বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মন্থর প্রতিক্রিয়ার সুযোগে আবারও ভয়ঙ্করভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ভেজাল ও নকল ওষুধের কারবার। শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এই ভেজাল সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে মারাত্মক পরিণতি নিয়ে, যেখানে আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক এবং রোগী সবাই। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—এসব ভেজাল ওষুধ অনেকক্ষেত্রেই খালি চোখে ধরাও যাচ্ছে না, এমনকি চিকিৎসকরাও বিভ্রান্ত হচ্ছেন।

২০২৩ সালে পাস হওয়া ওষুধ ও কসমেটিক আইন অনুযায়ী ভেজাল ওষুধ তৈরির অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হলেও বাস্তবে এখনও কাউকে এই আইনে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া হয়নি। এর ফলে অসাধু চক্র আরও সাহস পেয়ে মাঠে নেমেছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন সরাসরি অভিযোগ করেছেন—সরকারের আন্তরিকতার অভাব এবং কার্যকর নজরদারির ঘাটতির কারণেই বাজারে আবারও নকল ওষুধের দৌরাত্ম্য দেখা দিচ্ছে।

একজন চিকিৎসকের কণ্ঠে আমরা বাস্তব সংকটের ছবি পাই। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. চঞ্চল কুমার ঘোষ বলেন, “অ্যালবুমিন ইঞ্জেকশন এতটাই বেশি নকল হচ্ছে যে আমরা এটা ব্যবহার করাই বন্ধ করে দিয়েছি।” তিনি আরও বলেন, “দেখতে এতটাই আসলের মতো যে চিকিৎসকরাও পার্থক্য বুঝে উঠতে পারছেন না। তাহলে সাধারণ মানুষ কিভাবে চিনবে?” উল্লেখ্য, গুরুতর অস্ত্রোপচার বা রক্তে প্লাজমার ঘাটতি পূরণে ব্যবহৃত এই ইনজেকশনটি সিলেট ও ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালে জটিলতা তৈরি করে, পরবর্তীতে পরীক্ষায় তা নকল প্রমাণিত হয়।

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে (Nature)-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় বিক্রি হওয়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের প্রায় ১০ শতাংশই ভেজাল বা নিম্নমানের। ঢাকার বাইরে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ—সেখানে প্রায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত ওষুধই নকল। গবেষণাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, জাপানের কানাজাওয়া ইউনিভার্সিটি এবং জার্মানির এবাহার্ড কার্ল ইউনিভার্সিটি। অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণায় উঠে আসে আটা-ময়দা দিয়ে বানানো নকল বড়ি ও অ্যান্টিবায়োটিকের ভয়ানক তথ্য।

অভিযানে বারবার দেখা গেছে আটা-ময়দা, এমনকি সুজিও ব্যবহার হচ্ছে ভেজাল ওষুধ তৈরিতে। ২০২৪ সালের মার্চে ঢাকা ও বরিশালে অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে, যারা দশ বছর ধরে আটা-ময়দার ট্যাবলেট বানিয়ে বিক্রি করছিল। তাদের কাছ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ নকল অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ধার করা হয়। এমন ঘটনা থেকে বোঝা যায়, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সুসংগঠিত এবং লোভনীয় একটি অপরাধ চক্রের অংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব ওষুধের দাম বেশি এবং বাজারে চাহিদা প্রচুর, যেমন গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিক—সেগুলোকেই টার্গেট করছে এই অসাধু চক্র। অনেক সময় বিদেশি ওষুধও নকল করা হচ্ছে, যেগুলোর মূল দাম বেশি এবং সহজে পাওয়া যায় না। এসব ভেজাল ওষুধ খরচে কম হওয়ায় ফার্মেসিগুলো কম দামে কিনে বেশি মুনাফা করে, ফলে তারাও এই চক্রে জড়িত হচ্ছে। এভাবেই ওষুধ পৌঁছে যাচ্ছে শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে গ্রামের প্রত্যন্ত ফার্মেসিতেও।

বাংলাদেশে প্রায় আড়াই লাখেরও বেশি ওষুধের দোকান থাকলেও এদের একটি বড় অংশই অননুমোদিত বলে জানা গেছে। আবার অনুমোদিত ফার্মেসিগুলোর মধ্যেও অনেকেই নিয়মনীতি মানছে না। ওষুধ সংরক্ষণের ত্রুটি, মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি, এবং সংরক্ষণে মান না রাখা—এসব কারণে ওষুধের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রোগীরা যেমন প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি অকার্যকর ওষুধের কারণে তাদের স্বাস্থ্যের আরও ক্ষতি হচ্ছে।

সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, দরিদ্র জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই ভেজাল ওষুধের হাতে। অনেকেই দামের কারণে সস্তা ওষুধ কিনে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। চিকিৎসা নিতে গিয়ে জীবন আরও ঝুঁকিতে পড়ছে। ডা. চঞ্চল ঘোষ বলেন, “যাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ, তারাই সাধারণত সস্তা ওষুধ কিনতে গিয়ে বিপদে পড়ছেন। কখনও কখনও এসব ওষুধ খেয়ে জটিলতা দেখা দিচ্ছে বা রোগী মারা যাচ্ছেন।”

এই ভয়াবহ চিত্র আমাদের একটি বড় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়—আমাদের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কি কার্যকর? কেন নকল ওষুধ উৎপাদনের শিকড় এত গভীরে প্রবেশ করেছে? কোথায় প্রশাসনিক নজরদারি? ভোক্তা অধিকার রক্ষা সংস্থা, সরকারি সংস্থা ও প্রশাসনের মাঝে সমন্বয় না থাকলে এই মহাবিপদ থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও যদি প্রয়োগ না হয়, তাহলে আইনের কার্যকারিতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

ভেজাল ও নকল ওষুধ বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য এক ভয়ানক হুমকি। শুধু রোগীর শারীরিক ক্ষতি নয়, এতে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নীরবতা, দুর্বল তদারকি, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে অপরাধীরা যতদিন পার পেয়ে যাবে, ততদিন এই ভয়াবহতা আরও বিস্তার লাভ করবে। সময় এসেছে, কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার—নয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews