“আগে হাতে বিশ, পঞ্চাশ টাকা এলেই বোন বা বান্ধবীরা মিলে ছুটতাম সিনেমা হলে, রাজমনিতেই বেশি গেছি, এখনতো সেই হলই নেই। অন্য যে হলগুলো আছে, পরিবেশ যাওয়ার মত না,”আক্ষেপ করে বলছিলেন ঢাকার বাসাবোর বাসিন্দা নাসরিন হোসেন মিতা।

তিনি গ্লিটজকে বলেন, “একবার একটা হলে গিয়ে দেখি চেয়ার ভাঙা, সাউন্ড সিস্টেম ভালো না। আশেপাশে দর্শকরা যারা ছিলেন, তাদের সঙ্গে বসে পুরো সিনেমা দেখা যায় না। সিনেমা অর্ধেকের কম দেখে বের হয়ে আসি।”

নীলক্ষেতের বলাকা হলে একসময় নিয়মিত সিনেমা দেখা মির্জা রাশেদুল হকের কথায়– “সিনেমা হল তো শেষ।”

হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “সিনেপ্লেক্স হয়েছে, কিন্তু সেগুলো সিনেমা হলের জায়গা নিয়েছে বলে আমার মনে হয় না।”

ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের এই বাসিন্দা বললেন, নব্বই দশকে ছাত্রজীবনে প্রেক্ষাগৃহে ঈদ বা অন্য সময়েও যেভাবে সিনেমা উপভোগ করতেন, সেই আনন্দ এখন শুধুই স্মৃতি।

“এখন শুনি শুধু ঈদের সময় নাকি হল চলে, অনেক হল নাকি ভেঙে পড়ছে। তাহলে সিনেমা চলবে কোথায় বুঝি না।”

ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের প্রেক্ষাগৃহগুলোর হালচাল জানতে মাঠে নেমে যে চিত্র পাওয়া গেল, তা কেবলই হতাশার।

পরিবেশক, প্রযোজকদের ভাষ্য, দেশের সিনেমা হলগুলোর অধিকাংশই আর টিকে নেই, যে কটি আছে তাও বছরের বেশিরভাগ সময়ই ফাঁকা পড়ে থাকে। কারণ, বড় বাজেটের আলোচিত সিনেমাগুলো কেবল দুই ঈদে মুক্তি পায়, আর তখনই দর্শক সমাগমে জমজমাট চেহারা ফিরে পায় অল্প কয়েক দিনের জন্য। সিনেমা হল বেঁচে আছে কেবল ঈদ ঘিরে।

বছরের বাকি সময়ে দর্শকসংকটে হলের খরচ তুলতেই হিমশিম খান হল মালিকরা। অধিকাংশ হলেই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নেই, নেই প্রেক্ষাগৃহ সংস্কারের দৃশ্যমান উদ্যোগও।

এই ঈদ নির্ভরতা, অব্যবস্থাপনা আর সংস্কারের অভাবে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে দেশের প্রেক্ষাগৃহ ব্যবসা।

চলচ্চিত্র পরিবেশকরা গ্লিটজকে বলেছেন, বর্তমানে দেশে চালু প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ১৪১টি। এর মধ্যে রয়েছে স্টার সিনেপ্লেক্সের ৭টি শাখা। তবে এটা সংখ্যা সত্যিকার প্রতিচ্ছবি নয়।

কারণ ঈদ ছাড়া সারা বছর ধরে চালু থাকে মাত্র ৬০টি হল। এর মধ্যে ৩০টির বেশি হলে চালানো হয় পুরনো সিনেমা। নব্বই দশকের ‘কাটপিস’ সিনেমা বা শাকিব খানের পুরনো ব্যবসাসফল সিনেমা বেশিরভাগ হলে চলে।

পরিবেশকদের হিসাব অনুযায়ী, বাকি প্রায় ৮১টি প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে কিছু বছরের বেশিরভাগ সময়ে বন্ধই থাকে। খোলা হয় কেবল ঈদের সিনেমা মুক্তি পেলে। এমন হলের সংখ্যা প্রায় ৩৯টি।

এছাড়া আরও ৪২টি প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া দেওয়া হয় সময় ও সিনেমার ধরণ বুঝে। অর্থাৎ হল মালিকদের অনেকেই এখন হলের তত্ত্বাবধানে নেই। তাদের হল বুকিং এজেন্টদের কাছে চুক্তিভিত্তিক লিজ দেওয়া হয় এক বা দুই মাসের জন্য। বড় বাজেটের বা তারকাসমৃদ্ধ সিনেমা এলে ভাড়া নিয়ে চলে হলগুলো।

এই হিসাব তুলে ধরে পরিবেশক এবং প্রযোজকরা বলছেন, দেশে সিনেমা হল ব্যবসা এখন প্রায় পুরোপুরি ‘ঈদ নির্ভর’। বছরের বাকি সময় নতুন সিনেমা মুক্তি পেলেও সিনেপ্লেক্স ছাড়া তাদের হল জোটে সর্বোচ্চ ২৫-৩০টি।

‘হলের দরকার সিনেমা, সিনেমাওয়ালাদের দরকার হল’

চলচ্চিত্র পরিবেশক হিসেবে চার দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন মো. শহিদুল মিয়া, চলচ্চিত্রাঙ্গনে যিনি ‘মাস্টার’ নামে পরিচিত।

সারা বছর যেখানে ৬০টি সিনেমা হল খোলা থাকে, সেখানে ঈদের সময় এত হল হঠাৎ চালু করার প্রক্রিয়া জানতে চাইলে গ্লিটজকে তিনি বলেছেন, এসব হল আগে ভালো ছিল, কিন্তু এখন বেশিরভাগগুলোতেই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি।

“এই হলগুলো বছরের বাকি সময় বন্ধ থাকে বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা হয়। ঈদের ব্যবসা ধরতে বা কেবল ঈদের ভিড় সামলাতেই সাময়িক খোলা হয়।”

কারণ হিসেবে ব্যয় নির্বাহের বিষয়টি তুলে এই পরিবেশক বলেন, একটা হল চালু করতে যে খরচ হয়, ঈদের পর সেই খরচ ওঠে না। তাই অনেক হল ঈদের সময় এক-দুই মাসের জন্য ভাড়া নিয়ে চালানো হয়।

এমনও হলের উদাহরণও এই পরিবেশক দিয়েছেন, যেখানে মাদুর বিছিয়ে, সাময়িকভাবে চেয়ার বসিয়ে, সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া করে আনা হয় সিনেমা দেখানোর জন্য।

এসব হলের উন্নয়নের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় কী না জানতে চাইলে শহিদুল মিয়া বলেন, “সংকট শুধু হলেই নয়, গোটা চলচ্চিত্রশিল্প জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সিনেমা এক-দুই শিল্পীকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আগের প্রযোজকরা সিনেমা বানান না, আর নতুন যারা আসে তারা একটা-দুটো সিনেমা বানিয়ে লস খেয়ে চলে যায়।

“দেশে ভালো টেকনিশিয়ান নেই, সিনেমার কাজ খরচ বেশি দিয়ে করে আনতে হয় ভারত থেকে। সিনেমা অফিস ছিল আগে অনেক, এখন সব বন্ধ হয়ে গেছে। আগে প্রায় ৩০০ বুকিং এজেন্ট ছিল, এখন ২০ জনও নেই।”

এসব বাস্তবতায় সিনেমা বিক্রির ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে গেছে বলে মনে করেন এই পরিবেশক।

শহিদুল মিয়া বলেন, “হলের দরকার সিনেমা, আর সিনেমাওয়ালাদের দরকার হল। অথচ দুপক্ষই এখন দুর্বল। সিনেমা বানাতে এখন অনেক খরচ, কিন্তু সেই খরচ তুলতে হলে তো হলে দর্শক লাগবে। এখন হলে সিনেমা চালালেও টাকা ওঠে না। তাই বেশিরভাগ হলই বন্ধ রাখা হয়।”

‘সিনেমা হয় ঈদের জন্য, সারা বছরের জন্য নয়’ এমনটাই মনে করেন আরেক পরিবেশক রুহুল আমীন।

তিনি বলেন, “এখনকার প্রযোজক ও নির্মাতারা শুধুই ঈদকেন্দ্রিক সিনেমা বানাচ্ছেন, মৌসুমি রিলিজের মতই। ঈদ ছাড়া হলে চলার মত সিনেমা থাকে না। ঈদে একসঙ্গে ১০-১১টি সিনেমা এলেও ব্যবসা করে এক থেকে দুটি। এই সিনেমাগুলো যদি ঈদের ভিড় এড়িয়ে বছরের অন্য সময়ে আসত, তাহলে হল খোলা রাখা যেত।”

বছরের বাকি সময় মন্দা দশা থাকায় মালিকরা কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুৎ বিল বা ভ্যাট-ট্যাক্সের খরচ তুলতে না পেরে হল বন্ধ রাখেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

প্রেক্ষাগৃহে দর্শক কম, সংস্কারেও নেই আগ্রহ

দেশের ৭০ শতাংশ হলের অবস্থা করুণ, বেশিরভাগরই সংস্কার নেই। কোথাও ভাঙা চেয়ার, কোথাও নষ্ট ফ্যান, কোথাও আবার বৃষ্টির পানিতে তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা।

রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে ময়মনসিহ, রংপুর, বরিশাল কিংবা সিলেট- সর্বত্রই একই দৃশ্য।

অনেক হল ইতোমধ্যে গুদামঘর, মার্কেট কিংবা বিপণিবিতানে রূপান্তরিত হয়েছে। ঈদের এক সপ্তাহে রাজধানী ও বিভিন্ন জেলা শহরের কয়েকটি সিনেমা হলে ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।

ঢাকার ফার্মগেইট এলাকায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুটি সিনেমা হল ‘আনন্দ’ ও ‘ছন্দ’।

এক সময়ের জমজমাট এই প্রেক্ষাগৃহগুলো এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেঁচে আছে। সংস্কার বা আধুনিকায়নের ছোঁয়া তো দূরস্থান, বেশিরভাগ আসনই ভাঙা, ভিতরের ফ্যানগুলোও নষ্ট।

ফার্মগেইটের আনন্দ সিনেমা হলের ভেতরের দৃশ্য। 

আনন্দ সিনেমা হলের মোট আসন ১২০০ হলেও ভেতরে ঢুকে দেখা যায় পাঁচশর বেশি চেয়ার ভাঙা। বাইরে লেখা রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, তবে হলের ভেতরে শুধু ফ্যান, সেগুলোর বেশিরভাগ আবার অকেজো।

চেয়ার ভেঙে পড়ে আছে পর্দার ঠিক সামনেই। ‘রিয়ার’ আসনের বেশিরভাগই বসার অনুপযোগী। ‘ডিসিতে’ প্রবেশ করে দেখা যায় কিছু আসন ভালো অবস্থায় আছে।

বিকেল ৩টার শোতে ‘অন্তরাত্মা’ সিনেমা দেখতে এসে হতাশ হয়ে বেরিয়ে যান দর্শক জাকির হোসেন। তার কথায়, “১০০ টাকা দিয়ে টিকেট কিনে ঢুকলাম, ভিতরে নোংরা, দুর্গন্ধ, গরম এভাবে সিনেমা দেখা যায় না।”

পাশের ‘ছন্দ’ সিনেমা হলে চলছে মোহাম্মদ হান্নান পরিচালিত ‘সাবধান’ সিনেমা। তবে এই হলের একেবারে বেহাল দশা।

হলের সিঁড়িতে পানি জমে থাকায় হাঁটাও কঠিন, পর্দার সামনের জায়গাতেও জমেছে পানি। ‘ডিসি’তে কিছু চেয়ার থাকলেও বসার উপযোগী ভালো চেয়ার ১০টির বেশি নেই।

হলের এই অবস্থা কেন–এ প্রশ্নে টিকেট বিক্রেতা মো. আবুল কালাম বলেন, “বিল্ডিং পুরনো, বৃষ্টি হলে নিচ থেকে পানি উঠে হাঁটু পানি জমে যায়। মালিক নেই, দেখার কেউ নেই, ঠিক করবে কে?”

দুই হলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা মো. মঞ্জু বলেন, “হলের অবস্থা নড়বড়ে, দর্শক হয় না। হলের মালিক তো কেউ নেই, সংস্কারের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই।”

ঢাকার ইংলিশ রোডের চিত্রামহল সিনেমা হল। 

একবছর আগে ভেঙে ফেলা হয়েছে পুরান ঢাকার ইংলিশ রোডের ‘চিত্রামহল’ হল। হলের বাইরে টিনের বেড়ায় লেখা রয়েছে ‘চিত্রামহল কমপ্লেক্স’। ভিতরে দেখা যায় ভাঙা ইট, টিন, কিছু পাইপ পড়ে রয়েছে।

হলের পাশের চায়ের দোকানি রশিদ বলেন, নতুন করে সিনেপ্লেক্স করা হবে। জুলাই আন্দোলনের পর কাজ আটকে আছে।

“নতুন করে কবে শুরু হবে জানি না। জায়গা এমনই খালি পড়ে আছে। মাঝে মধ্যে দারোয়ান আসে।”

হলের কাজ কবে শুরু হতে পারে জানতে হলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সাগরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।

জনসন রোডের ‘আজাদ’ সিনেমা হল। 

পাশেই জনসন রোডে আরেকটি হল ‘আজাদ’। ঈদের সপ্তাহখানেক আগে একদিন সেখানে গিয়ে ‘অন্তরাত্মা’ সিনেমা চলতে দেখা যায়। তখন বিকেল ৩টার শোতে রিয়ারে ৯ জন এবং ডিসিতে মাত্র এক জন দর্শক পাওয়া যায়।

হলের ব্যবস্থাপক মো. আলাউদ্দিন বলেন, “ঈদে (রোজার ঈদ) মোটামুটি ভালো চলেছে, ঈদের পর দর্শক হয় না। কিছুদিন আগে হলের কাজ করা হয়েছে, নতুন পর্দা লাগানো হয়েছে, সিলিংয়ের কাজ করা হয়েছে। নতুন সিট লাগানো হয়েছে। দর্শক উপযোগী করা হয়েছে। কিন্তু এই হল থেকে মালিকদের লাভ হয় না। পুরনো স্মৃতি ধরে রাখতেই হলটা রাখা।”

একই অবস্থা ঢাকার বাইরের হলগুলোরও।

ময়মনসিংহে এক সময় পাঁচটি সিনেমা হল ছিল। ‘অজন্তা’, ‘ছায়াবাণী’, ‘অলকা’, ‘পূরবী’ ও ‘সেনা অডিটোরিয়াম’। এখন টিকে আছে একমাত্র ‘ছায়াবাণী’।

তবে এই হলেও নেই পুরনো দিনের সেই জৌলুস।

সম্প্রতি ছায়াবাণী হলে গিয়ে দেখা যায়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলটির নিচতলায় আসনের নিচে পানি জমায় বসার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অনেক আসন ভেঙে হেলে পড়েছে।

প্রতিদিন পাঁচটি শো চালানো হলেও অনেক সময় দর্শকই হয় না, তাই বন্ধ রাখতে হয় শো।

ময়মনসিংহের ‘ছায়াবাণী’ হল।<br/><br/>

ছায়াবাণী হলের ব্যবস্থাপক রেজওয়ান কবির রাজু বলেন, “প্রতিটি শো চালাতে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়, কিন্তু দর্শক হয় ৫ থেকে ২০ জন। স্টাফ আছে ১২ জন। এই অবস্থা নিয়ে হল চালানো দুষ্কর।”

শহরের আরেক পুরনো হল ‘পূরবী’ ভাঙার কাজ চলছে। একসময় এই জনপ্রিয় হলের জায়গায় তৈরি করা হবে বহুতল ভবন।

রংপুর জেলায় একসময় ছিল ১২টি সিনেমা হল ছিল, এখন টিকে আছে মাত্র দুটি। সেগুলো হল ‘শাপলা টকিজ’ ও ‘আকাশ টকিজ’।

শাপলা টকিজের মালিক নজরুল ইসলাম মাসুমের মৃত্যুর পর তার ভাই মিন্টু মিয়া হলের দায়িত্ব নেন। কিন্তু ব্যবসা ভালো না হওয়ায় পরিবেশক ও প্রযোজক কামাল হোসেনের কাছে হল ভাড়া দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন হলের ব্যবস্থাপক শাহাবুদ্দিন।

দীর্ঘদিন বন্ধ থেকে তিন মাস আগে চালু হয়েছিল আকাশ টকিজ সিনেমা হল। তবে হলের অবস্থা বেশি ভালো নয়।

রংপুরের আকাশ টকিজ। 

আকাশ টকিজের ব্যবস্থাপক রকিবুল আজাদ বলেন, “অর্থাভাবে হলের সংস্কার হচ্ছে না। হলের বসার সিট, সাউন্ড সিস্টেম, ডেকোরেশন খুব ভালো অবস্থায় নেই। হল ঠিক করার জন্য সরকার থেকে ঋণ দেওয়ার কথা ছিল, সেটা আমরা পাইনি।”

এদিকে শহরের অন্য সিনেমা হল যেমন চায়না ‘টকিজ’, ‘নুর মহল’ ও ‘দরদী’ হল এখন গুদাম হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

বরিশালে একমাত্র চালু থাকা ‘অভিরুচি’ সিনেমা হলটিও ধুঁকছে দর্শক খরায়। প্রতিদিন গড়ে চার-পাঁচজন দর্শক হয়, কখনও কেউ না আসায় বাতিল হয় শো। এক সময়ের এক হাজার আসনের হলটিতে এখন মাত্র ২০০ আসন ব্যবহারযোগ্য, কর্মচারীও কমে এসেছে ৩৩ থেকে ৩ জনে।

হলের ব্যবস্থাপক রেজাউল কবির বলছেন, “বছরে মাত্র দুই ঈদের জন্য সিনেমা বানানো হয়, ঈদের পরে কী চালাব সেটা নিয়ে চিন্তায় থাকতে হয়। ভালো ও নিয়মিত সিনেমা মুক্তির অভাবেই হলগুলো টিকে থাকতে পারছে না।

“হল সংকটে সরকার বা সংশ্লিষ্টদের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। এরকম চলতে থাকলে চলচ্চিত্রশিল্প শেষ হয়ে যাবে।”

সিলেট নগরীতে একসময় ‘কাকলি’, ‘মনিকা’, ‘অবকাশ’, ‘দিলশাদ’, ‘নন্দিতা’, ‘লালকুঠি’, ‘রংমহল’, ‘জালালাবাদ সৈনিক’ ও ‘বিজিবি অডিটোরিয়াম’সহ নয়টির বেশি সিনেমা হল ছিল।

বর্তমানে টিকে আছে কেবল ‘নন্দিতা’ ও ‘বিজিবি অডিটোরিয়াম’। আর ‘দিলশাদ’ সিনেমা হলে ঝুলছে বিক্রির বিজ্ঞপ্তি।

এখন চালু থাকা নন্দিতা হলে দর্শক পাওয়া যায় মূলত ঈদে, বাকি সময় হল ফাঁকা থাকে বলে জানালেন হল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আকবর হোসেন রাজু।

একই কথা বললেন, আখালিয়া এলাকায় বিজিবি অডিটোরিয়াম হলের ব্যবস্থাপকও।

‘হল সংস্কারে প্রয়োজন সরকারি অনুদান’

বগুড়ার ঝংকার সিনেমা হলের মালিক মো. ঈশা খান বলেছেন, ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত তার হলটির অবস্থা এখন ভালো না, আর্থিক সংকটে আধুনিকায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন, “সিনেমার দর্শক আছে, কিন্তু পরিবেশ উন্নত করতে পারছি না বলে হল চলছে না।”

সরকার এক সময় হল সংস্কারের জন্য এক হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রকল্প চালু করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সেটা নেওয়া সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।

তার প্রস্তাব, “সরকার যদি প্রতিবছর পাঁচ থেকে দশটি সিনেমা হলে ৫০-৬০ লাখ টাকা অনুদান দেয় এবং কিছু শর্ত জুড়ে দেয়, যেমন সারা বছর হল চালু রাখতে হবে। তাহলে আমরা ব্যবসা করতে পারব, সরকারও ট্যাক্স পাবে, চলচ্চিত্রের অবস্থাও ফিরবে।”

২০২২ সালে ‘কুস্তিগীর’ সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন পরিচালক সমিতির সভাপতি শাহিন সুমন। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহের সংকটের কারণে লগ্নি ফেরত পাওয়ার আশা না দেখে সিনেমাটি টেলিভিশনে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

শাহিন সুমন বলেন, “এখন ৫০ থেকে ৬০টি হলই আমাদের ভরসা। ঈদের সময় সেটার বেশিরভাগই বড় বাজেটের সিনেমা পায়। বাকি সময় সিনেমা মুক্তি দিলে সেটার লগ্নি উঠে আসে না, এইসব সংকটে টেলিভিশনে মুক্তি দেওয়া।”

চলচ্চিত্রশিল্প বাঁচাতে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই পরিচালক।

তিনি বলেন, “রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ছাড়া এই শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। প্রতিটি জেলা-উপজেলায় ছোট ছোট সিনেপ্লেক্স তৈরি করা প্রয়োজন। গত সরকারের আমলে এক হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রকল্প ছিল, কিন্তু সেটা হল মালিকদের নেওয়া খুব জটিল। তার চেয়ে বরং সরাসরি ভর্তুকি দিলে হলগুলো টিকে থাকতে পারবে, উন্নতও হবে- যেমনটা অন্যান্য খাতে দেওয়া হয়।”

শাহীন সুমন, রেদওয়ান রনি, মিঠু খান, সুদীপ্ত কুমার দাস। ছবি: ফেইসবুক থেকে নেওয়া। 

প্রযোজকদের মতে, শুধু ভালো গল্প কিংবা নির্মাণ নয়, সিনেমা হলের পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা ঠিক না থাকলে দর্শক ধরে রাখা অসম্ভব। সেই দায়িত্ব হল মালিকদের নিতে হবে। এছাড়াও স্বচ্ছ হিসাবে হল থেকে লগ্নি উঠে না বলে সিনেমার সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন তারা।

প্রযোজক রেদওয়ান রনি বলেন, “হলের মালিকদের দায়িত্ব, আমি যে একটা সিনেমা নিচ্ছি সেটা দর্শকদের কত সুন্দর পরিবেশে উপস্থাপন করা যায়। আমাদের সিনেপ্লেক্স ছাড়া বাকি হলগুলোর করুণ দশা। ঈদের সময় সিনেমা ভালো ব্যবসা করে, কিন্তু তখন কিন্তু হল সংস্কারে উদ্যোগ নেন না মালিকরা।”

চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে এই প্রযোজক বলেছেন, সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি যে রকম অনুকূল হওয়ার কথা এখানে সেরকম না।

“জায়গাটা খুব চ্যালেঞ্জিং, টিকেটের হিসাব পাওয়া যায় না। লগ্নি ওঠে না বলে অনেকেই লোকসানে পড়েন।”

হলের পরিবেশ ভালো থাকলে এবং হিসাব স্বচ্ছ হলে বছরে আরও বেশি সিনেমা প্রযোজনা হত বলে মনে করেন তিনি।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে গেলে হল মালিকদের কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া যায় বলে মনে করেন আরেক পরিচালক ও প্রযোজক মিঠু খান।

ভালো সিট, সাউন্ড, প্রজেকশন ও পরিবেশ ভালো থাকলেই একটা হলে সিনেমা দেওয়া হবে। তবে তাতে সিনেমার লগ্নি উঠাতে বিকল্প উপায়ও ভাবতে হবে বলে মনে করেন এই পরিচালক।

নির্মাতা ও প্রযোজকদের মত প্রদর্শক সমিতির পক্ষ থেকেও উঠে এসেছে একই সুর।

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস মনে করেন, সিনেমা হল আর ভালো সিনেমা এই দুটোরই বিকল্প নেই।

“তবে দেশের অনেক হলের ভেতরের পরিবেশ এখনো সময়োপযোগী নয়, দর্শক টানার মত নয়।”

আবার ঈদ ছাড়া বড় পরিসরে সিনেমা নির্মাণ বা মুক্তি নেই বললেই চলে। তা এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে নির্মাতা ও হল মালিক উভয় পক্ষেরই সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

তিনি বলেন, ২০১০ সাল থেকেই দেশের হলগুলো ডিজিটাল করার পরিকল্পনায় কাজ করছে সমিতি। এ নিয়ে সরকারকে একাধিকবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়েও পেশ করা হয়েছে যেন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে হল সংস্কারের জন্য টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় বা সরকারি কোনো ব্যাংক বা প্রকল্প থেকে বিনা সুদে ঋণ দেওয়া হয়। কিন্তু এসব প্রস্তাব এখনও কার্যকর হয়নি।

সরকারিভাবে সহযোগিতা না পেলে এই অঙ্গন সামনে এগিয়ে যাওয়া খুব কষ্টকর বলে তিনি মনে করেন।

সুদীপ্ত দাস বলেন, “যদি দেশে ১০০টি সিনেপ্লেক্স গড়ে তোলা যায়, ভালো শিল্পী, টেকনিশয়ান, এবং দেশের পোস্ট-প্রোডাকশন ব্যবস্থার মান বাড়িয়ে নির্মাণ খরচ কমানো যায় তাহলে চলচ্চিত্রশিল্পকে নতুন প্রাণ দেওয়া সম্ভব।”



[তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সিলেট প্রতিনিধি বাপ্পা মৈত্র, ময়মনসিংহ প্রতিনিধি ইলিয়াস আহমেদ, রংপুর প্রতিনিধি আফতাবুজ্জামান হীরু এবং বরিশাল প্রতিনিধি সাঈদ মেমন]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews