একটি দেশের সেবদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়ে তার কর্মরত লোকজনের উদাসীনতার কারণে। কর্মরত দায়িত্বশীলরা নিজ নিজ কর্মঘণ্টা কীভাবে ব্যয় করেন তার জবাবদিহিতা চাওয়া বা নেয়ার লোকরা এজন্য সর্বাগ্রে দায়ী।

জবাবদিহিতা না থাকলে জবাবহীনতা জন্ম নেয়। ফলে কর্মচারীরা নিজ নিজ দায়িত্ব ঠিকমতো পালন না করে একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। নিজের দোষ অপরের ঘাড়ে চাপানোর স্বভাব আমাদের দেশের অফিস-আদালতে অনেক বেশি।

নিজের অদক্ষতা ঢাকতে ফাঁকিবাজি করার কারণে দোষ চাপানো স্বভাবের জন্ম হয়। এর সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি থাকায় এবং ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণ না থাকায় দিন দিন পেশাজীবী লোকজনের দক্ষতার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

এভাবে পেশাজীবী লোকজনের দক্ষতার মান খুব নিচে অবস্থান করায় তারা নিজেদের চাকরি বজায় রাখতে অথবা সহজে প্রমোশন, বদলি, বোনাস ইত্যাদি পেতে সবসময় তৎপর থাকেন। ফলে শুরু হয় সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগী শ্রেণির অপতৎপরতা।

এর ফলস্বরূপ দলাদলি ও রাজনীতির আশ্রয়-প্রশ্রয় নেয়ার ঘটনা ও পরিবেশ তৈরি হয়। এভাবে দিনে দিনে আমাদের দেশে প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানে দলকানা পেশাজীবী শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছে।

আগেকার দিনে সিবিএ বা অনুরূপ স্বীকৃত সংগঠনগুলো কোনো প্রতিষ্ঠানের সব কর্মচারীর স্বার্থ সংরক্ষণ করত। এখন সময় পাল্টেছে। এখন সুনির্দিষ্ট দল-মত না মানলে সহজে প্রমোশন, বদলি, বোনাস ইত্যাদি সুদূরপরাহত ব্যাপার। এমনকি দল-মতের ভিন্নতার কারণে দক্ষ কর্মচারীরাও অনেক ক্ষেত্রে ভোগান্তির শিকার হয়ে থাকেন।

দলকানা রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি থাকায় উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন অনেক পরের ভাবনার ব্যাপার বৈকি। এর সঙ্গে বিগত বছরগুলোতে যুক্ত হয়েছে জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে উৎকণ্ঠা ও হতাশা।

বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করতে নানা জায়গায় শুরু হয়েছে অবৈধ হস্তক্ষেপ। পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ‘বৈশ্বিক রিপোর্ট ২০২০’-এর এক প্রতিবেদনে বলেছে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করছে।

সংস্থাটি আরও বলেছে, নির্যাতনের অভিযোগ থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।’ এর ফলে অনেক গুরুতর অপরাধ করেও অনেকের পক্ষে পার পেয়ে যাওয়া খুব সহজ হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে অপরাধ নির্মূলে একে অপরকে দায় চাপানোর সংস্কৃতি বন্ধ করবে কে?

দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জননিরাপত্তা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, মাদকসহ সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, প্রটোকল ইত্যাদিতে কাজে লাগানো হয়। সেখানেও দক্ষ মানবসম্পদের বড় অভাব রয়েছে। এছাড়া রয়েছে দলকানা প্রবৃত্তি ও আঞ্চলিক প্রভাব।

বিদেশে গেলে আমরা দেখি রাস্তায় লাল সিগন্যাল বাতি জ্বলে উঠলে সবাই থেমে যায়। অথচ আমাদের দেশের রাস্তায় এখনও সিগন্যাল বাতিহীনতার সমস্যা বিরাজমান! দেশের মানুষে মানুষে চরম আয়-বৈষম্য আমাদের একশ্রেণির মানুষকে নিত্যনতুন মডেলের দামি গাড়ি কিনতে উৎসাহিত করছে।

তারা সেসব হাল মডেলের গাড়ি কিনে রাস্তায় নেমেও যাচ্ছেন। দূষণযুক্ত রাস্তার পরিবেশে ট্রাফিকরা হন্যে হয়ে হাতের ইশারায় রাজপথের বিএমডব্লিউ বা টয়োটা ক্রিসিডাকে আর কতদিন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন? ডিজিটাল বাংলাদেশ তবে রাস্তায় কম্পিউটারাইজড ডিজিটাল সিগন্যাল কবে প্রদর্শন ও ব্যবহার করবে?

এখন নৈতিকতায় সমৃদ্ধ দক্ষ মানবসম্পদের বড় অভাব। চারদিকে অনৈতিকতা দিন দিন ধর্ষণকে উসকে দিচ্ছে। এখন চারদিকে দাবি উঠেছে ধর্ষণকে ‘দুর্নীতি’ ঘোষণা করা হোক।

এখন দুই সিটিতে নির্বাচন নিয়ে তুমুল প্রচারণা চলছে। সঙ্গে ভোট প্রদান করা নিয়ে ভোটারদের মনে চাপা উত্তেজনা বিরাজমান। অনেকে বলছেন, ভোটাতঙ্ক দূর না হলে কিসের গণতন্ত্র? ভোট নিয়ে চারদিকে ভোটারদের এত ভয় কেন?

অপরদিকে সরস্বতী পূজার দিনে ভোটগ্রহণ করার ঘোষণা কর্তৃপক্ষের আগে কি স্মরণে আসেনি? আন্দোলনের মুখে সেটাকে পেছাতে হল। সবকিছু মিলে সিটি ভোট নিয়ে এত বিতর্কের জন্মই বা কেন দেয়া হচ্ছে? এটি আধুনিক সভ্যতার আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে বড়ই বেমানান।

অনেকের বাড়ি থেকে বলা হয় ভোট দিতে কেন্দ্রে যেও না। মারামারি হবে তো ওখানে। কেউ বলেন গতরাতেই তো কাজ সাবাড় হয়ে গেছে- ওখানে গিয়ে কী হবে? এ ধারণাগুলো আমাদের চলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় নিতান্ত রোবোটিক ও মুখস্থের মতো মনে হলেও আসলে খুবই কষ্টদায়ক।

ইভিএম প্রশিক্ষণ না থাকলে ভোট প্রদানের সময় বোতাম টিপতে ভুল হবে- ভুলের ২৫ শতাংশ ভোট কি তাহলে প্রিসাইডিং সাহেব নিজেই দেবেন? তার নিজের দলকানা রোগ থাকলে সেটা সারানোর দায়িত্বটা কার ওপর বর্তায়? সুষ্ঠু ভোটদান প্রক্রিয়া হল গণতন্ত্রের প্রাথমিক ও প্রধান শর্ত।

বর্তমানে ভোটদান নিয়ে অশান্তি ও আতঙ্ক চারদিকেই শোনা যাচ্ছে। এত আতঙ্ক ও হতাশার মাঝে একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু ভোটদান প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে সেসব হতাশা দূর না হলে তবে কার স্বার্থে কিসের গণতন্ত্র চর্চার কথা ভাবা হচ্ছে?

আমরা জাতি হিসেবে কেন এত দেউলিয়া হয়েছি যে, একটি গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু ভোটদান প্রক্রিয়া চালু করতে বারবার অপারগ হচ্ছি? একটি টালমাটাল ও অশান্তিকর অবস্থার মধ্যে ছলচাতুরীর ভোটব্যবস্থা দিয়ে অশান্তিকর সমাজ-পরিবেশ সৃষ্টি করা সভ্য কারও কাম্য হতে পারে না।

এভাবে উন্নয়ন করা হলেও সেটা কি টেকসই উন্নয়ন হবে? এভাবে আসলে কি উন্নয়ন সম্ভব? এভাবে চোখে ধুলো আর কতদিন?

কথা হল, আমার ভোট আমি দিতে চাই। কোনো দলকানা পক্ষপাতমূলক পেশাজীবীর নগ্ন হস্তক্ষেপ ছাড়াই আমি আমার নিশ্চিত ভোটাধিকার নিজে প্রয়োগ করতে চাই। অতীতের ন্যক্কারজনক ঘটনা অবলোকনে আমার মধ্যে ভোটাতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

সে আতঙ্ক দূর করে ভোটের দিন নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটদান করতে পারলে সেই হতাশা ও অশান্তি কিছুটা লাঘব হবে বলে আমার বিশ্বাস। সেটাই একটি টেকসই গণতন্ত্র ও টেকসই উন্নয়ন বয়ে আনতে পারে।

এজন্য সংশ্লিষ্ট পেশাদারি দায়িত্বে নিয়োজিত সব পক্ষপাতমূলক দলকানাকে আহ্বান করব আমার ভোটাতঙ্ক দূর করুন, দুর্নীতিতে জিরো সহ্যসীমার কথা শুনে শুনে আমি কিছুটা উৎসাহিত হয়ে আবার প্রতারিত হতে যাব কেন?

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান

[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews