ডক্টর মোহাম্মদ ইদ্রিস

হজ্ব মুসলিম উম্মাহর মহাসম্মেলন। প্রতিবছর জিলহজ্ব মাসে পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে আগত মুসলিম মিল্লাত ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে খানায়ে কা‘বায় সমবেত হন। হজ¦ ও কুরবানিতে মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ:)-এর স্মৃতির নির্দশনসমূহ ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগেরই স্মরণ করা হয়। এর পেছনে রয়েছে এক মর্মস্পর্শী ও মহৎ ইতিহাস। আল-কুরআনের চল্লিশটি সূরায় মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ:) ও তাঁর আত্মত্যাগের কথা আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেকোন সামর্থ্যবান মু‘মিনের জন্য হজ¦ পালন করা ফরয। যেমনটি পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন: ‘সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ¦ করা ফরয। আর যে কুফরী করে, তবে আল্লাহ তো নিশ্চয়ই সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী।’ [সূরা আলে-ইমরান: ৯৭] ইসলামের মৌলিক ইবাদতসমূহ দু’ধরনের। এক-দৈহিক ইবাদত, যেমন নামায, রোযা। দুই-মালের ইবাদত, যেমন সদকা, যাকাত দান-খয়রাত ইত্যাদি। কিন্তু হজ¦ এমন এক মৌলিক ইবাদত যাতে উভয় বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। অর্থাৎ এটি মালেরও ইবাদত এবং দেহেরও ইবাদত। যদিও এটি মহানবী (সা:)-এর নবুয়তী জীবনের শেষের দিকে ফরয ইবাদত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু মাক্কী সূরা সমূহেই এ প্রসঙ্গে পূর্ব থেকেই আলোচনা শুরু করা হয়। যেমন- আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন: ‘যেন তারা নিজেদের কল্যাণের স্থানসমূহে হাযির হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু থেকে যে রিয্ক দিয়েছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে। অতঃপর তোমরা তা থেকে খাও এবং দুস্থ-দরিদ্রকে খেতে দাও।’ [সূরা আল-হাজ¦: ২৮]

আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে বর্তমান ইরাকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ:)। সে সময়ে মানুষ আল্লাহপাককে ভুলে গিয়ে ব্যক্তি ও সৃষ্টির পূজায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। তৎকালীন শাসক নমরুদ শাসন করছিল এবং দাবি করছিল যে, সে নাম্নার (চন্দ্র) দেবতার প্রতিনিধি, তাকে মেনে চললে দেবতারাও খুশি হবে। শাসক ও পুরোহিত একে অপরের সহযোগী হিসেবে সেদিন মানুষের প্রতি জুলুম করছিল। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহপাকের আনুগত্য করার কোন সুযোগ সে সমাজে ছিলনা। মানুষ কল্পিত দেব-দেবী ও নিজেদের হাতে গড়া মূর্তির প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পেশ করতো। পুরোহিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও আল্লাহপাকের অনুগ্রহে হযরত ইবরাহিম (আ:) ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি একে একে তারকা, চন্দ্র ও সূর্য সবকিছু অস্বীকার করে সকল সৃষ্টির স্রষ্টা ও মালিক আল্লাহপাককে উপলব্ধি করে ঘোষণা প্রদান করলেন: ‘আমি সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে নিয়োজিত করলাম, যিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ [সূরা আল-আন‘আম: ৭৯]

তিনি তার জাতিকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন: ‘হে জাতির লোকেরা-তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরীক বলে মনে কর, তাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।’ [সূরা আল আন‘আম: ৭৮] তিনি তার পুরোহিত পিতাকে বললেন: ‘আর (স্মরণ কর) যখন ইবরাহীম তার পিতা আযরকে বলেছিল, ‘তুমি কি মূর্তিগুলোকে ইলাহরূপে গ্রহণ করছ? নিশ্চয়ই আমি তোমাকে তোমার কওমকে স্পষ্ট গোমরাহীতে দেখছি’। আর এভাবেই আমি ইবরাহীমকে আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব দেখাই এবং যাতে সে দৃঢ় বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। অতঃপর যখন রাত তার উপর আচ্ছন্ন হল, সে তারকা দেখল, বলল, ‘এ আমার রব’। অতঃপর যখন তা ডুবে গেল, তখন সে বলল, ‘যারা ডুবে যায় আমি তাদেরকে ভালবাসি না’। অতঃপর যখন সে চাঁদ উজ্জ্বলরূপে উদীয়মান দেখল, বলল, ‘এ আমার রব’। পরে যখন তা ডুবে গেল, বলল, ‘যদি আমার রব আমাকে হিদায়াত না করেন, নিশ্চয় আমি পথহারা কওমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’। অতঃপর যখন সে সূর্য উজ্জ্বলরূপে উদীয়মান দেখল, বলল, ‘এ আমার রব, এ সবচেয়ে বড়’। পরে যখন তা ডুবে গেল, তখন সে বলল, ‘হে আমার কওম, তোমরা যা শরীক কর, নিশ্চয় আমি তা থেকে মুক্ত’। [সূরা আল-আনআম:৭৪-৭৭]

হজরত ইবরাহীম (আ:) শুধু ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, তার জাতির ভুল ভাঙার জন্য নিজ হাতে মূর্তিগুলো ভেঙে এর অসারতা প্রমাণ করলেন। হজরত ইবরাহিম (আ:) এর দুঃসাহসিক কাজকে নমরুদ ও তার সভাসদবৃন্দ সুস্পষ্ট রাষ্ট্র ও ধর্মদ্রোহিতার অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করে চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করল। ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ যেন আর কেউ না করতে পারে সেজন্য জালিমেরা তাঁকে প্রকাশ্যে আগুনে পুড়ে মারার ব্যবস্থা করল। এটা হলো হজরত ইবরাহিম (আ:) এর উপর প্রথম পরীক্ষা। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তিনি যখন তাগুতি শক্তির নিকট আত্মসমর্পণ না করে শাহাদাতের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন তখন আল্লাহপাক তাঁর বান্দাহকে এই কঠিন পরীক্ষা থেকে সাফল্যজনকভাবে উত্তীর্ণ করলেন।

হযরত ইবরাহিম (আ:) এর জীবনে আসে পরীক্ষার পর পরীক্ষা। আগুন থেকে মুক্তি লাভের পর যখন তিনি দেখলেন তাঁর জাতি দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলো তখন তিনি স্ত্রী হাজেরা ও ভাইপো লুত (আ:) কে সঙ্গে নিয়ে অজানার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলেন। রুজি-রোজগারের কোন ব্যবস্থা ছিলনা- কোন আশ্রয়েরও নিশ্চয়তা ছিলনা। একজন মু‘মিন আয়েশী জীবন যাপনের জন্য দুনিয়ায় আসেনি। সকল প্রতিকূল অবস্থায় একনিষ্ঠভাবে আল্লাহপাকের আনুগত্য এবং মানুষকে তাঁর দিকে আহ্বান জানানোই তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য। এভাবে পথে-প্রান্তরে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর বৃদ্ধ বয়সে তিনি শংকিত হয়ে পড়লেন যে তাঁর অনুপস্থিতিতে এ মিশনকে অব্যহত রাখবে। এজন্য তিনি আল্লাহপাকের নিকট সন্তান চাইলেন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি একটি পুত্র সন্তান লাভ করলেন। আবারও পরীক্ষা শুরু হলো। আল্লাহপাকের পক্ষ হতে নির্দেশ এল স্ত্রী ও সন্তানকে নির্বাসন দানের। তাঁর নির্দেশে সকল মায়া-মমতাকে উপেক্ষা করে স্ত্রী ও সন্তানকে রেখে এলেন এক নির্জন স্থানে। কোন অভিযোগ নয় বা অনুরোধও নয়, আল্লাহপাকের নির্দেশের নিকট পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করলেন। তাঁর স্ত্রী শুধু জিজ্ঞসা করলেন এটা কি আল্লাহপাকের নির্দেশ? জবাবে বললেন হ্যাঁ। সবাই সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিলেন। মূলত: আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলাই বান্দাহর কর্তব্য।

প্রিয়তম সন্তান যখন দৌড়াদৌড়ি করার বয়সে উপনীত হয় সে সময় আল্লাহপাকের পক্ষ হতে আসে আবারও পরীক্ষা। স্বপ্নে তিনি আদিষ্ট হন তাঁর প্রিয়তম বস্তুকে কুরবানি করতে। তিনি পরপর উট জবেহ করার পর একই আদেশপ্রাপ্ত হন। তাঁর সবচেয়ে প্রিয়বস্তু ছিল কলিজার টুকরো সন্তান ইসমাইল (আ:) তাঁর স্বপ্নের কথা স্ত্রী ও ছেলেকে জানালে সন্তুষ্টচিত্তে সবাই মেনে নিলেন। মুসলিম (আত্মাসমর্পিত) পিতার মুসলিম ছেলে পিতাকে জানালেন: ‘পিতা-আপনি তাই করুন যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন, ইনশা-আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। উভয়ই যখন আনুগত্যের মস্তক অবনত করে দিলেন (অর্থাৎ পিতা জবেহ করতে এবং সন্তান জবেহ হতে) তখন আল্লাহপাক ডাক দিয়ে বললেন হে ইবরাহিম, তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎ লোকদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকি। নিঃসন্দেহে এটি বড় ধরনের পরীক্ষা ছিল। আর একটি বড় কুরবানির বিনিময়ে আমি ছেলেটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর তার প্রশংসা ও গুণ পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে প্রচলিত করে দিলাম।’ [সূরা আস সফ্ফাত: ১০২-১০৮]

আল্লাহপাকের জন্য সবকিছু উজাড় করে দেয়ার যে দৃষ্টান্ত হযরত ইবরাহিম (আ:) জগতবাসীর কাছে উপস্থাপন করলেন, বিশেষ করে নিজ হাতে আপন ছেলেকে জবেহ করার যে দৃষ্টান্ত তা আল্লাহপাকের নিকট ছিল বড়ই প্রীতিকর। তাই বান্দাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে গোটা বিশ্বের ইমাম নিযুক্ত করে দিলেন এবং পরবর্তীকালে লোকদের জন্য এটাকে স্মরণ হিসেবে জারি করে দিলেন। আমাদের এ কুরবানি মূলত মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ:) ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগেরই স্মরণ। সাহাবায়ে কেরাম (রা:) যখন রাসূলুল্লাহ (সা:) কে জিজ্ঞেস করলেন ‘কুরবানিগুলি কী? তিনি জবাবে বললেন ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিমের (আ:) সুন্নাত।’ (ইবনে মাযাহ)

হজে¦র আনুষ্ঠানিকতা ও কুরবানির মধ্যে হযরত ইবরাহিম (আ:) ও তাঁর পরিবারের অনেক স্মৃতিই আমাদেরকে স্মরণ করে দেয়। পশু কুরবানির মাধ্যমে কুরবানিদাতা এ ঘোষণাই প্রদান করে: ‘বল, নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু আল্লাহর জন্য, যিনি সকল বিশ্ব সৃষ্টির রব।’ (সূরা আল-আনআম: ১৬২) অর্থাৎ না আমি আমার, আর না পরিবার পরিজনের জন্য। বরং আমি নিজের বা পরিবার বা মানুষের প্রতি যে দায়িত্ব পালন করি তা কেবল আল্লাহ তা’য়ালারই নির্দেশক্রমে- তাঁরই সন্তুষ্টির লক্ষ্যে করি। কুরবানির সময় কুরবানি দাতা আল্লাাহ তা’য়ালার কাছে এই ওয়াদাই করে থাকে। বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের আজ বড় দুর্দিন। আল্লাহর অনুগত বান্দাহদের এই দুর্দশা সত্যিই বিস্ময়কর। আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা: ‘তোমাদেরকে উত্তম জাতি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমাদের কাজ হল তোমরা মানুষদের সৎ পথে আহ্বান করবে এবং অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে আর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখবে। [সূরা আলে-ইমরান: ১১০] অথচ মুসলিম জাতি আজ নির্যাতিত অবহেলিত। তাই ত্যাগ ও কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর অনুগত বান্দাহদের তাদের রবের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।

হজ¦ বলতে ৯ জিলহজ¦ আরাফার ময়দানে অবস্থান ও পবিত্র কা’বা ঘরের যিয়ারতসহ অন্যান্য বিধিবিধান পালনকে বুঝানো হয়। প্রাচীনত্বের বিবেচনায় কা‘বা বিশ্বের সর্বপ্রথম গৃহ। আর মর্যাদার বিবেচনায়ও কা‘বা অতুলনীয়। কারণ কা’বা ব্যতীত বিশ্বের আর কোন স্থাপত্য, ইমারত কিংবা গৃহ নেই যার তাওয়াফ করা হয়। এ মর্যাদাপূর্ণ ঘরকে কেন্দ্র করে যেমন হজে¦র শুরু এবং বিদায়ী তাওয়াফ দিয়ে শেষ হয়। ইবরাহীম (আ:) মানুষের নিকট হজে¦র ঘোষণা দানের পর থেকে মক্কা ও ও তার আশেপাশের লোকেরা হজ¦ করা আরম্ভ করেন। আর এ ধারা পরবর্তী যুগে অব্যাহত ছিল।

ইবরাহীম (আ:)-এর পর যত নবীর আগমন হয়েছে তারা প্রত্যেকেই হজ¦ করেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। বাইতুল্লাহ জিয়ারত বা হজ¦ মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ:)-এর স্মৃতির নির্দশনসমূহ ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগেরই স্মরণ। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য হজে¦র মহাসম্মেলনে অংশগ্রহণ ও একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই কুরবানি দানের তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সাঁথিয়া মহিলা ডিগ্রি কলেজ।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews