ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে হলে ছাত্রলীগের ‘গেস্টরুম আদালত’

ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের আবাসিক হলে প্রতিরাতে গেস্টরুম দরবার বসে৷ অভিযোগ, এসব ‘ গেস্টরুম আদালতের’ নেতৃত্বে থাকেন ছাত্রলীগের হল শাখার নেতারা৷ তারা শাস্তি ঘোষণা করে কার্যকরও করেন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মনে করেন, সাধারণ ছাত্র, যারা অবৈধভাবে হলে থাকে, তারা গেস্টরুম কালচারের সুযোগ করে দেয়৷

সর্বশেষ মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের চার শিক্ষার্থী গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ তাদের ‘শিবির' বলে পেটানো হয়৷ পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা৷ পুলিশ তাদের ওই তিন ছাত্রের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের প্রমাণ না পেয়ে বুধবার তাদের হাসপাতালে পাঠায়৷

এই ঘটনায় তিনজন হাসপাতাল ছেড়ে গেলেও ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মুকিমুল হক চৌধুরী বিচার চেয়ে বুধবারই রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নেন৷ কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেলে সেই জায়গা ছেড়ে যান৷

এ প্রসঙ্গে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘‘তিনজন বুধবার বাসায় চলে গেছে৷ আর মুকিমুলের বাবা এই ঘটনা শুনে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে-ও অবস্থান ছেড়ে বাসায় চলে গেছে৷ সে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছে৷'' তবে প্রক্টর অধ্যাপক ড এ কে এম গোলাম রব্বানী দাবি করেছেন, তাদের হলে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে৷ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ মুকিমুল হক চৌধুরী ঘটনার পর সাংবাদিকদের জাানান, মঙ্গলাবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আনোয়ার হোসাইন ফোন দিয়ে তাকে ডেকে নেন৷

‘গেস্টরুম আদালত' :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম কালচারের নামে ছাত্রলীগের এই নিজস্ব ‘বিচার আদালত' নতুন কিছু নয়৷ গত বছরের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে এই গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র সিদ্দিক ফারুক৷ তাকে তিনদিনের জন্য হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল৷ তিনি তখন প্রথম বর্ষে পড়তেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ এনেছিল যে, আমি বড় ভাইদের সালাম দেই না৷ আসলে তাদের কথামতো আমি সব কাজ না করায় তারা ওই মিথ্যা অভিযোগ এনে আমাকে শাস্তি দিয়েছিল৷ এমনকি তাদের নির্দেশে যখন আমি হল ছেড়ে যাই, তখনো তারা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘প্রথম বর্ষের ছাত্ররাই এর শিকার হয় বেশি৷ তাদের বিভিন্ন দলীয় কাজ, মিছিল, মিটিং, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের প্রটোকলে ব্যবহার করা হয়৷ তারা যাতে এসব কাজ এড়িয়ে না যেতে পারে তাই তাদের গেস্টরুম কালচারের মাধ্যমে দমিয়ে রাখা হয়৷ ভয় দেখানো হয়৷ কেউ প্রতিবাদী হলে তাকে শারীরিক শাস্তিসহ নানা ধরনের শাস্তি দেয়া হয়৷''

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্র মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘হল থেকে বের করে দেয়া ছাড়াও নানা ধরনের শাস্তি আছে৷ যেমন শীতের রাতে খালি গায়ে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরতে হবে৷ পুরো রাত হলের বাইরে থাকতে হবে, তবে অন্য কোনো হলে যাওয়া যাবে না৷ হাতিরঝিলে গিয়ে রাতে ছয় ঘণ্টা বসে থাকতে হবে৷ এসবের আবার সেলফি তুলে এনে বড় ভাইদের প্রমাণ দিতে হবে৷''

চূড়ান্ত শাস্তি শারীরিক নির্যাতন বলেও জানান তিনি৷ হকিস্টিক, লাঠি ইত্যাদি দিয়ে পেটানো হয়৷ কানধরে ওঠবস করানো হয়৷ এইসব নির্যাতনের সময় প্রথমেই ‘তোরা শিবির' বলে ভয় দেখানো হয় বলে জানান মিজানুর৷ মিজানুর আরো বলেন, ‘‘হলের গেস্টরুমে এক সঙ্গে ৪০-৫০ জনকে ডেকে নেয়া হয়৷ ছাত্রলীগের বড় ভাইরা সোফায় বসে থাকেন এবং তাদের সামনে হাত জোড় করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়৷ ছাত্রদের দুর্বল করার জন্য প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়৷ আর তারা যা বলবেন, তাতে সায় দিয়ে জ্বী ভাই, জ্বী ভাই বলতে হয়৷ কেউ বিরোধিতা করলেই শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন৷ অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়৷ এগুলো সইতে না পেরে অনেক ছাত্র হল ছেড়ে যেতে বাধ্য হন৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘নির্যাতনের ঘটনা জানলেও বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয় না৷''

এই ‘গেস্টরুম আদালত' নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন দাবি করেন ছাত্রলীগে সাংগঠনিকভাবে কোনো গেস্টরুম কালচার বলে কিছু নেই৷ তিনি বলেন, ‘‘তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সার্বিক নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি আছে৷ এটির সাথে সুনির্দিষ্ট কোনো ছাত্র সংগঠন জড়িত বিষয়টি এমন নয়৷'' তবে তিনি বলেন, ‘‘ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরদের সঙ্গে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের সমস্যা, তাদের ভাবনা, রাজনৈতিক ভাবনা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে৷'' তার মতে, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকটের সমাধান হলে, গণরুম না থাকলে এই সমস্যা দূর হয়ে যাবে৷'' 

একই প্রসঙ্গে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূর বলেন, ‘‘যখন যে দল সরকারে ছিল তারাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে এই গেস্টরুম কালাচার চালায়৷ আগে যেমন এটা ক্ষমতাসীনরা ৬০ ভাগ, বিরোধীরা ৪০ ভাগ করত৷ এখন পুরোটাই ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে৷ ডাকসু ভিপি হয়ে আমি হলে থাকতে পারি না৷ তাহলে বুঝতে পারছেন পরিস্থিতি৷ আর এটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেও দূর হবে না৷ কারণ, এখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বিষয় আছে৷ সরকারকে চাইতে হবে৷''

‘সাধারণ ছাত্ররা সুযোগ করে দেয়'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড এ কে এম গোলাম রব্বানী এই গেস্টরুম কালচারের জন্য সাধারণ ছাত্রদেরও দায়ী করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কিছু অপকালচার আছে, সেটা সত্য৷ এটা সবারই নলেজে আছে৷ যখন যে সুযোগ পায় সে এটা করার চেষ্টা করে৷ আর সাধারণ ছাত্ররা সেটি করার সুযোগ করে দেয়৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে যে থাকবে শুরু থেকেই সে বৈধতা নিয়ে থাকবে৷ এই বৈধতা থাকে না বলেই তারা একটি পরিস্থিতির শিকার হয়৷ এজন্যই আমরা বলেছি যে, কেউ অধৈধভাবে হলে উঠবে না৷ কাউকে অবৈধভাবে রাখবে না৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘কোথায় অভিযোগ করতে হবে ছাত্ররা যে তা জানে না, তা নয়৷ তারা জেনেও নানা কারণে অভিযোগ করে না৷'' -ডয়েচেভেলে



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews