসকানিমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হবে। সেগুলো যদি এখন থেকেই শক্ত হাতে দমন না করেন, তাহলে আমাদের পক্ষে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিকে উপহার দেওয়া সম্ভব হবে—এটা আমরা বিশ্বাস করি না।”
‘প্রধান উপদেষ্টা উৎকণ্ঠিত’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির-সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “শুধু এ ধরনের সংকটে যার যার দায়িত্ব পালন করবে, হুটহাট করে ডাকলে সবসময় আসবে, এমন না। কিন্তু আজকে যখন বললেন, আমরা স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করলাম এজেন্ডা কী? উনারা বললেন, এজেন্ডা হচ্ছে এখন দেশ একটা সংকটপূর্ণ আছে। এই সংকটে করণীয় কী? এইটা হবে এজেন্ডা।”
তিনি বলেন, “আমি যেটা বুঝেছি, প্রধান উপদেষ্টা উৎকণ্ঠিত। তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের বলেছেন, ‘আমরা একটা সঠিক নির্বাচন যাতে করতে পারি, সেই দিকে আগাব এবং এটি সবাই মিলে করতে হবে। শুধু পুলিশের উপর নির্ভর করলে হবে না, জনগণের উপর নির্ভর করতে হবে। রাজনৈতিক দল, আপনারা আছেন, আপনাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ বাড়বে, আমরা এইদিকে যাব।’ উনি এইটা শুরু এবং শেষ করেছেন।”
প্রিন্স বলেন, “দেশের মধ্যে অগণতান্ত্রিক শাসনে বেড়ে ওঠা অপশক্তি আছে, তাদের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে, তাদেরকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। যদি মনে হয়, প্রশ্রয় দিচ্ছেন, সংকট হবে।
“আরেকটা স্পষ্ট করে বলেছি, আধিপত্যবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি—উনাকে কংক্রিট বলেছি—এই যে আমেরিকার সাথে যে অসম বাণিজ্য চুক্তি, এইখানে রাখাইনকে যে করিডোর দেওয়া, বন্দর দেওয়া—এইগুলো আধিপত্য এবং সাম্রাজ্যবাদী নিদর্শন। এইগুলো যদি আসে এবং আপনি (ইউনূস) যদি নীরব থাকেন বা প্রশ্রয় দেন, তাহলে কিন্তু অন্যরা সুযোগ পেয়ে যাবে।”
তিনি বলেন, “কোনো কোনো দলের প্রতি আপনার (প্রধান উপদেষ্টা) মায়া-মমতা বেশি এবং আপনার দল হিসেবে যদি চিহ্নিত হয়, তাহলে এই সংকট থাকবে। আশা করি সেটি করবেন না— এই কথা বলে আসছি।”
জবাবে ইউনূস কী বলেছেন, সে কথা জানিয়ে সিপিবি নেতা বলেন, “উনি বলেছেন, ধৈর্য ধরে শুনে বলেছেন, ‘আমরা আগামীতে দেখি, কী করা যায়।’ আমরা আশা করব, যদি উনারা পজিটিভ ভূমিকা নেন, আগামীতে ডাকলে হয়তবা আসব। যদি দেখি, এই কথা শুনে কাজ হচ্ছে না—ডাকলেই আসব, এমনটি চিন্তা করলে ভুল করবেন।”
‘একক সিদ্ধান্তে চলতে গিয়ে লেজে-গোবরে’
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে গঠিত। কাজেই এই সরকারের কাছে জনগণের অনেক প্রত্যাশা এবং এই সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে, জনগণের যে প্রত্যাশা—সেই প্রত্যাশা পূরণের পথে এই সরকারকে এগোতে হবে। এইটা আমরা বলেছি।
“এই সরকারটা নির্দলীয় সরকার, অরাজনৈতিক সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কাজেই এই দেশের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং এক সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি—সেটা গড়ে তোলার জন্যে এই সরকার একা পারবে না। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম, সরকার অভ্যুত্থানের পরই রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় না নিয়ে, তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা, পরামর্শ না করে, এককভাবে তারা এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে একটা লেজে-গোবরে অবস্থা তারা তৈরি করেছে।”
ফিরোজ বলেন, “এই সরকার যখন খুব বিপদে পড়ে, আর সামলাতে পারছে না, টালমাটাল অবস্থা এবং মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে—তখন রাজনৈতিক দলগুলোকে, আমাদেরকে ডেকে এখানে দেখায় যে, ‘এরা সবাই আমার সাথে আছে’। আমরা এই সরকারকে সমর্থন করেছি ঠিক, কিন্তু অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী কোনো কাজ করলে আমরা এই সরকারকে সমর্থন করব না, তার বিরোধিতা করব, সমালোচনা করব। আর অভ্যুত্থানের চেতনার আলোকে যদি কাজ করে, আমরা সেটাকে সমর্থন করব—সেটা আমরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি।”
তিনি বলেন, “একটা দল—সেটা নতুন দল, এখনো নিবন্ধিত দল না। ছাত্ররা এই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে। আমাদের সম্মান আছে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আছে, ভালোবাসা আছে, স্নেহ আছে। কিন্তু তার মানে এই না, অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈষম্য তৈরি করে একটা দলকে সরকার পৃষ্ঠপোষকতা দেবে।”
বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “এখানে আমাদের রেদোয়ান ভাই (এলডিপি মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ) আছেন, উনি বলেছেন ওখানে—কোনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীও তো এই ধরনের প্রোটোকল পায় না। যারা এই নতুন দল, তাদেরকে যেভাবে প্রটোকল দেওয়া হচ্ছে। এখন অন্য কোনো রাজনৈতিক দল সভা-সমাবেশ করতে গেলে, তাদেরকে কি তারা ওই এপিসি দিয়ে সেনাবাহিনী, তাদেরকে দিয়ে...
“ইতিমধ্যে এই যে সোশাল মিডিয়া, পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে—তাদের এই গোপালগঞ্জের প্রোগ্রাম করতে, কক্সবাজারের প্রোগ্রাম করতে সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রের ৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর জন্যে ২১ লাখ, রাষ্ট্রপতির জন্যে সেখানে ২৫-৩০ লক্ষ টাকা খরচ হয়, তাদের পেছনে ৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। রাষ্ট্রের এবং জনগণের টাকা এভাবে খরচ করার অধিকার এই সরকারকে কেউ দেয় নাই। আমরা সেটার বিরোধিতা করছি এবং তারা পক্ষপাতমূলক যে আচরণ করছে—সেই আচরণেরও আমরা নিন্দা জানিয়েছি।”

‘পক্ষপাতদুষ্ট’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “আমাদের দিক থেকে যে কথাটা আমরা শুরুতে স্পষ্ট করে বলেছি, আপনি গতকাল থেকে এবং আজকে যে অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে মতবিনিময় করছেন... সরকার প্রধানের উচিত ছিল লন্ডন থেকে ফেরার পরপরই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক করা, সবাইকে আস্থার মধ্যে নেওয়া।
“আমরা বিচার সংস্কার এবং নির্বাচনের ব্যাপারে বলেছি, আপনার উচিত ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা আস্থা-ভরসার সম্পর্কটা তৈরি করা। সেই কাজটা বাস্তবে সরকার করতে ব্যর্থ হয়েছে। যতদিন যাচ্ছে, দেশটায় অনাকাঙ্ক্ষিত একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে এবং আমরা লক্ষ্য করেছি, এই সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসে—আমরা বলেছি—আপনি সবচেয়ে জননন্দিত রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে সমর্থিত সরকার হলেও মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সবচেয়ে দুর্বল সরকার। যে কারণে দেশে একটা আধা-নৈরাজ্যিক অবস্থা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে।”
তিনি বলেন, “সরকারের উচিত হবে—সরকার মাঝেমধ্যে তারা যখন সংকটে পড়ে, সেভাবে না ডেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে নৈমিত্তিকভাবে বিচার, সংস্কার, বিশেষ করে নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের যে অঙ্গীকার—তারা যেভাবে নির্বাচনটা একটা অবাধ, নিরপেক্ষ, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করার জন্য—রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সরকারের এনগেজমেন্টটা আরো বৃদ্ধি করা দরকার। এটাকে আরো বাড়িয়ে তোলা দরকার।”
সাইফুল হক বলেন, “আমরা বলেছি যে, আপনাদের নানা দিক থেকে আমরা পক্ষপাতদুষ্টতা দেখছি, আপনাদেরকে পক্ষপাতদুষ্টতা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন দলকে দেখার ক্ষেত্রে, মূল্যায়নের ক্ষেত্রে, আপনারা সেখানে কোনো মানদণ্ড অবলম্বন করছেন না।
“আমরা শেষে বলেছি, আমরা আপনাদেরকে সহযোগিতা করতে চাই। কিন্তু সেই সহযোগিতার ক্ষেত্রে আগামীতে, আমরা যেভাবে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতি গড়ে উঠেছিল, রাজনৈতিক কারণে নানা প্রশ্নে বিতর্ক থাকবে, আলোচনা থাকবে, মতপার্থক্য থাকবে। কিন্তু স্বাধীনতার, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে, বিচার সংস্কার, নির্বাচনের প্রশ্নে নিশ্চয় আমাদের মধ্যে একটা গণঐক্য আমরা তৈরি করতে চাই। সে ব্যাপারে সরকার একটা বিশেষ যত্নবান, উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবেন বলে আমরা আশা করি।”
‘মানুষ বিশ্বাস রাখতে পারছে না’
এলডিপি মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ বলেন, “আমাদের দেশে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনা করতে গিয়ে, সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি যে—আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে একতা এবং ঐক্য ছিল, বেশ কিছু ক্ষেত্রে আজকে এই একতা এবং ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে।
“বিশেষ করে বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বলে বিবেচিত সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভিন্ন রকম কাদা ছোড়াছুড়ি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের সময় বা পূর্বে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য ছিল, আজকে সেই ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে।
“তবে আমাদের দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে এবং দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে, এই দেশের সকল রাজনৈতিক সংগঠন যে কোনো সময় ঐক্যবদ্ধ হবে, সেই ব্যাপারে নিঃসন্দেহে আমরা আমাদের মত প্রকাশ করেছি।”
তিনি বলেন, “এই সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে, তারা এটা মানুষের সামনে ধরে রাখতে পারেনি। তাদের মধ্যে নানা রকম কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতে মানুষ আজকে তাদের উপর আর সেই বিশ্বাস রাখতে পারছে না। তারা এই দেশের সবচেয়ে দুর্বল সরকারের একটা পরিচয় দিয়েছে। এবং দুর্বল সরকার পরিচয় দেওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হল—তারা সঠিক সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
“তো সঠিক সময়ে যাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেই জন্য সরকারকে বেগবান হওয়ার এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে যত্নবান হওয়ার জন্য আমরা সরকারকে অনুরোধ করেছি।”
‘মানুষের নিরাপত্তায় আরো মনোযোগ দরকার’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, “আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, এই অন্তর্বর্তী সরকারকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া, সেইদিকে আরো অনেক বেশি মনোযোগী হতে হবে।
“আমরা বলেছি, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, সেখানে হতাহতদের পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করতে হবে। এবং সেই তালিকা যাতে মানুষ ভরসা করতে পারে, সেভাবেই স্পষ্ট করা দরকার।”
তিনি বলেন, “প্রত্যেকের যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং যাদের চিকিৎসা, সেটা যাতে নিশ্চিত হয়, সে ব্যাপারে তাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং এ বিষয়ে কোনো গাফিলতি ছিল কিনা, এই বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার পেছনে সেইসব প্রশ্ন, স্বচ্ছতার সাথে তদন্ত করে দেখতে হবে এবং জনমনে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে।”
সাম্প্রতিক ক্ষোভ বিক্ষোভের প্রসঙ্গ ধরে সাকি বলেন, “যেভাবে আমরা সচিবালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা বিক্ষোভ দেখছি, আমরা বিক্ষোভের প্রতি সংযম প্রদর্শন এবং ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকারের কাছে জানিয়েছি। আমরা বলেছি, মানুষের বিক্ষোভ থাকবে এবং সেই বিক্ষোভ প্রকাশের যে অধিকার—সেটা থাকতে হবে। কাজেই ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।
“তবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, বিশেষভাবে সচিবালয়ের মত একটা প্রতিষ্ঠান, সেটার নিরাপত্তা কীভাবে রক্ষিত হবে, সে বিষয়ে সরকার তার নীতিমালা করবে। কতটুকুর মধ্যে আসলে সভা-সমাবেশ করা যাবে, এইসব বিষয়ে তারা নতুন করে নীতিমালা ঘোষণা করতে পারে। এই সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য।”
অন্তর্বর্তী সরকার তাদের মূল যে কাজের কথা বলে আসছে, সেসব কাজের কথা মনে করিয়ে দিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী বলেন, “বাংলাদেশে যে বিচার, সংস্কার এবং নির্বাচনের ঐতিহাসিক দায়িত্ব এই সরকারের উপর আছে—সেই বিচারের প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত দেখতে চায়, আরো দৃশ্যমান দেখতে চায় (মানুষ)।”
তিনি বলেন, “আমরা মনে করি যে, প্রতিমাসে অন্তত এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে নিয়মিত বৈঠক করা দরকার। কেননা ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে, নির্বাচনের পরিবেশ এবং সমস্ত কিছু এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংহতি এবং তাদের মধ্যে ন্যূনতম যাকে বলে রুলস অব দ্য গেইম এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ক্ষেত্রে একমত হওয়া—এইটা সরকারকেই ফ্যাসিলিটেট করতে হবে।
“সরকারের এখানে দায়িত্বের জায়গা আছে। আশা করি তারা এটা পালন করবেন এবং সেইভাবেই আমরা পরবর্তীকালে কার্যক্রমকে বিচার করব।”
‘স্বৈরাচারের দোসর রেখে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না’
নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার বলেন, “আমরা বলেছি যে আগামী নির্বাচনের একটা সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করে, সেভাবে যাতে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে, সেই পথে আসুন, আমরা সবাই এগিয়ে যাই।
“স্বৈরাচারের দোসর যারা প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনে আছে, তাদেরকে রেখে আপনি আগামী দিনের এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করতে পারবেন না। তিনি আমাদের সাথে একমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, দেশের যে সংকটকাল, আমাদের সাথে যেভাবে কথা বলার জন্য আজকে তিনি কথা বলেছেন, আগামীতেও, মানে কিছুদিন পরপর তিনি রাজনৈতিক দলগুলির সাথে কথা বলবেন। কথা বলে তাদের পরামর্শ নিয়ে তিনি আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত করবেন। যেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, মানে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে।”
‘শৃঙ্খলা ফেরেনি’
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, “এই অভ্যুত্থানের পরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সবগুলো প্রতিষ্ঠান বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়েছিল। তার কাছে আমরা বলেছি যে বিশেষ করে জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থা পুরো ভেঙে পড়েছিল।
“এই ১১ মাসে আপনি কথা দেওয়ার পরেও, চেষ্টা করার পরেও, সারা বাংলাদেশে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেন নাই।”
‘বৈষম্য করার প্রবণতা’
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বলেন, “প্রথমেই তাদেরকে বলেছি, আপনাদের মধ্যে বৈষম্য করার প্রবণতা আছে। আপনারা প্রথম চারটিকে ডেকেছেন, বড় দল ঘোষণা দিয়েছেন। তারপর যখন প্রকাশিত হওয়ার পরে, যখন সমালোচনা হচ্ছে, তখন আপনারা আমাদের ডেকেছেন।
“তারপর আমাদের এই বৈঠকেও কিন্তু সবাইকে ডাকা হয় নাই। এটাই আমি বলেছি যে, আপনাদেরকে সব রাজনৈতিক দলকে ডাকা প্রয়োজন। তাহলেই বুঝবেন যে আপনারা সমানে সমান আচরণ করছেন, বৈষম্য করছেন না।”
সরকার ‘এনসিপির দিকে হেলে’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর বলেন, “আমরা সহ সমস্ত রাজনৈতিক দলই সরকারের এই বৈষম্যমূলক আচরণ এবং পক্ষপাতের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিবাদ দেখিয়েছে। কারণ ধরেন, বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। তাদের এখনো রাজনীতির মাঠে একটা শক্ত অবস্থান আছে। সেই ক্রাইটেরিয়ায় বিএনপির মত একটা বড় দলের সাথে সরকার আলাপ করতে পারে।
“কোন ইস্যুতে সে চারটা দলকে কোন ক্রাইটেরিয়ায় বড় দল কিংবা প্রধান দল হিসেবে তারা সিলেক্ট করল? এবং তার মধ্যে একটা দলে তো নিবন্ধনই নাই, সদ্য গঠিত হয়েছে। এবং এই অভিযোগটা মোটামুটি বৈঠকে যারা উত্থাপন করেছেন, বাকিরাও সমর্থন করেছেন যে সরকারের কর্মকাণ্ডে এবং ভূমিকায় দেখা গেছে তারা এনসিপির প্রতি একটু পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা পালন করছে।”
নূর বলেন, “এরকম একটা অভ্যুত্থানের পরে এত বিপুল জনপ্রিয় এবং জনসমর্থিত সরকার যদি কোনো দিকে হেলে যায়, তাহলে তাদের প্রতি জনগণের সমর্থন কিন্তু সরে যাবে।”