আমাদের কালের কথা। যে বছর পরীক্ষায় হৈমন্তীর চরিত্র বিশ্লেষণ করতে হতো, ঠিক তার পরের বছর কার চরিত্র বিশ্লেষণ করতে হবে সবাই বুঝে ফেলতাম। প্রশ্ন নকল হওয়ার ঐতিহাসিক সত্য মাথায় রেখেই এই লেখা। শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে এ কথাও বুঝেছি, অনেক শিক্ষক রয়েছেন যাঁদের প্রণয়ন করা বিগত বছরগুলোর প্রশ্ন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১২টি প্রশ্ন তাঁরা তাঁদের শিক্ষকতার দীর্ঘ সময়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে করেছেন। শিক্ষকদের এই কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে এ কথাও অনুমান করা যায়, সামনের দিনগুলোতেও তাঁরা এই ধারা অব্যাহত রাখবেন। অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, অনেক প্রশিক্ষণ বা বৈঠকে নতুন কিছু শেখানোর আয়োজন থাকলেও অনীহা দেখান এই ধারার পণ্ডিতেরা।

অবশ্য অন্যভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, ছোটবেলা থেকেই শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর একটি মিথ্যার প্রচলন দেখে আসছি আমরা। আর এই মিথ্যাচারকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন আমাদের কোনো কোনো শিক্ষক। যেমন ধরা যাক, ক্লাসে কোনো একটি বিষয় একজন শিক্ষক তার মতো করে বুঝিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রশ্ন করলেন, ‘বুঝেছ তোমরা?’ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া শিক্ষার্থীরাও উত্তর দেয়, ‘জি স্যার’। এই ‘জি স্যার’, বলার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে মিথ্যাচার। যে মিথ্যাচারকে উৎসাহ দেন শিক্ষকেরা।

এই গণহারে ‘জি স্যার’ বলার মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা কী বার্তা দেয় শিক্ষকদের? তারা যেটি বলতে চায় সেটি হলো, তারা আসলে বোঝেনি যে তারা কী বোঝেনি। অথবা, বুঝেছে এ কথা প্রকাশ করে অন্যদের সামনে নিজের মূর্খতা জাহির করার কী প্রয়োজন। অথবা এমনও হতে পারে, বুঝিনি বললে স্যার যদি ফের বোঝাতে শুরু করেন!

শিশু প্রশ্ন করে করেই বড় হতে থাকে, বড় হয় তার জানার পরিধিও। তবে কেন পড়াতে এনে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করার স্পৃহা আটকে দিই আমরা? শিক্ষার্থীরা আবার আমাদের নতুন কোনো প্রশ্ন দিয়ে আটকে দেয় কি না, এই ভয়ে?

বুঝেশুনে হোক বা না বুঝে হোক, প্রশ্ন করার দরজা আমরা নিজেরাই বন্ধ রাখার দর্শন চালু রেখেছি এভাবে। এ ধরনের মানুষই শিক্ষক হোন বা কোনো কার্যালয়ে শিক্ষাকর্তা হিসেবেই অধিষ্ঠিত হোন, তাঁরা কিন্তু এ ধরনের ‘মানসিকতা’ দ্বারাই পরিচালিত হবেন। শিক্ষার জন্য উপযোগী পরিবেশ প্রয়োজন। এই উপযোগী পরিবেশ বলতে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রশ্ন করার পরিবেশ ও প্রশ্ন করার যোগ্যতা এবং প্রশ্নোত্তর চলমান রাখার সংস্কৃতিকেই আমরা বুঝি।

নতুন প্রশ্ন ছাড়া নতুন জ্ঞানের সন্ধান মেলা কঠিন; সেটি প্রাচীনকাল থেকেই একইভাবে কার্যকর।

আপেল সারা জীবনই মাটিতে পড়েছে, কোনো দিনই আকাশে উড়ে যায়নি। কেন আপেলটি মাটিতে পড়ল? এই প্রশ্ন ছাড়া আজকের পৃথিবীর বহু প্রশ্নই অমীমাংসিত থেকে যেত। অথচ এমন প্রশ্ন আমাদের শ্রেণিকক্ষে পেলে আমরা হয়তো অনেকেই ওই শিক্ষার্থীকে ‘স্টুপিড’ প্রশ্নের দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতাম। প্রশ্ন করার যোগ্যতা নিয়ে নানা ধরনের তথ্য ও গবেষণা প্রচলিত রয়েছে শিক্ষা ক্ষেত্রে। আমাদের দেশেও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সঠিক সময়ে সঠিক প্রশ্ন করা নিয়ে নানান ধরনের সবক দেওয়া হয়। কখনো কখনো আমরা প্রশ্নাতীতভাবে সেই পথে পা বাড়াই, তাতে ফলাফল যা-ই হোক।

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষিত বেকার তৈরিতে আমাদের অবস্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয় হয়েছে বলে খবরে এসেছে। তবু আমাদের টনক নড়েছে বলে মনে হয় না। আজকের পৃথিবীতে সকালে কেনা মুঠোফোনটি বিকেলে পুরোনো হয়ে যায়। চার বছর ধরে যা শিখি, তার প্রথম দিকের অনেক কিছুই অকার্যকর হতে পারে। অথচ এসব বিষয় নিয়ে আমাদের প্রশ্ন কোথায়?

আসলেই কি চার বছর মেয়াদি অনার্স কোর্স দরকার আছে কর্মযোগ্য জনগোষ্ঠী তৈরিতে? নাকি এর অর্ধেক সময়েই দ্রুতগতিসম্পন্ন ও কর্মক্ষম স্নাতক তৈরি করা সম্ভব? তখন হয়তো বেঁচে যাবে জীবনের মূল্যবান সময়। অন্যদিকে সদ্য লব্ধ জ্ঞান নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবেন তরুণেরা।

নিজের হাতে থাকা মুঠোফোনের দিকে তাকান ও মনে মনে ভাবুন আপনি এই ডিভাইসটির কাছে কী কী চান? স্টোরেজ, স্পিড না অন্য কিছু। এ না হয় পলিসি পর্যায়ে চিন্তাভাবনা ও প্রশ্ন। এবার যদি প্রশ্ন করি, চলচ্চিত্রের প্রথম দৃশ্য দেখেই যদি বুঝতে পারি পরবর্তীতে কী ঘটবে, সেই সিনেমা দেখায় কতটুকু আগ্রহ দেখাব আমরা?

কোনো শিক্ষার্থী যখন বুঝে ফেলে, পরীক্ষায় কী প্রশ্ন আসবে তখন জ্ঞানের সাগরে ডুবে থেকে জ্ঞান অর্জন করার আগ্রহ সে কেন দেখাবে? বরং সহজ পথে সে ওই প্রশ্নগুলো মুখস্থ করবে অথবা টুকে নিয়ে আসবে কাগজে—দুটোই তখন নকলের পর্যায়ে গড়াবে।

আমরা মনে করি, পরীক্ষার হলে কড়া গার্ড দিয়ে নকল বন্ধের আগে আমাদের—শিক্ষকদের নকল প্রশ্ন প্রণয়ন বন্ধ করা জরুরি। সর্বোপরি, শিক্ষার্থীদের মাঝে উৎসাহ দিতে হবে নতুন প্রশ্ন মোকাবিলা করতে হয় কীভাবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা যদি প্রশ্ন করতে শেখে, নতুন প্রশ্ন মোকাবিলা করতে শেখে, তবেই তাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসবে আগামী দিনের দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও সৃজনশীল কর্মিবাহিনী—বিশ্ববাজারে যাদের চাহিদা সর্বাগ্রে।

লেখক: ডিরেক্টর, স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স ও সহযোগী অধ্যাপক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews